ঢাকা, শুক্রবার, ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১৭ মে ২০২৪, ০৮ জিলকদ ১৪৪৫

দিল্লি, কলকাতা, আগরতলা

টিকিট ব্ল্যাকার ‘নানা’ থেকে ডন ‘ছোটা রাজন’

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৩০ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৬, ২০১৫
টিকিট ব্ল্যাকার ‘নানা’ থেকে ডন ‘ছোটা রাজন’

কলকাতা: ইন্দোনেশিয়ার বালিতে গ্রেপ্তার হয়েছে ভারতের মোস্ট ওয়ান্টেড ‘ডন’ ছোটা রাজন। ভারতে বেশ কিছু খুন, মুম্বাইয়ে ধারাবাহিক বোমা বিস্ফোরণ সহ বিভিন্ন অপরাধের অভিযোগ তার বিরুদ্ধে আছে।

ভারত থেকে পালিয়ে যাওয়া অপরাধীদের মধ্যে রাজন অন্যতম।

তাকে রোমাঞ্চকরভাবে ইন্দোনেশিয়ার বালি থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। তবে রাজনের অপরাধী তথা ‘ডন’ হয়ে ওঠাও বিভিন্ন রোমাঞ্চকর ঘটনার মধ্যে দিয়ে। এক সময়ে দাউদ ইব্রাহীমের পরিচালিত দি-কোম্পানির অন্যতম সাগরেদ এখন দাউদের প্রধান শত্রু। এর পেছনে আছে অনেক লোমহর্ষক ঘটনা, লড়াই, অনেক রক্তপাত ও মৃত্যু।

১৯৮০, মুম্বাইয়ের তিলকনগরের শেখর সিনেমায় পরপর ‘হিট’ সিনেমা, অমিতাভ বচ্চন অভিনীত শান, দোস্তানা, দো আউর দো পাঁচ, দেবানন্দ অভিনীত লুটমার, মিথুন অভিনীত ট্যাক্সি চোর কিংবা কিসমত। এই সমস্ত সিনেমার জন্য দর্শকদের একটা টিকিটের আশায় লম্বা লাইন। কিন্তু কোথায় টিকিট! টিকিট তখন এক জনের পকেটে। সে শেখর সিনেমার পরিচিত ব্ল্যাকার ‘নানা’।

‘ফেল কড়ি মাখ তেল’ আগে থেকে তুলে রাখা টিকিট চড়া দামে বিকতো ‘নানা’র হাত দিয়ে। এই ভাবেই অপরাধ জগতে প্রবেশ করেছিলেন ছোটা রাজন। তবে টিকিট ‘ব্ল্যাক’ করা থেকে শুরু করে ছোটখাটো চুরি সঙ্গে সুযোগ পেলে রেলের ওয়াগন থেকে মালপত্র লুঠ এই ছিল ‘নানা’র কাজ। ৮০-এর দশকের শুরুতে পুলিশের খাতায় ‘নানা’ শুধুমাত্র এক ছিঁচকে চোর।

কথায় বলে জহুরির চোখ হীরে চিনতে ভুল করেনা। সেই রকমই ভুল করেননি ‘বড়া রাজন’। ছোটা রাজনের গুরু। ‘বড়া রাজনের’ অপরাধ ব্যবসায় দরকার ছিল ‘নানা’র মতই একটি বুদ্ধিমান ছেলের। হায়দ্রাবাদে দেখা হয় গুরু আর শিষ্যের, যার বুদ্ধির সঙ্গে আছে সাহস। আর এই বুদ্ধি আর সাহসের মিশেলে খুব তাড়াতাড়ি ‘বড়া রাজন’-এর দলের অন্যতম প্রধান সদস্য হয়ে উঠল রাজেন্দ্র সদাশিব নিখালজি ওরফে ‘ছোটা রাজন’।

‘বড়া রাজন’-এর দলেই সে হাত পাকিয়েছিল খুন, অপহরণ আর অবৈধ পাচারে। ততদিনে অপরাধ জগতের পরিচিত নাম ‘ছোটা রাজন’। শুধু মুম্বাই নয় তখন তার নাম ছড়িয়েছে গোটা ভারতে। এরই মধ্যে খুন হয় ‘বড়া রাজন’। দলের দায়িত্ব হাতে তুলে নেন ‘ছোটা রাজন’।

শোনা যায় অনেককে টপকে দলের নেতা হওয়ার ফলে দলের মধ্যেই বেশ কিছু শত্রু তৈরি করে ফেলেছিলেন ছোটা রাজন। তবে এরপর তাকে আর পিছনে ফিরতে হয়নি। দল যত বড় হয়েছে ততই বেড়েছে ছোটা রাজনের ক্ষমতা। তার কাছে মাথা নুইয়েছে মুম্বাইয়ের বিভিন্ন ছোট-বড় দল। রাজনের সেই সময় একটাই কথা, হয় তার অধিপত্য মেনে নাও না হয় মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে তৈরি থাক।

এই সময় মুম্বাইয়ের সাম্রাজ্য বিস্তারে ব্যস্ত ছিলেন অন্য আরেক ডন দাউদ ইব্রাহীম। তিনি এবং অপর ডন অরুণ গাউলি এবং ছোটা রাজন একসঙ্গে কাজ করতে থাকেন। অপহরণ, খুন, চোরাচালানের সঙ্গে যুক্ত হয় মাদক ব্যবসা। তিন জনের একসঙ্গে কাজ করা ফলে গোটা মুম্বাই চলে আসে ডি-কোম্পানির কব্জায়।

তবে দাউদ আর ছোটা রাজনের সম্পর্ক বেশি দিন ভালো ছিল না। এই ভাঙনের পিছনে নানা ধরনের খবর শোনা যায় মুম্বাইয়ের অলিতে গলিতে। শোনা যায় এর পেছনে নাকি ক্ষমতার লোভ ছিল মূল কারণ। জানা যায় একটি মাদক চোরাচালানের সময় অরুণ গাউলির ভাই পাপা গাউলি খুন হন। সন্দেহের তীর যায় ছোটা রাজনের দিকে। শুরু হয় ভাঙন।

আরও শোনা যায় সত্য, ছোটা শাকিল ও শারদ তখন ডি-কোম্পানির হয়ে মুম্বাই কাঁপাচ্ছে। তারা নাকি দাউদের কাছে ছোটা রাজনের নামে ক্রমাগত অভিযোগ করতে থাকে। এছাড়াও আরও কয়েকটি কারণের কথাও শোনা যায়। তবে কারণ যাই হোক নতুন দল গঠন করে ছোটা রাজন।

আর এখান থেকেই শুরু হয় দাউদ আর রাজনের শত্রুতা। এই সময় আকছার খবর আসতে লাগে দুই দলের লড়াইয়ের। এই সময় রাজন দাউদের ডান হাত ‘মাদক সন্ত্রাসী’ বলে কুখ্যাত পাল্লু খান ওরফে বক্তিয়ার আহমেদ খানকে হত্যা করে। এর বদলা নিতে ব্যাঙ্ককের হোটেলে রাজনের উপর হামালা চালায় দাউদ ঘনিষ্ঠ ছোটা শাকিল। কোন রকমে প্রাণে বেঁচে যান ‘ছোটা রাজন’। এই আক্রমণে শিরদাঁড়ায় চোট পান রাজন। জানা যায় দোতলার জানালা দিয়ে লাফিয়ে তিনি প্রাণ বাঁচান।

কিন্তু এখানেই রক্তের বন্যার সমাপন নয়। রাজনের হাতে খুন হতে হয় একাধিক দাউদ ঘনিষ্ঠদের। শোনা যায় এই সময় থেকে দাউদের ব্যবসাতে ভাগ বসায় রাজন। অভিযোগ রাজনের অর্থ ব্যবহার করা হয়েছে বলিউডের নানা সিনেমায়।

আরও জল্পনা শোনা যায় বিভিন্ন ‘গ্যাং’-এর সঙ্গে শত্রুতার বিষয়টিকে কাজে লাগিয়ে কখন কখনও নাকি গোয়েন্দা, এবং পুলিশও ছোটা রাজনকে তাদের কাজে লাগিয়েছে। তবে এই বিষয়ে কোন প্রামাণ্য তথ্য কোন দিনই পাওয়া যায় নি।

তার চরিত্রকে কেন্দ্র একাধিক সিনেমা তৈরি হয়েছে বলিউডে। ১৯৯৯ সালে ‘বাস্তব’ সিনেমায় সঞ্জয় দত্তের চরিত্রটি ‘ছোটা রাজন’ এর মতো করে নির্মাণ করা হয়েছিল বলে শোনা যায়। ২০০২ সালে ‘কোম্পানি’ সিনেমার মূল চরিত্র ‘চান্দু’ আসলে ছোটা রাজনকেই কল্পনা করা তৈরি করা হয়েছিল বলেও জানা যায়।

গত জুলাই মাসে খবর পাওয়া গিয়েছিল ছোটা রাজন অস্ট্রেলিয়ায় অবস্থান করছে। এমন কি এই খবরও পাওয়া গিয়েছিল সেখানে ছোটা শাকিলের লোকজনের সঙ্গে রাজনের লোকজনের লড়াই হয়। খবর পাওয়া যাচ্ছিল দাউদ এবং ছোটা শাকিল তাদের পুরানো শত্রু ছোটা রাজনকে তার দলবল সমেত খতম করে দেবার পরিকল্পনা করেছে। আরও খবর পাওয়া যাচ্ছিল ছোটা রাজনের শারীরিক অবস্থা ভালো নয়। শারীরিক অসুস্থতার খবর যে সঠিক ছিল সে কথা বোঝা যায় তার ধরা পড়ার সময় শারীরিক অবস্থা দেখে।

রাজন বুঝতে পেরেছিল অস্ট্রেলিয়া তার পক্ষে আর নিরাপদ নয়। তাই সে অস্ট্রেলিয়ার নিউক্যাসেল থেকে পালিয়ে সেই দেশেরই গোপন কোন জায়গায় আত্মগোপন করে। সম্ভবত লুকিয়ে থাকতেই সে ইন্দোনেশিয়ায় পাড়ি দেবার চেষ্টা করেছিল। সেখানেই তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।

বাংলাদেশ সময়: ১৮৩০ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৬,২০১৫
ভি.এস/আরআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।