ঢাকা, শুক্রবার, ৭ ফাল্গুন ১৪৩১, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২১ শাবান ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

নাটোর চিনিকলে এবার লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি চিনি উৎপাদন

মো. মামুনুর রশীদ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৩৬ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৭, ২০২৫
নাটোর চিনিকলে এবার লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি চিনি উৎপাদন নাটোর সুগার মিলের উৎপাদিত চিনি

নাটোর: উত্তরবঙ্গের কৃষিভিত্তিক একটি বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠান নাটোর চিনিকলে জনবল ঘাটতি থাকলেও চলতি আখ মাড়াই মৌসুমে সঠিকভাবে আখ সরবরাহ হওয়ায় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৭ হাজার ৭৯৯ মেট্রিক টন বেশি আখ মাড়াই হয়েছে। একইসঙ্গে নির্ধারিত সময়ের চেয়ে দুই সপ্তাহ বেশি সময় ধরে আখ মাড়াইয়ের কারণে এবার ১ হাজার ১৮ মেট্রিক টন বেশি চিনি উৎপাদন হয়েছে।

 

যার বাজার মূল্য ১২ কোটি ৭২ লাখ টাকা। আর মোট চিনি উৎপাদন হয়েছে এবার ৬ হাজার ১৪৮ মেট্রিক টন। যার বাজার মূল্য ৭৬ কোটি ৭২ লাখ টাকা।

এছাড়া চিনিকলটিতে এবার ৬০ কার্যদিবসে ৯০ হাজার মেট্রিক টন আখ মাড়াইয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ থাকলেও সেখানে ৭৪ কার্যদিবসে ১ লাখ ৭ হাজার ৯৯ মেট্রিক টন আখ মাড়াই হয়েছে। চিনি আহরণ হারের লক্ষ্যমাত্রাও শতভাগ অর্জিত হয়েছে।  

গত মঙ্গলবার (১১ ফেব্রুয়ারি) বেলা ১১টার সময় চিনিকলের ৪১তম ২০২৪-২০২৫ আখ মাড়াই মৌসুম শেষ হয়।  

এর আগে গত (২৯ নভেম্বর) শুক্রবার বিকেলে নাটোর চিনিকলের কেইনে ক্রেরিয়ার ডোঙ্গায় আখ নিক্ষেপ করে মাড়াই মৌসুমের উদ্বোধন করেন বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের উপসচিব পরিচালক (অর্থ) মো. আবুল কালাম আজাদ।

চিনিকল কর্তৃপক্ষের দাবি, আর মাত্র ৪০ থেকে ৫০ হাজার মেট্রিক টন পরিমাণ আখ সরবরাহ ও মাড়াই করা গেলে চিনিকলটি লাভজনক পর্যায়ে যাবে। দীর্ঘ বছর পর বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের নির্ধারিত আখ মাড়াই ও চিনি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা এবার অর্জিত হয়েছে। আরও লাভজনক পর্যায়ে নিতে আগামীতে চাষিদের আখ চাষে উদ্বুদ্ধ করার পাশাপাশি আখের মূল্য বৃদ্ধি করতে হবে এবং চিনিকলে আরও জনবল বাড়াতে হবে। বিশেষ করে সিডিএ ও সিআইসি’ এবং কারখানা, প্রশাসন এবং হিসাব বিভাগে জনবল সংখ্যা বাড়াতে হবে।

এ চিনিকলে মোট অনুমোদিত জনবলের সংখ্যা ১ হাজার ১৮০ জন। সেখানে কর্মরত আছেন ৫৯৬ জন। চিনিকলে মোট জনবল ঘাটতি রয়েছে ৫৮৪ জন। এ ঘাটতি পূরণসহ আখ উৎপাদন বৃদ্ধি পেলে চিনিকলটি একদিকে লাভজনক পর্যায়ে পৌঁছাবে, অন্যদিকে কর্মসংস্থানের পথ সুগম হবে। আর চিনি উৎপাদন বাড়াতে পারলে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার সমৃদ্ধি ঘটবে এবং বিদেশ থেকে চিনি আমদানি নির্ভরতা কমে যাবে।

নাটোর চিনিকল সূত্রে জানা যায়, ১৯৮২ সালে নাটোর চিনিকল প্রতিষ্ঠিত হয়। পরে ১৯৮৪-৮৫ সালের দিকে চিনিকলটিতে বাণিজ্যিকভাবে চিনি উৎপাদন শুরু হয়। এরপর থেকে গ্রামীণ অর্থনীতিতে অবদান রেখে চলেছে এ চিনিকলটি। মানসম্মত চিনি উৎপাদনের পরিমাণ বৃদ্ধি ও উপজাত ভিত্তিক পণ্য উৎপাদন করে ভোক্তাদের মাঝে পণ্য সরবরাহ এবং পরিচালন ব্যয় কমিয়ে ও আহরণের হার বৃদ্ধির মাধ্যমে চিনিকলটিকে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করাই ব্যবস্থাপনার বড় চ্যালেঞ্জ।  

সূত্র জানায়, চলতি মৌসুমে ৬০ কার্যদিবসে ৯০ হাজার মেট্রিক টন আখ মাড়াই করে পাঁচ হাজার ১৩০ মেট্রিক টন চিনি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। চিনি আহরণের হার ধরা হয়েছিল ৫ দশমিক ৭০ ভাগ। সেখানে লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করে ১৪ দিন বেশি আখ মাড়াই করে ৭৪ কার্যদিবসে এবার ১ লাখ ৭ হাজার ৯৯ মেট্রিক টন আখ মাড়াই হয়েছে। অর্থাৎ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে এবার ১৭ হাজার ৯৯ মেট্রিক টন বেশি পরিমাণ আখ মাড়াই হয়েছে। আর চিনি উৎপাদন হয়েছে ৬ হাজার ১৪৮ মেট্রিক টন। অর্থাৎ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে এবার ১ হাজার ১৮ মেট্রিক টন বেশি পরিমাণ চিনি উৎপাদন হয়েছে। চিনি আহরণের ৫ দশমিক ৭০ লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়েছে।

এছাড়া নাটোর চিনিকল এলাকায় চলতি মৌসুমে ১০ হাজার একর জমিতে আখ চাষাবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হলেও সেখানে চাষাবাদ হয়েছে সাত হাজার ৮৫২ একর জমিতে। প্রতি মণ আখের মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছিল ২৪০ টাকা। এ চিনিকলের আটটি সাব জোনের ৪৮ কেন্দ্রের অধীনে আখ সরবরাহ করা হয়। এবার কৃষকরাও সঠিকভাবে আখ সরবরাহ করেছেন। ফলে আখ সরবরাহ ও মাড়াই বেশি এবং চিনি আহরণের হারও সঠিক হওয়ায় চিনির উৎপাদন বেড়েছে। গত মৌসুমে আট হাজার একর জমিতে আখ চাষাবাদ হয়েছিল।

সূত্র আরও জানায়, গত ২০২৩-২৪ মৌসুমে ৫৪ কার্যদিবস নিয়ে ৭৮ হাজার মেট্রিক টন আখ মাড়াই করে পাঁচ হাজার ৭০০ মেট্রিক টন চিনি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। সেখানে ৫২ কার্যদিবসে ৬৯ হাজার ৮৪৪ মেট্রিক টন আখ মাড়াই করে তিন হাজার ২১৪ মেট্রিক টন চিনি উৎপাদন করে নাটোর চিনিকল। আর চিনি আহরণের হার ৬ দশমিক ৫০ ভাগ ধরা হলেও সেখানে অর্জিত হয় ৪ দশমিক ৬০ ভাগ।

নাটোর চিনিকল সূত্র জানায়, আখ চাষাবাদের পরিধি বাড়ানোসহ সঠিকভাবে মানসম্মত আখ সরবরাহ প্রাপ্তি নিশ্চিত করা গেলে চিনিকল অবশ্যই লাভজনক হবে। আগামীতে যাতে আখ চাষ বৃদ্ধি পায় এবং কৃষকরা যাতে আখের ন্যায্যমূল্য পায়, সে বিষয়টি নিশ্চিত করা হবে এবং আখের মূল্য কিছুটা হলেও বাড়াতে হবে। এতে কৃষকরা আখ চাষাবাদে উদ্বুদ্ধ হবেন এবং আগামীতে দেড় লাখ মেট্রিক টন বেশি আখ উৎপাদন সম্ভব হবে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বাংলানিউজকে জানান, চিনিকলের একমাত্র কাঁচামাল হচ্ছে আখ। তাই আখ উৎপাদনে কৃষকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সিডিএ এবং সরবরাহে সংশ্লিষ্ট সিআইআইসিসহ কারখানা, প্রশাসন ও হিসাব বিভাগে জনবলের সংখ্যা বাড়ানো দরকার। কারণ চিনিকলে সিডিএ সেটআপ ১০৬ জন, সেখানে কর্মরত আছেন ৪৯ জন এবং সিআইসি সেটআপ ৪৮ থাকলেও কর্মরত আছেন মাত্র ৬ জন, কৃষি কর্মকর্তা ১৭ জন থাকার কথা থাকলেও কর্মরত আছেন ৬ জন। চিনিকলে মোট অনুমোদিত জনবলের সংখ্যা ১ হাজার ১৮০ জন, সেখানে কর্মরত আছেন ৫৯৬ জন। বর্তমানে চিনিকলে মোট জনবল ঘাটতি রয়েছে ৫৮৪ জন। তবে জনবল ঘাটতি থাকলেও নিজস্ব উৎপাদিত বিদ্যুতে চলে নাটোর চিনিকল।

তিনি বলেন, চিনিকলের চলতি মৌসুমে উৎপাদিতসহ মোট চিনি মজুদ আছে ৬ হাজার ৩৮ দশমিক ৭০ মেট্রিক টন এবং স্টিল ট্যাংকে চিটাগুড়ের মজুদ আছে ৫ হাজার ১৬৭ দশমিক ২২৫ মেট্রিক টন। আর স্টিল ট্যাংকে মোলাসেস সংরক্ষণের স্থান সংকুলান না হওয়ায় সদর দপ্তরের নির্দেশে রাজশাহী সুগার মিলের স্টিল ট্যাংকে ৬০০ মেট্রিক টনের বিপরীতে ২০৬ দশমিক ১৮ মেট্রিক মোলাসেস স্থানান্তর করা হয়েছে।

আগামী রমজান মাসে এ চিনিকলের চিনি বিক্রি শুরু করা হবে, যাতে সারা দেশেই বাজার স্থিতিশীল থাকে। এছাড়া ওই সময়ে চিনি সরবরাহ বা বিপণন করতে পারলে দেশে চিনির আমদানি নির্ভরতা কমবে এবং ডলার সাশ্রয় হবে। পাশাপাশি কর্মসংস্থান সৃষ্টির সহায়ক ভূমিকা রাখবে। এছাড়া দেশ অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হবে।

তিনি আরও বলেন, এবারের রমজান মাসে ঢাকা শহরে আখের তৈরি ও দেশীয় স্বাদের ৩০০ মেট্রিক টন চিনি প্যাকেটজাত করে খোলা বাজারে বিপণন করা হবে। আর সারা বছর প্যাকেটজাত করে বিক্রি করা হবে ১ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন চিনি। পুলিশ, সেনাবাহিনী, নৌ সেনাসহ সংরক্ষিত খাতে নির্ধারিত চিনি যাবে এ মিল থেকে। এবার মোট চিনি উৎপাদন হয়েছে ৬ হাজার ১৪৮ মেট্রিক টন। যার বাজার মূল্য দাঁড়ায় ১২৫ টাকা কেজি দরে ৭৬ কোটি ৭২ লাখ টাকা।

নাটোর চিনিকলের মহাব্যবস্থাপক (এমডি) আখলাছুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, এবার আখের মূল্যবৃদ্ধির ফলে চাষিরা আখ চাষে আগ্রহী ছিলেন এবং সঠিকভাবে চিনি কলে আখ সরবরাহ করেছেন। দিনে দিনে নাটোর চিনিকল এলাকায় আখ চাষ বাড়ছে। চলতি মৌসুমে আগে থেকেই চিনিকলে সাবজোনে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও মানসম্মত আখ সরবরাহ করার জন্য প্রচার-প্রচারণা চালানো হয়। নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী আখ সরবরাহ পাওয়া এবং মাড়াই সম্পন্ন করতে নির্ধারিত সময় থেকে ১৪ দিন বেশি সময় পাওয়া গেছে।

ফলে এবার পাঁচ হাজার ১৩০ মেট্রিক টন চিনি উৎপাদনের বিপরীতে ৬ হাজার ১৪৮ মেট্রিক টন চিনি উৎপাদন হয়েছে। তিনি বলেন, দীর্ঘ কয়েক বছর পর নাটোর চিনিকল আখ মাড়াই ও চিনি উৎপাদনের এবার লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করেছে। সময় মতো চাষিদের সার, বীজ, ঋণ সহায়তা এবং আখের মূল্য দ্রুত পরিশোধ করায় সব লক্ষ্যমাত্রাই অর্জন হয়েছে। আগামীতে চাষিদের আখ চাষে উদ্বুদ্ধ করতে এ কার্যক্রম চলমান থাকবে।

বাংলাদেশ সময়: ১৫২৬ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৭, ২০২৫
আরএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।