ঢাকা, রবিবার, ২৮ পৌষ ১৪৩১, ১২ জানুয়ারি ২০২৫, ১১ রজব ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

ভ্যাটের চাপে জনগণ কাঁপে

নিউজ ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭০০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১২, ২০২৫
ভ্যাটের চাপে জনগণ কাঁপে

ঢাকা: আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন বৃদ্ধিতে নাভিশ্বাস ওঠার উপক্রম হয় দেশের মানুষের। জুলাই বিপ্লবে হাসিনা সরকারের পতনের পর জনগণ আশা করেছিল- অন্তর্বর্তী সরকার কঠোর হাতে বাজার নিয়ন্ত্রণ করবে।

কমবে নিত্যপণ্যের দাম।  

কিন্তু সে আশায় গুঁড়েবালি বলা যায় এখনও। তদারকি ও মনিটরিং করেও সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য থামানো যাচ্ছে না। সিন্ডিকেট ভাঙতে না পারায় বাজারের অস্থিরতা কাটছে না। এমন পরিস্থিতিতে খেটে খাওয়া মানুষ সীমাহীন দুর্ভোগে পড়েছেন। নিম্ন আয়ের মানুষদের ‘নুন আনতে পান্তা ফুরায়’ অবস্থা।

এরই মধ্যে ‘মরার ওপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে এসেছে বিভিন্ন পণ্য ও সেবায় মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) বৃদ্ধি।  

সম্পূরক ও আবগারি শুল্ক বৃদ্ধির সিদ্ধান্তে শতাধিক পণ্য ও সেবার দাম বাড়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। এতে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা আরও কমে যাবে। মোবাইল ফোন সেবার ওপর সম্পূরক শুল্ক বৃদ্ধির ফলে কথা বলা ও ইন্টারনেট ব্যবহারের খরচ বাড়বে। ভ্যাটের চাপে নিশ্চিতই ভোক্তাদের দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার অবস্থা হবে। মুদ্রাস্ফীতি বাড়বে। নতুন করে সংকটে পড়বে ব্যবসাবাণিজ্য; যার নেতিবাচক প্রভাব পৌঁছাবে জাতীয় অর্থনীতি পর্যন্ত। ভ্যাটের চাপে জনগণ কাঁপছে এখন।

নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের সাজসাজ রবে যখন জনগণের প্রত্যাশা আকাশছোঁয়া- এমন একটা সময়ে ভ্যাট নিয়ে এ সিদ্ধান্ত বিবেচনাপ্রসূত হয়নি বলে মন্তব্য অর্থনীতিবিদদের।

তারা বলছেন, সম্পূরক ও আবগারি শুল্ক বৃদ্ধির সিদ্ধান্তে সামগ্রিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগেও বিরূপ প্রভাব পড়বে। কর্মসংস্থানের সুযোগ সংকুচিত হবে। রাজনৈতিক অস্থিরতায় ব্যবসায়-বিনিয়োগে এমনিতেই নেতিবাচক ধারা চলছে, ভ্যাট সংযোজিত হলে তা আরো জটিল করে তুলবে। ব্যবসায় পরিস্থিতি আরো সংকটে পড়বে।  

বিশ্লেষকদের মতে, আইএমএফ-এর সঙ্গে আলোচনার সময় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দরকষাকষিতে অদক্ষতার কারণেই উচ্চ মূল্যস্ফীতির এ সময়ে ভ্যাট-ট্যাক্স বাড়ানোর মতো পদক্ষেপ সরকারকে নিতে হয়েছে।

অর্থনীতিবিদ ড. মুস্তাফিজুর রহমানের মতে, আইএমএফ-এর শর্ত অনুযায়ী সরকারকে কর-জিডিপি অনুপাত বাড়াতে হবে। গত কয়েক বছর সরকার এটি পারেনি এবং সেজন্যই মনে হয় এখন সরকার একটি সহজ পথ বেছে নিয়েছে।  

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) দুজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক গণমাধ্যমকে বলেন, শুল্ক–কর বাড়ানোর কারণে বছরে ১২ হাজার কোটি টাকা বাড়তি রাজস্ব আদায় করা যাবে বলে প্রাক্কলন করা হয়েছে। এতে সরকারের রাজস্ব ঘাটতি কমবে।

নতুন করে ভ্যাট-ট্যাক্স বাড়ছে যেখানে

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের শর্ত পূরণে রাজস্ব বাড়াতে ইন্টারনেটসহ ৬৭ পণ্য ও সেবার ভ্যাট-সম্পূরক শুল্ক বাড়িয়ে গত বৃহস্পতিবার অধ্যাদেশ জারি করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এতে এসব পণ্য ও সেবার দাম বাড়তে পারে।

এই তালিকায় রয়েছে -ওষুধ, এলপি গ্যাস, মিষ্টি, বিস্কুট, আচার, টমেটো সস, ফলের রস, সিগারেট, সাবান ও ডিটারজেন্ট, মোবাইল সেবা ও ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট।

এছাড়া টার্নওভারের তালিকাভুক্তি ও ভ্যাট নিবন্ধনের সীমা কমানো হয়েছে। এতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়প্রতিষ্ঠানকেও ভ্যাটের বিধি-বিধান পরিপালন করতে হবে, যা ব্যবসায়ের পরিচালন খরচ বাড়াতে পারে।

এ ছাড়া যেসব পণ্যের দাম বাড়তে পারে সেগুলো হচ্ছে- কিচেন টাওয়েল, টয়লেট টিস্যু, সানগ্লাস, চশমার ফ্রেম, মিষ্টি, ম্যাট্রেস, ট্রান্সফরমার, এলপি গ্যাস, ফেরো ম্যাংগানিজ (রড তৈরির কাঁচামাল), টমেটো সস, আচার-চাটনি, কেক, বিস্কুট, রং, ফলের রস, ফ্রুট ড্রিংকস, সাবান, ডিটারজেন্ট, বার্নিশ এবং সব ধরনের তাজা ফল।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, ‘উচ্চ মূল্যস্ফীতির সময় সরকারের ট্যাক্স-ভ্যাট বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া ঠিক হয়নি। ভ্যাট-সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোর তালিকায় এমন অনেক পণ্য-সেবা আছে, সেখানে সাধারণ মানুষের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে। শুধু গরিব মানুষই পড়বে না, মধ্যবিত্ত ও সীমিত আয়ের মানুষের ওপরও চাপে পড়বে। ’

আগে কর ফাঁকি রোধ করা সরকারের ১ নম্বর অগ্রাধিকার হওয়া উচিত ছিল জানিয়ে তিনি বলেন, এর পরই অগ্রাধিকারে থাকা উচিত প্রত্যক্ষ করহারের যৌক্তিকীকরণ।

অংশীদারদের সঙ্গে কোনো আলোচনা না করে ভ্যাট বাড়ানো হয়েছে মন্তব্য করে সরকারের এ সিদ্ধান্তকে আত্মঘাতী বলে মনে করছে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই)।

শনিবার এক সংবাদ সম্মেলনে ডিসিসিআই সভাপতি তাসকীন আহমেদ জানান, সরকারের এমন পদক্ষেপের সঙ্গে আমরা একমত নই। বেসরকারি খাতে একসঙ্গে এতগুলো জায়গায় ভ্যাট বৃদ্ধির এই সিদ্ধান্ত আত্মঘাতীমূলক।

ভ্যাট বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত অর্থনীতির গতি কমিয়ে দেবে মন্তব্য করে তিনি জানান, বর্তমানে উচ্চ মূল্যস্ফীতি রয়েছে, ডলারের দাম বেশি। গণ–অভ্যুত্থানের পর বিনিয়োগে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। ঋণের সুদহারও অনেক বেশি। এমন পরিস্থিতিতে চাপে পড়বে জনগণ।

অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক এম এম আকাশ বিবিসিকে বলেছেন, ‘এভাবে ভ্যাট-ট্যাক্স বাড়ানোর বিষয়ে সরকারের লোকজন একমত হলেন কিভাবে-সেটাই আশ্চর্য হওয়ার মতো একটা বিষয়’।

অবশ্য ভ্যাট বা কর বাড়ানোর সরকারি উদ্যোগের বিষয়ে গত ২ জানুয়ারি অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন যে, বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভ্যাট বাড়লেও জিনিসপত্রের দামের ওপর তেমন প্রভাব পড়বে না।

এদিকে ভ্যাট প্রত্যাহারের আলটিমেটাম দিয়ে রেখেছেন দেশের রেস্তোরাঁ মালিকরা । তা বাতিল করা না হলে অনির্দিষ্টকালের জন্য রেস্তোরাঁ বন্ধ রাখারও হুমকি দিয়ে রেখেছেন তারা।

খাদ্যে মূল্যস্ফীতি বেশির কারণে দুর্ভোগে মধ্য ও নিম্নবিত্ত

দেশের অর্থনীতির অবস্থা ভালো না থাকায় মূল্যস্ফীতি এখনো বাড়তির দিকেই আছে; বিশেষ করে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি বেশি। এ কারণে মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্ত মানুষ দুর্ভোগে পড়েছেন।

সম্প্রতি অর্থনৈতিক বিষয়ে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, বাস্তবে মূল্যস্ফীতির হার ১৫ থেকে ১৭ শতাংশ। যদিও পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, ২০২৪ সালে গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ১০.৩৪ শতাংশ। তার আগের বছর ২০২৩ সালে এই হার ছিল ৯.৪৮। গত বছর উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে ছিল মানুষ। সে তুলনায় মানুষের আয় বাড়েনি।

ডিসেম্বরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১২.৯২ শতাংশ। আর সার্বিক মূল্যস্ফীতি কমে হয়েছে ১০.৮৯ শতাংশ। তবে মূল্যস্ফীতির এ দুই হার এখনো দুই অঙ্কের ঘরে থাকার মানে হলো, নির্দিষ্ট আয়ের মানুষকে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।

জাতীয় মজুরি হার কয়েক মাস ধরেই ৮ শতাংশের ঘরে আটকে আছে। মূল্যস্ফীতির তুলনায় মানুষের আয় কম হারে বাড়ায় মানুষের কষ্ট বাড়ছে।

এদিকে মূল্যস্ফীতির হার বেশি মাত্রায় বাড়লেও মজুরি বৃদ্ধির হার ছিল একেবারেই কম। চলতি বছরের ১১ মাসে সাধারণ মূল্যস্ফীতি গড়ে ১.৫২ এবং খাদ্যে ৪.২৪ শতাংশ বেড়েছে। এর বিপরীতে মজুরি বেড়েছে মাত্র ০.৩৩ শতাংশ। মূল্যস্ফীতি বেশি ও মজুরি কম বাড়ায় ভোক্তাকে জীবনযাত্রার ব্যয় কমাতে হয়েছে। এতেও পরিস্থিতি সামাল দিতে না পেরে ঋণ করতে হয়েছে। যে কারণে সঞ্চয় কমেছে।

ক্ষমতায় নতুন সরকার আসার পর সুদের হার বাড়িয়ে কিছু শুল্ক কমানোসহ অন্যান্য পদক্ষেপ নিলেও মূল্যস্ফীতির রাশ টেনে ধরা যায়নি।  

গত বুধবার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলনে মূল্যস্ফীতির পরিস্থিতির বিষয়টি স্বীকার করে পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, ‘মূল্যস্ফীতির কারণে মধ্যবিত্তরা কষ্টে আছে, নিম্নবিত্ত, শ্রমজীবী ও দিনমজুরদের ওপর চাপ বাড়ছে। সবাই বলছে, মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমেছে। যেটুকু কমেছে, এটিকে কিন্তু কম বলা যায় না। মূল্যস্ফীতি এখনো বাড়তিই আছে। ’

নতুন টাকা ছাপিয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলা করছে অন্তর্বর্তী সরকার। নতুন বছরেও টাকা ছাপানো অব্যাহত থাকলে মূল্যস্ফীতি আরো অসহনীয় হয়ে উঠবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।

টাকা ছাপানোর বিষয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক মইনুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, ‌‘সরকারের রাজস্ব আহরণ যেহেতু কম হয়েছে, তাই তাদের আর কোনো বিকল্প ছিল না। রাজস্ব আহরণ বাড়ানোর জন্য এটা করা হয়েছে। কিন্তু এটা সরকারের মূল্যস্ফীতি কমানোর যে উদ্দেশ্য, সেটার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। রাজস্ব আহরণের যুক্তিতে তারা যেটা করেছে, সেটা কতখানি কাজে দেবে তা এখনো বলার সময় আসেনি। এটা সময়ই বলে দেবে। অন্তর্বর্তী সরকারের ভ্যাট-ট্যাক্স বাড়ানোর উদ্যোগ মূল্যস্ফীতি কমানোর ক্ষেত্রে একটা বাধা হিসেবে কাজ করবে। ’

বাংলাদেশ সময়: ১৬৫৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১২, ২০২৫
এসএএইচ
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।