ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

এনজিওর তহবিলেও সংকটের ধাক্কা, ছ’মাসে কমেছে ৭৬ শতাংশ

জাফর আহমদ, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২২৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৫, ২০২৩
এনজিওর তহবিলেও সংকটের ধাক্কা, ছ’মাসে কমেছে ৭৬ শতাংশ

ঢাকা: বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার (এনজিও) মাধ্যমে আসা অর্থের প্রতিশ্রুতিতেও লেগেছে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটের ধাক্কা। কমে গেছে এনজিওর তহবিল সরবরাহে দাতাদের প্রতিশ্রুতি।

 

এনজিওর মাধ্যমে সহায়তার ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক বিদেশি দাতাদের প্রতিশ্রুতির তথ্য পর্যালোচনা করে এমন তথ্য মিলছে। এনজিও ব্যুরো এ তথ্য প্রকাশ করে।

প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর ছয় মাসে ৯৪৭টি প্রকল্পের বিপরীতে ২ হাজার ৯৮৬ কোটি ৭২ লাখ টাকার সহায়তা প্রতিশ্রুতি এসেছে। এ প্রতিশ্রুতি ও প্রকল্প গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ঢের কম।  

২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম ছয়মাসে ১ হাজার ৩০ প্রকল্পের বিপরীতে প্রতিশ্রুতি এসেছিল ৪ হাজার ৩৮৪ কোটি ৮ লাখ ৪৫ হাজার ৫৭৫ টাকা। পুরো বছরে ২ হাজার ৬১টি প্রকল্পের বিপরীতে ৮ হাজার ৭৬৮ কোটি ১৬ লাখ ৯১ হাজার ১৫০ টাকা সহায়তা প্রতিশ্রুতি পাওয়া যায়। অর্থাৎ প্রতিশ্রুতি হ্রাসের হার ৭৬ শতাংশ।

এনজিওর মাধ্যমে সহায়তা বা স্বল্প সুদের ঋণ হিসেবে আসা তহবিলের প্রতিশ্রুতির বিগত বছরগুলোর তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, প্রতিবছরই তহবিল সরবারহে প্রতিশ্রুতি বেড়েছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে প্রতিশ্রুতি ছিল ৪৯১৫ কোটি ৮০ লাখ টাকার; ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৭০২২ কোটি ৯০ লাখ টাকা; ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৯১১৮ কোটি ৩৬ লাখ টাকা; ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৭৫৫৯ কোটি ৬৪ লাখ টাকা এবং ২০২০-২১ অর্থবছরে ৮৪৫৫ কোটি ২০ লাখ টাকার প্রতিশ্রুতি এসেছিল।  

২০১৭ সালের শেষের দিকে মিয়ানমারে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতির শিকার হলে সেখানকার রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে পাড়ি জমায়। সে সময় বাংলাদেশের পাশাপাশি বিশ্ব সম্প্রদায়ও এগিয়ে আসে। এর প্রভাবে এনজিওর মাধ্যমে তহবিলের প্রতিশ্রুতি অস্বাভাবিক হারে বাড়ে।

শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, রিলিফ ও পুনর্বাসন, পানি ও পয়:নিষ্কাশন, মানবাধিকার, সামাজিক উন্নয়ন, সুশাসন, স্থানীয় সরকার, খাদ্য, মৎস্য, নারী উন্নয়ন, পরিবেশ, যুব উন্নয়ন, দুস্থ সহায়তা, আইন সহায়তা, শিশু, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, বনায়ন, পল্লী উন্নয়ন, তথ্য ও প্রযুক্তি, জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলা, শ্রম পরিস্থিতি উন্নয়ন, তথ্য প্রযুক্তি, তৈরি পোশাক সহ অর্ধশতাধিক খাতে সহায়তর জন্য বৈদেশিক সহায়তা দেশে এসে থাকে।  

২০১৭ সালে রোহিঙ্গারা দেশে প্রবেশ শুরু করলে এ সহায়তা অস্বাভাবিকভাবে বাড়ে। পরের বছরগুলোতে এই হার স্বাভাবিক হয়ে যায়। কিন্তু চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয়মাসে এনজিওর মাধ্যমে সহায়তার প্রতিশ্রুতি কমে যাওয়ার বিষয়টি অস্বাভাকি।

এনজিও ব্যুরোর সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়া এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে শরণার্থী সামাল দিতে পশ্চিমের দেশগুলোতে মনোযোগের নতুন জায়গা তৈরি হয়েছে। এতে বাংলাদেশের সহায়তার প্রতিশ্রুতি কমেছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ অব্যাহত থাকলে সহায়তা প্রতিশ্রুতি আরও কমে আসতে পারে।

বৈদেশিক তহবিলের প্রতিশ্রুতি হ্রাসের প্রভাব মাঠ পর্যায়ে পড়েছে বলে জানান শ্রম অধিকার বিষয়ক সংগঠক ও বাংলাদেশ সেন্টার ফর ওয়ার্কার সলিডারিটির (বিসিডব্লিউসি) নির্বাহী পরিচালক কল্পনা আক্তার।  

এ বিষয়ে তিনি বাংলানিউজকে বলেন, যুদ্ধের ফলে বিশ্বজুড়ে মূল্যস্ফীতি ঘটেছে। প্রভাব পড়েছে দেশে দেশে। এমন মানুষ নেই যার জীবন নির্বাহের খরচ বাড়েনি। এতে দাতাদের তহবিলেও প্রভাব পড়েছে; রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সহায়তার নতুন ফ্রন্টে মনোযোগ দিতে হয়েছে।

করোনা মহামারীর কারণে এমনিতেই দাতাদের সহায়তার প্রতিশ্রুতিতে টান পড়ে যায়। তহবিলের প্রতিশ্রুতি দেওয়ার ক্ষেত্রে তারা সময় নিচ্ছিলো। তার ওপর যুদ্ধের কারণে দেশে দেশে অর্থনীতে সংকট তৈরি হওয়ার কারণে তহবিলের প্রতিশ্রুতিতে টান দৃশ্যমান হয়েছে। যদি যুদ্ধ অবস্থা বিরাজমান থাকে, দেশে দেশে উৎপাদন, সরবারহ, বিপণন ক্ষতিগ্রস্ত হয়, উদ্বাস্তুদের সহায়তা দেওয়ার পরিধি বাড়তে থাকে তাহলে তহবিলের প্রতিশ্রুতি এবং তহবিল সবরারহ দুটোই পাল্লা দিয়ে কমবে, যোগ করেন তিনি।

স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে দারিদ্র পীড়িত মানুষের কর্মসৃজন, মানবাধিকার উন্নয়ন, স্বাস্থ্য, শিক্ষাতে সহায়তার মতো খাতে বৈদেশিক সহযোগিতা আসে। বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে রুপান্তর হচ্ছে- এমন খবরে বিদেশি দাতারা এনজিওর মাধ্যমে সহায়তা কমিয়ে অন্য দেশে স্থানান্তরে ইতোমধ্যে কথা বার্তা শুরু করেছে। এর মধ্যে যোগ হয়েছে করোনা মহামারী ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ।

কল্পনা আক্তার বলেন, আগামী বছর শেষে বাংলাদেশ যদি স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে যাত্রা শুরু করে, তখন সহায়তার প্রতিশ্রুতি কিভাবে কমবে তা টের পাওয়া যাবে।   

করোনা মহামারী সামলে নিতে ২০২১ সালের দিকে যখন অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার কার্যক্রম শুরু হয়, তখন উৎপাদনের তুলনায় চাহিদা বেশি হারে বাড়ে। একই সময়ে পণ্য সরবরাহে বিশ্বজুড়ে জট তৈরি হয়, বৃদ্ধি পায় পরিবহন খরচ। এতে আমদানি ব্যয় কিছুটা বৃদ্ধি পায়। প্রভাব পড়ে পণ্য মূল্যে। কিন্তু ২০২২ সালে ফেব্ররুয়ারির শেষের দিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। করোনার পূর্বে যে পণ্য ১০০ টাকায় আমদানি করা যেত, যুদ্ধের পরে তা থেকে ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। এ সংকট মূলত বৈশ্বিক সংকটের প্রভাব।

অর্থনীতিবিদ ও অ্যাক্টিভিস্টরা বলছেন, একই সংকট দেখা দিয়েছে এনজিও তহবিলের প্রতিশ্রুতিতেও। যেহেতু দাতা প্রতিষ্ঠান ও প্রতিষ্ঠানে সহায়তাকারী দেশগুলোর অর্থনীতিতে অস্থিরতা বিরাজ করছে, এ কারণেই বাংলাদেশের এনজিওর তহবিল দেওয়ার প্রতিশ্রুতিতে নিম্নমুখি অবস্থা তৈরি হয়েছে। এ পরিস্থিতির উন্নতি দেখতে হলে রাশিয়া-ইউরোপ যুদ্ধ অবস্থার পরিবর্তন পূর্বক অর্থনীতি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে হবে।  

বাংলাদেশ সময়: ১১৫৩ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৫, ২০২৩
জেডএ/এনএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।