ঢাকা, শনিবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

৫৫০ টাকা কেজির জিরা এক মাসের ব্যবধানে ৯০০! 

ইফফাত শরীফ, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৩২ ঘণ্টা, মে ২০, ২০২৩
৫৫০ টাকা কেজির জিরা এক মাসের ব্যবধানে ৯০০! 

ঢাকা: বাজারে বেশির ভাগ পণ্যের দামই সাধারণ ক্রেতার নাগালের বাইরে। এর ব্যতিক্রম না মসলার বাজারও।

কয়েক দিনের ব্যবধানে জিরার দাম কেজিপ্রতি ২০০- ৩০০ টাকার মতো বেড়ে খুচরা পর্যায়ে বিক্রি হচ্ছে ৮০০ থেকে সর্বোচ্চ ৯০০ টাকায়। যা রোজার ঈদের আগেও ছিল ৫৫০-৬৫০ টাকা।

সামনে কোরবানির ঈদ, এজন্য মাংসে ব্যবহৃত অতি প্রয়োজনীয় এই পণ্যটি এখন মসলা ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে দাম বাড়াতে শুরু করেছেন। তা না হলে দেখতে দেখতে মসলার দাম এতটা বেড়ে খুচরা পর্যায়ে সর্বোচ্চ ৯০০ টাকা হয়ে যায় কী করে এমন প্রশ্ন বেশিরভাগ সাধারণ মানুষের।

জিরার দাম বাড়ার বিষয়টি উঠে এসেছে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্যেও। সংস্থাটি বলছে, বাজারে গত এক মাসের ব্যবধানে জিরার দাম ২৭ দশমিক ৬৯ শতাংশ বেড়েছে। আর বছরের ব্যবধানে দাম বেড়েছে প্রায় ৮৮ দশমিক ৬৪ শতাংশ।  

গত বছর এ সময়ে প্রতি কেজি জিরার দাম ছিল ৪০০ থেকে ৪৮০ টাকা। যা এখন ৮০০ থেকে ৮৬০টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু কিছু কিছু খুচরা বাজার এবং মুদি দোকানে এই জিরা ৯০০ টাকায় বিক্রি হতেও দেখা গেছে। ইদানিং মসলা জাত পণ্যের মধ্যে দাম বাড়ার তালিকা শীর্ষে আছে দেশি ও আমদানি করা আদা। আর বাজারে দাম বাড়া পণ্যের দিক থেকে পেঁয়াজকে হার মানিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে জিরা।  

শনিবার (২০ মে) রাজধানীর কাওরানবাজার, খিলগাঁও বাজার, মালিবাগ বাজারসহ বেশ কয়েকটি বাজার ঘুরে এবং পাইকারি ব্যবসায়ী ও আমদানি কারকদের সঙ্গে কথা বলে জিরার দাম বাড়ার এমন তথ্য পাওয়া গেছে।

পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশের বাজারে যত ধরনের জিরা আছে তা বেশির ভাগই আমদানি করা হয়। চাহিদা বাড়া বা বাজারে জিরার সংকটের চেয়ে জিরার দাম বাড়ার পেছনে আন্তর্জাতিক বাজার ও ডলারের দামকে বেশি দায়ী করছেন তারা। পাশাপাশি ভারত থেকে বেশি দামে জিরা আমদানি করতে হচ্ছে। দাম বাড়ায় জিরার আমদানি আগের থেকে অনেক কমে গেছে। ফলে খুচরা পর্যায়ে জিরার দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে।  

কাওরানবাজারের গরম মসলা ব্যবসায়ী আসাদ শেখ রোজার ঈদের আগে প্রতি কেজি জিরা বিক্রি করতেন ৫৫০-৬০০শ টাকায়। এখন এই মসলা বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৮০০-৮৫০ টাকা। তিনি একশ গ্রামের প্যাকেটে জিরা বিক্রি করছেন ৮৫ টাকা দরে।

শাহাজানপুরের রেলওয়ে সুপার মার্কেটের মসলা ব্যবসায়ী মো. ইয়াসিন বাংলানিউজকে বলেন, আমরা চকের থেকে মসলা কিনে এনে বিক্রি করি। সব ধরনের মসলার দামই বেশি। দাম বাড়ার কারণ জিজ্ঞাসা করলে পাইকারি ব্যবসায়ীরা কিছু বলেন না। তাই যে মসলা দাম বেশি থাকে সেগুলো কিনি না। এক মাস আগেও জিরা ৫৯০ টাকায় কিনেছি। আর এখন সেই জিরা পাইকারি বাজার থেকে কিনতে হচ্ছে ৭৭০-৭৮০ টাকা কেজিতে। যে কারণে খুচরা বাজারেও জিরার দাম বেড়েছে।

মসলা আমদানি কারক এবং বাংলাদেশ গরম মসলা ব্যবসায়ী সমিতির কার্যনির্বাহী সদস্য মো. রুবেল বাংলানিউজকে বলেন, বর্তমান বাজারে আমদানি করা ভারতীয় জিরা দাম পাইকারিতে চলছে ৭৭০-৭৮০ টাকা। বর্তমানে শুধু ভারত থেকেই জিরা আমদানি হচ্ছে। অন্য কোনো দেশ থেকে আমদানি হয় না। আগে ইরান, সিরিয়া এবং তুরস্ক থেকে জিরা আমদানি হতো। একচেটিয়া বাজার পেলে যা হয় সেটা ভারতের জিরার ক্ষেত্রেও হয়েছে।

ভারতের জিরার বুকিং বেশি এবং দামও বেশি। সে কারণে ব্যবসায়ীরা জিরা কিনতে আগ্রহ কম দেখাচ্ছেন বলে মনে করছেন এই আমদানিকারক। ইন্ডিয়ান জিরার পাশাপাশি অন্য দেশের জিরা বাজারে উঠলে দাম কমে যাবে বলেও জানান তিনি।

এক থেকে দুই মাস পর বাজারে ইরান, সিরিয়া এবং তুরস্ক থেকে জিরা আসবে উল্লেখ করে জিরার আমদানিকারক মো. রুবেল বলেন, জিরা যেহেতু একটি ফসল। তাই ওসব দেশের জিরার কৃষকরা কিছুদিন পর থেকে ফসল ওঠানো শুরু করবে। তারপর তারা মার্কেটে রেট দেবে। এ জিরা অগাস্ট-সেপ্টেম্বর নাগাদ দেশের বাজারে পাওয়া যাবে। তারপর থেকে আশা করি বাজারে জিরার দাম কমতে থাকবে।

অর্থাৎ আমদানি কারকদের কথায় বোঝা যাচ্ছে যে আপাতত কোরবানির ঈদের আগে জিরার দাম তেমন একটা কমার সযোগ নেই। যদিও কোরবানিতে এই মসলাটির চাহিদা থাকে ব্যাপক। তাই এই মুহূর্তে জিরার দাম মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে যাওয়াতে সাধারণ ক্রেতারা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।

ফার্মগেট রাজা বাজারের বাসিন্দা গৃহিণী রত্না আক্তার শনিবার কাওরান বাজার এসেছিলেন পরিবারের জন্য প্রয়োজনীয় মসলা কিনতে। কিন্তু সব ধরনের মসলার দাম বেড়ে যাওয়ায় যতটুকু প্রয়োজন ছিল সেই পরিমাণ মসলা কিনতে পারেননি। জিরার দাম নিয়ে কথা হলে রত্না আক্তার বাংলানিউজকে বলেন, তরকারি রান্নার ক্ষেত্রে জিরার ব্যবহার কম হলেও সামনে কোরবানি আসছে জিরা ছাড়া মাংস রান্না প্রায় অসম্ভব। কেন এগুলোর দাম বাড়ে আমার জানা নেই। তবে যদি দাম বেশি থাকে তখন হয়তো কম পরিমাণ করে নিতে হবে। যাতে করে অন্যান্য পণ্যও কেনা যায়।

বাংলাদেশ পাইকারি গরম মসলা ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি ও মসলার আমদানিকারক মো. এনায়েত উল্লাহ বাংলানিউজকে বলেন, এ বছর জিরার দাম পাইকারিতে ৮০০ টাকা পর্যন্ত সর্বোচ্চ উঠেছিল। বর্তমানে কিছুটা কমে ৭৬০ টাকার মধ্যে চলে এসেছে।

যদিও খুচরা বাজারে কোথাও কোথাও জিরা বিক্রি ৮৫০-৯০০ টাকায়। সেই হিসাবে খুচরা মসলার ব্যবসায়ীরা কী দাম বেশি রাখছেন কি না এমন প্রশ্ন করলে মসলা ব্যবসায়ী সমিতির এই সভাপতি বলেন, খুচরা বাজারের কথা তো-আর আমরা তেমনভাবে বলতে পারব না। কারণ তারা অল্প অল্প বিক্রি করেন। তাদেরও তো লাভের প্রয়োজন আছে। সর্বনিম্ন ১০ শতাংশ লাভ তো তারা (খুচরা ব্যবসায়ীরা) করবেনই।

জিরার দাম আন্তর্জাতিক বাজারে অনেক বেশি উল্লেখ করে এই আমদানিকারক বলেন, আমরা ইন্ডিয়ার ওপরে নির্ভরশীল ছিলাম। আন্তর্জাতিক বাজারে তখন সিরিয়া, ইরান আফগানিস্তান এবং তুরস্কের মতো দেশর উৎপাদিত জিরা ছিল না। অবশ্য নতুন করে ফসল হওয়াতে সামনে এসব দেশ থেকেও মসলা আসবে। জিরার জুন শিপমেন্টে পাঁচ হাজার ডলারের ওপর আছে। সেগুলো এলে জিরার দাম আস্তে আস্তে কমবে। এ জিরা আগস্ট নাগাদ আমাদের দেশের বাজারে পাওয়া যাবে।

বাংলাদেশে প্রতিবছর কী পরিমাণ জিরা আমদানি করা হয় এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ পাইকারি গরম মসলা ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি ও মসলার আমদানিকারক মো. এনায়েত উল্লাহ  বলেন, কী পরিমাণ জিরা আমদানি হয় এর সঠিক ডাটা আছে বাংলাদেশ ব্যাংক এবং কাস্টমসের কাছে। তবে আমরা যারা আমদানিকারক আছি আমাদের হিসাবে বছরে আনুমানিক প্রায় দশ হাজার টন জিরা আমদানি করা হয়।

আমদানির ক্ষেত্রে নানা ধরনের জটিলতায় পড়তে হয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমদানির ক্ষেত্রে প্রথমত শতভাগ মার্জিন দিতে হয়। দ্বিতীয়ত ব্যাংকে পর্যাপ্ত পরিমাণ ডলার নেই। এই ডলারের জন্য অনেক সিরিয়ালে থাকতে হয়। দেখা গেছে যে আবেদনপত্র সাবমিট করে রাখতে হয়, তারপর ডলার যদি ব্যবস্থা হয় তখন আমদানি করতে পারি। এই সবগুলোই হচ্ছে কমন সমস্যা।

রোজার ঈদের সময় মসলার বাজার একটু পড়তির দিকে ছিল জানিয়ে তিনি বলেন, দাম বাড়ার আরেকটা কারণ হচ্ছে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন। আমদানির ক্ষেত্রে ডলারের বিপরীতে টাকার প্রায় ৩০ শতাংশ অবমূল্যায়ন হয়েছে। পাশাপাশি শতভাগ ডিউটি যে পণ্যগুলা সেগুলোতেও ৩০ শতাংশ মূল্য বেড়েছে। যদিও জিরার ক্ষেত্রে আমাদের ডিউটি হচ্ছে ৬৩ শতাংশ।

মো. এনায়েত বলেন, আমাদের দেশে যে সব পণ্য আমদানি হয় সেগুলো ডলারে ট্যারিফ করা। তাই ডলারের ক্ষেত্রে পূর্বের যে ট্যারিফ ছিল সে অনুযায়ী বর্তমানে পণ্যের মূল্যায়ন হচ্ছে। আগে এক ডলার কনভার্ট হতো ৮২- ৮৪ টাকায়। আর সেটা বর্তমানে হচ্ছে এক ডলার সমান ১১০ টাকা। অর্থাৎ যেসব পণ্যের ডিউটি শতভাগ সেটা আগে আমদানি করতে লাগত ৮৪ হাজার টাকা লাগলে এখন সেটা লাগছে এক লাখ দশ হাজার টাকা। সে হিসাবে ডলারের সঙ্গে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে প্রায় ৩০ শতাংশের বেশি। তার ওপর এখানেও আবার ২৫ শতাংশের মতো ডিউটি যোগ হয়। অর্থাৎ আমদানির ক্ষেত্রে সব মিলিয়ে টাকার অবমূল্যায়ন এবং ডিউটির কারণে ৫০ শতাংশ দাম বেড়ে যায় পণ্যের। জিরার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে।

আর সরকার যদি এসব পণ্যের দাম কমাতে চায় তাহলে যে ২৫ শতাংশ ডিউটি নিচ্ছে সেটা কমাতে হবে বলে মনে করছেন এনায়েত উল্লাহ।

বাংলাদেশ সময়: ১৭২৭ ঘণ্টা, মে ২০, ২০২৩
ইএসএস/এসআইএস 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।