বিভিন্ন সময় দেশ থেকে পাচার হওয়া টাকা ফেরাতে অনেক ঢাকঢোল পেটালেও কাজ এগিয়েছে খুবই সামান্য। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, জিএফআই, এডিবিসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা সহায়তার কথা জানালেও বাস্তবে এসবের অগ্রগতি উল্লেখ করার মতো নয়।
গত ৫ আগস্ট স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এ সংক্রান্ত গঠিত কেন্দ্রীয় টাস্কফোর্স পুনর্গঠন করা হয় গত ২৯ সেপ্টেম্বর। যার প্রধান করা হয় বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে। এরপর দুটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। সর্বশেষ ১৯ নভেম্বর একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। এদিকে আজ বিকাল ৪টায় বাংলাদেশ ব্যাংকে এই টাস্কফোর্সের তৃতীয় সভা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে।
এর আগে আওয়ামী লীগ সরকার পাচারের টাকা ফেরাতে লোক দেখানো নানা কার্যক্রমের কথা বললেও বাস্তবে ফেরত আনতে পারেনি এক টাকাও। এমন কি পদত্যাগী আওয়ামী লীগ সরকারের তৃতীয় মেয়াদের শেষ অর্থবছরে (২০২৩-২৪) ৭ শতাংশ কর দিয়ে বাংলাদেশের বাইরে যে কোনো রূপে গচ্ছিত অপ্রদর্শিত অর্থ ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে বৈধভাবে দেশে এনে আয়কর রিটার্নে দেখানোর সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। সে সুযোগ কোনো কাজে লাগেনি, এমন কি এ সময়ে এক টাকাও ফেরত আসেনি।
সেই সরকার পতনের পর ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয় গত ৮ আগস্ট। এরপর টানা ১৬ বছরের ঘুষ-দুর্নীতি, অন্যায়-অনিময়, লুটপাট ও টাকা পাচারের মতো মহাদুর্নীতির খবর বেরিয়ে আসে। উন্নয়নের নামে লাখ লাখ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে বিদেশে পাচার করা হয়। এসব অনিয়ম-দুর্নীতি, লুটপাট ও পাচারের বিষয়ে অর্থনীতির একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করে অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি।
একইসঙ্গে পাচারের অর্থ ফেরাতে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে যোগাযোগও করছে সরকার। তবে এর জন্য কার্যকর কোনো কর্মকৌশল এখনো ঠিক করতে পারেনি। যদিও এর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে পুনর্গঠিত টাস্কফোর্সকে। পাচারবিরোধী সবচেয়ে বড় সংস্থা গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটিকেও আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো চিঠি দিতে পারেনি সরকার। বিশ্বব্যাপী পাচারকারীদের সবচেয়ে নিরাপদ ব্যাংক হিসেবে পরিচিত সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকেও (এসএনবি) আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো চিঠি দেওয়া সম্ভব হয়নি।
জানা গেছে, ২৯ সেপ্টেম্বর পুনর্গঠিত টাস্কফোর্সের কার্যপরিধি বাড়ানো হয়েছে। এত দিন কার্যপরিধিতে তিনটি বিষয় থাকলেও এবার করা হয়েছে ছয়টি। এগুলো হলো বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ বা সম্পদ চিহ্নিত করা। পাচার করা সম্পদ উদ্ধারে হওয়া মামলাগুলোর কার্যক্রম দ্রুত নিষ্পত্তি করার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতাগুলো চিহ্নিত করা ও তা দূর করার উদ্যোগ নেওয়া। বিদেশে পাচার করা অর্থ ফেরত আনার উদ্যোগ নেওয়া।
জব্দ বা উদ্ধার সম্পদের ব্যবস্থাপনার জন্য উদ্যোগ নেওয়া। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দেশ, বিদেশি সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ ও তথ্য আহরণ করা এবং পাচার করা সম্পদ উদ্ধারে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধি ও অভ্যন্তরীণ সমন্বয় সাধন করা। টাস্কফোর্সের সদস্য পুলিশের সিআইডি শাখার প্রধান ও অতিরিক্ত আইজিপি মো. মতিউর রহমান শেখ বলেন, এ-সংক্রান্ত টাস্কফোর্স কাজ করছে। তবে দৃশ্যমান অগ্রগতির জন্য আরেকটু সময়ের প্রয়োজন হবে।
রোববার বিকাল ৪টায় বাংলাদেশ ব্যাংকে এ টাস্কফোর্সের তৃতীয় সভা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, টাকা ফেরত আনার সব সম্ভাবনা ও বাধাকে সামনে রেখে কাজ করছে টাস্কফোর্স। এর অংশ হিসেবে আজকের বৈঠকে একটি কর্মকৌশলও চূড়ান্ত হওয়ার কথা রয়েছে। বৈঠকে একটি প্রেজেন্টেশনও দেওয়া হবে। একই সঙ্গে যেসব দেশে বাংলাদেশি অর্থ পাচার করা হয়েছে সেসব দেশের সঙ্গে কেস-টু কেস ভিত্তিতে যোগাযোগ করা হবে। এ জন্য সুইস ন্যাশনাল ব্যাংক, জিএফআই ও বিশ্বব্যাংকের সহায়তা নেওয়ার কথা জানানো হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, পাচারের অর্থ ফেরত আনা খুবই জটিল ও লম্বা প্রক্রিয়া। এটা যে দেশে পাচার হয়েছে সে দেশেরও সহযোগিতা লাগবে। সেখানেও বিচার হতে হবে। তবে এখন যেহেতু একটা বিশেষ সরকার ক্ষমতায় আছে। এ কাজে তৎপরতাও দেখাচ্ছে। এর প্রতি বিশ্ববাসীর সমর্থনও আছে ফলে আশা যায় টাকা ফেরতে ইতিবাচক কিছু হবে। তবে বিশ্বব্যাপী পাচারকৃত অর্থের ফেরতের পরিসংখ্যান খুবই কম। আপনি হয়তো জানেন অনুন্নত দেশগুলো থেকে মোট পাচার হওয়া অর্থের মাত্র ১ শতাংশ ফেরত আনা সম্ভব হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, আমাদের এখান থেকে পাচার হয়েছে এটা শুধু আমাদেরই ব্যর্থতা বা অপরাধ নয়, এটা সে দেশেরও ব্যথর্তা যে দেশে টাকাটা গেছে। এ ছাড়া এ-সংক্রান্ত যে টাস্কফোর্স করা হয়েছে সে টাস্কফোর্সের প্রধান হওয়া উচিত অ্যাটর্নি জেনারেল অফিস। কেননা এগুলো আইন ও বিচার-সংক্রান্ত কাজকর্ম। ফলে এটার প্রধান দায়িত্ব যে, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে দেওয়া হয়েছে সেটার সংশোধন হওয়া দরকার বলে তিনি মনে করেন।
ড. ইউনূস সরকারপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর শেখ হাসিনার টানা তিন মেয়াদের যে শ্বেতপত্র প্রকাশ করে তাতে দুর্নীতি ও টাকা পাচারের ভয়াবহ চিত্র উঠে আসে। গত ১ ডিসেম্বর শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে প্রতিবেদন হস্তান্তর করে। এতে উল্লেখ করা হয়, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে, ২০০৯ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ২৩ হাজার ৪০০ কোটি ডলার বিদেশে পাচার হয়েছে। বর্তমান বাজার দরে (প্রতি ডলারের দাম ১২০ টাকা) এর পরিমাণ ২৮ লাখ কোটি টাকা। এই হিসাবে প্রতি বছর গড়ে ১ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে।
শ্বেতপত্র প্রতিবেদনের তথ্য আমলে নিয়ে টাস্কফোর্সের দ্বিতীয় সভার কার্যবিবরণীতে বলা হয়েছে, গত কয়েক বছরে অর্থ পাচার বাংলাদেশে উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রতিবছর মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৩ দশমিক ৪ শতাংশের পরিমাণ অর্থ পাচার হয়েছে। এ ছাড়া ২০২৩-২৪ অর্থবছরে রপ্তানি আয় ও প্রবাসী আয় থেকে যত অর্থ এসেছে, এর এক-পঞ্চমাংশ পরিমাণ অর্থ এক বছরে পাচার হয়। বিদেশি ঋণ ও বিনিয়োগ হিসেবে যত অর্থ আসে, এর দ্বিগুণ পরিমাণ অর্থ পাচার হয়। এদিকে পাচার হওয়া অর্থ ফেরাতে টাস্কফোর্সকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সব ধরনের সহায়তা দেওয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে।
সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন
বাংলাদেশ সময়: ০৯৪৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৫, ২০২৫
নিউজ ডেস্ক