কলকাতাঃ দিল্লি চলো-এই শব্দটির মাধ্যমেই কলকাতায় বসে দিল্লি যাবার পরিকল্পনা হয়েছিল। পরিকল্পনা ছিল ভারতের রাজধানী ঘুরে দেখার।
দেশনায়ক নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু থেকে অগ্নিকন্যা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়সহ অনেকেই রাজনৈতিক লক্ষ্যের জন্য দিল্লিকেই বেছে নিয়েছিলেন বা নিচ্ছেন। কিন্তু আমাদের পরিকল্পনা শুধুমাত্র শহর দিল্লির সঙ্গে কিছুটা সময় কাটানো ।
ঐতিহাসিকদের মতে ৭৩৬ খৃষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠা হয়েছিল দিল্লির। তবে খৃষ্টপূর্ব ৩০০ অব্দে ভারতের মৌর্য শাসনকালের স্থাপত্য পাওয়া গেছে দিল্লির মাটিতে। তবে সাধারণভাবে দিল্লিকে ৫ হাজার বছরের পুরানো শহর বলে ধরা হয়।
দিল্লিগামী ট্রেনে দীর্ঘ অবসরে বসে ‘দিল্লিকা লাড্ডু’-প্রবাদের উৎস সন্ধান করছিলাম। ট্রেন যাত্রার বর্ণনায় বিশেষ শব্দ খরচ করার প্রয়োজন নেই। কারণ সকলেই জানেন এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত জুড়ে রয়েছে ভারতের রেলপথ। আমজনতার যোগাযোগের এটাই মূল পরিবহন।
![Dilli_1 Dilli_1](files/December_2014/December_17/Dilli_1_805357289.jpg)
ভারতের রেল দপ্তরের পরিধি এতটাই বড় যে এই দপ্তরের জন্য আলাদা একটি বাজেট পেশ করা হয়ে থাকে। ঠিক যেমন ভারতের প্রতিটি রাজ্যের জন্য আলাদা বাজেট পেশ করেন সেই রাজ্যের অর্থমন্ত্রীরা। দিল্লিগামী প্রায় সমস্ত ট্রেনই মোটের উপর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। যাত্রী স্বাচ্ছন্দ্য নিয়ে টুকটাক কিছু অভিযোগ থাকলেও রেলের যাত্রী নিরাপত্তার বিষয়টি ভারত সরকার এখনও সবথেকে বেশি জোর দিয়ে চলেছেন।
রাজধানী এক্সপ্রেস ছাড়াও কলকাতা থেকে প্রতিদিন প্রায় ১৮-২০ টি ট্রেন ছাড়ে দিল্লির উদ্দেশ্যে। এছাড়াও কিছু ট্রেন আছে যেগুলি কলকাতা থেকে ছেড়ে দিল্লি হয়ে অন্যান্য জায়গায় যায়। তাই বলে টিকিট পাওয়া খুব একটা সহজসাধ্য মনে করলে ভুল হবে। একটু আগে থেকে পরিকল্পনা না করলে টিকিট পাওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যা হয়। তবে কিছুটা টাকা বেশী লাগলেও টিকিটের ক্ষেত্রে তৎকাল পরিষেবা রেল দপ্তরের সত্যি প্রশংসনীয় বিষয়।
কলকাতা থেকে দিল্লি যেতে রেল দপ্তরের হিসেব অনুযায়ী সময় লাগে প্রায় ১৮ ঘণ্টা। লেগেছিল ৩০ মিনিট বেশী। এটা রাজধানী এক্সপ্রেস। রেলের টিকিট জানান দিচ্ছিল কলকাতা থেকে দিল্লির দূরত্ব প্রায় ১৫০০ কিলোমিটার। রেলে বসেই হিসেব করে দেখলাম ঘণ্টায় গড় গতি ৮২ থেকে ৮৩ কিলোমিটার।
![Dilli_2 Dilli_2](files/December_2014/December_17/Dilli_2_486945464.jpg)
প্রধানমন্ত্রী হয়েই নরেন্দ্র মোদী জানিয়েছিলেন ভারতে ‘বুলেট ট্রেন’ চালু হবে। খরচ হবে ৯.৬৫ বিলিয়ন ডলার। গতি ঘণ্টায় ৩০০ কিলোমিটার। রেল যাবে আমেদাবাদ থেকে দিল্লি। কিন্তু ভারতের রেল লাইন কি আদৌ তৈরি এই ‘বুলেট ট্রেন’-কে বহন করতে। ইতিমধ্যেই হাজির টিকিট চেকার। হিন্দিভাষী এই মানুষটি তার দীর্ঘ ২৫ বছর চাকরির অভিজ্ঞতার ঝুলি থেকে জানালেন এখনও পর্যন্ত ঘণ্টায় ২০০ কিলোমিটার গতিতে চলার মত রেল লাইন ভারতে নেই।
ভারতের সবথেকে গতিসম্পন্ন রেল ভূপাল শতাব্দী এক্সপ্রেস চলে সর্বোচ্চ ঘণ্টায় ১৫০ কিলোমিটার। ২০১২ সালে গঠিত হয়েছে “হাই স্পিড রেল কমিশন”। তারা চেষ্টা চালাচ্ছে উন্নত গতি সম্পন্ন রেল চালাবার। যদিও পশ্চিমবঙ্গের ভাগ্যে সেই উচ্চগতির রেল মিলবে বলে এখনও জানা নেই, তবে আশার কথা একটাই লোকসভা নির্বাচনের আগে কলকাতার জনসভায় নরেন্দ্র মোদী বলেছিলেন ‘রাজ্যমে দিদি ওর দেশমে মোদী, দোনো হাত মে লাড্ডু’। তবে তার পরে রাজনীতির জল গড়িয়েছে ভিন্নখাতে।
আবার ঘুরেফিরে চলে এলো লাড্ডুর কথা। দিল্লিতে রেল যখন প্রবেশ করছে সেই সময় জানলার বাইরে দিয়ে দেখা গেল অপূর্ব প্রাকৃতিক দৃশ্য। সেই নিসর্গ চোখের সামনে ধীরে ধীরে রূপ নিলো একটি আধুনিক শহরের। ট্রেন প্রবেশ করল নিউ দিল্লি স্টেশনে।
ততক্ষণে চা-নাস্তা সারা হয়ে গেছে। কিন্তু দিল্লির লাড্ডুর স্বাদ তখন চেখে দেখা হয়নি। মনের ভেতরটা উসখুশ করছে। খেয়ে পস্তানোর রহস্যটা ভেদ করার জন্য। হোটেলে পেতে সমস্যা হয়না এখানে।
![Dilli_3 Dilli_3](files/December_2014/December_17/Dilli_3_557559817.jpg)
ভারতের রাজধানী দিল্লি, খুব স্বাভাবিকভাবেই রাজধানী আর রাজনীতি একে ওপরের সঙ্গে যুক্ত।
সুযোগ পেয়েই হাতে নিলাম খবরের কাগজ। খুব স্বাভাবিক ভাবেই রাজনীতি নিয়ে প্রথম পাতার খবর। দিল্লি বিধানসভার সরকার গঠন নিয়ে খবর প্রথম পাতায়।
কিছুদিন আগে ভেঙ্গে যাওয়া দিল্লি বিধানসভায় ৪৯ দিন মূখ্যমন্ত্রী হিসেবে কাজ করে ছিলেন অরবিন্দ কেজরিওয়াল। তার পর তিনি পদত্যাগ করেন। এই ৪৯ দিনেই তার রাজমুকুট কাঁটার মুকুট বলে মনে হয়েছিল। দিল্লির রাজনীতিতে আম আদমি পার্টি প্রাসঙ্গিকতা থাকলেও, তার ঝাঁজ আর আগের মত নেই। নিজের সিদ্ধান্তে নিজেই পস্তাচ্ছেন অরবিন্দ কেজরিওয়াল। এটাই কি দিল্লির লাড্ডুর আসল পরিচয়!
সময় খুব কম। তারমধ্যেই আমরা ঘুরে দেখতে চাই শহরটাকে। তাই আর সময় নষ্ট নয়। নিউ দিল্লি দেখতে হলে শুরু করতে হবে ইন্ডিয়া গেট দিয়ে। দিল্লির ঐতিহ্য বহন করে চলেছে এই গেট। উৎসব থেকে বেদনাদায়ক স্মৃতি দামিনী, সব কিছুতেই এখানে জড়ো হয় টুরিস্টসহ এখানকার মানুষ। আমাদের গাইড কাম ড্রাইভারের সঙ্গে কথাবার্তায় জানতে পারলাম গান্ধি পরিবারে সোনিয়া পুত্র রাহুল তার বোনকে নিয়ে মাঝেমাঝেই নাকি দুচাকা চালিয়ে ইন্ডিয়া গেটে বেড়াতে আসেন।
![Dilli_4 Dilli_4](files/December_2014/December_17/Dilli_4_516536266.jpg)
মনে মনে ভাবলাম যদি এই কথা সত্য হয় তাহলে এতো তার নিরাপত্তার পক্ষে ভয়ঙ্কর ঝুঁকি। তিনি কি ইন্দিরা গান্ধি এবং রাজীব গান্ধির উপর হামলার কথা ভুলে গেছেন। নিশ্চয় নয়। রাহুল গান্ধির ছোটবেলার অনেকটাই কেটেছিল নিরাপত্তার ঘেরাটোপে। ইন্দিরা গান্ধির মৃত্যুর পর নিরাপত্তার কারণে তাকে এবং প্রিয়াঙ্কা গান্ধিকে বেশ কয়েক বছর বাড়িতে থেকে পড়াশুনা করতে হয়েছিল। এরপর তিনি পড়াশুনা করতে বিদেশে পাড়ি দেন। ইন্দিরা গান্ধি মিউজিয়ামে রাখা আছে ইন্দিরা গান্ধী এবং রাজীব গান্ধীর পরিহিত শেষ পোশাক দুটি।
ইন্ডিয়া গেটের উল্টোদিকেই আছে রাষ্ট্রপতি ভবন। যেখানে আলোকিত করে আছে আর এক বাঙালী, প্রণব মুখোপাধ্যায়। ভবনের গোটা অঞ্চলটি পার হতে প্রায় ১০০ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টায় চলা গাড়িতে অন্তত কুড়ি মিনিট লাগল।
দেখে নিলাম জামে মসজিদ থেকে শুরু করে লাল কেল্লা। জামে মসজিদের আগের নাম ছিল ‘মসজিদ জাহান নুমা’। রাজঘাট থেকে কুতুব মিনার। ইন্দিরা গান্ধী মিউজিয়াম, চাঁদনি চক, চক মানে বাজার বা মার্কেট কত কি দেখার শেষ নেই। মোটামুটি দুই থেকে তিনদিন সময় পেলে ঘুরে দেখা যেত দিল্লির ২২টা পয়েন্ট। কিন্তু বাধ সেধেছে সময়। এক দিনে কি দিল্লি জয় করা যায়!
দিল্লিতে প্রচুর টুরিস্ট বাস আছে গোটা শহরের ভ্রমণের জায়গা গুলি ঘোরাবার জন্য। একটু বেশি খরচ করেলে আটো বা সি এন জি ভাড়া করতে পাওয়া যায় আর তার থেকে একটু বেশি খরচ করলে সারা দিনের জন্য গাড়ি ভাড়া করে দেখতে পারেন গোটা শহরটাকে।
আধুনিক দিল্লির শিকড়ে যেতে চাইলে তার মাটির গভীরে একবার প্রবেশ করতেই হবে। পাতাল রেল বা মেট্রো রেল। ভারতে প্রথম মেট্রো রেল কলকাতাতে চালু হলেও দিল্লি মেট্রো অনেক উন্নত।
![Dilli_5 Dilli_5](files/December_2014/December_17/Dilli_5_854971828.jpg)
কুতুব মিনারের আরবি হরফ, লালা কেল্লার দেওয়ালে পাথরের নকশা, চাঁদনি চকের বাজারের ধারে পুরানো দিনের বাড়ির দেওয়াল সব কিছুই আপনাকে আমন্ত্রণ জানাবে ইতিহাসে গভীরে অবগাহন করতে। অন্যদিকে অগুনতি ‘ফ্লাই ওভার’, বিরাট চওড়া রাস্তা, ব্যস্ত মানুষ জন ওয়াইফাই দ্বারা যুক্ত শপিং মল, রেল স্টেশন এক আধুনিক ভারতের ছবি সামনে নিয়ে আসে। দিল্লি ভারতের একমাত্র শহর যেখানে রাস্তার একটি বাঁকে ইতিহাস আপনাকে স্বাগত জানালে পরের বাঁকে আধুনিকতা আপনাকে আমন্ত্রণ করবে।
গান্ধি ঘাট আর লোটাস টেম্পল যেন সনাতন প্রেম, অহিংসা আর ভাতৃত্বের কথা বলে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য লোটাস টেম্পল এমন একটি প্রার্থনার জায়গা যেখানে হিন্দু, মুসলিম ,বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান সকলে একসঙ্গে প্রার্থনা করেন।
অতঃপর ফেরার পথে সংগ্রহ করে আনা দিল্লির লাড্ডু খাওয়া। দিল্লির লাড্ডু বেসনের তৈরি একটি গোটা লাড্ডু মুখে পুরতেই বুঝতে পারলাম কেন দিল্লির লাড্ডু না খেলে পস্তাতে হবে। প্যাকেট খুলতেই গাওয়া ঘি-এর গন্ধ। জিভে পড়ছে এলাচ, পিস্তা আরও বিভিন্ন শুকনো ফলের স্বাদ। এক কথায় এক স্বর্গীয় স্বাদ। এছাড়াও আছে নানা রকম ডালের লাড্ডু। কিন্তু খেলে কেন পস্তাতে হয় সেটা তখনো বুঝিনি।
তাই পরপর বঙ্গ সন্তানের মিষ্টি খাবার ঐতিহ্যটি বজায় রেখে পরপর বেশ কয়েকটি লাড্ডু খেয়ে ফেললাম। খেয়ে পস্তানোর বিষয়টি খানিক পড়ে প্রকাশ পেল। রাতের খাওয়ার কোন প্রশ্নই নেই। কারণ ততক্ষণে বেশ কিছু লাড্ডু খাবার পরে আমার মাছের ঝোল আর ভাত খাওয়া পেট হাড়ে হাড়ে বুঝিয়ে দিচ্ছিল খেয়ে পস্তানো কাকে বলে। আশাকরি পাঠকরাও সেটা বুঝতে পারছেন। এ যাত্রায় কোনরকমে রক্ষা পেলাম গোটা কয়েক হজমের ঔষধের দৌলতে। এবার দিল্লি ছাড়ার পালা । লক্ষ্য পরবর্তী গন্তব্যের দিকে।
বিদায় দিল্লি।
বাংলাদেশ সময়: ০১৪৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৭, ২০১৪