জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ভবনে বিভিন্ন ফ্লোরে সুনসান নীরবতা। নিচতলায় গণজমায়েত।
ভ্যাট অফিসের ফাইলেও জমছে ধুলার স্তর। রপ্তানি স্বাভাবিক থাকলেও আমদানি গতিহীন। অথচ সারা বছরের মধ্যে এখনই রাজস্ব আদায়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কর্মব্যস্ততা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেড়ে যায়।
অথচ রাতে জারি হওয়া এক অধ্যাদেশ বদলে দিয়েছে প্রেক্ষাপট। ক্ষোভ-হতাশা, অপমান-অভিমানে দাবি আদায়ের লড়াইয়ে সবাই আন্দোলনের মাঠে। এতে বেকায়দায় থাকা দেশের অর্থনীতি আরো ক্ষতির মুখে। আইন-শৃঙ্খলার অবনতি, সুদের হারের ঊর্ধ্বগতি, টাকার অবমূল্যায়ন, বিনিয়োগের অনিশ্চয়তার মধ্যে নতুন করে রাজস্ব খাতের অচলাবস্থায় চরম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় ব্যবসায়ী সমাজ।
লোকসানের আতঙ্কে তারা এখন ভীত।
রাজস্ব খাতের আন্দোলনের প্রভাব নিয়ে বিভিন্ন স্তরের ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তারা জানান, রাজস্বকর্মীদের আন্দোলনের ফলে উৎপাদনশীল খাত, শিল্প খাত, আমদানি ও রপ্তানিতে বিরাট প্রভাব পড়ছে। খেসারত গুনতে হচ্ছে বন্দর, শিপিং এজেন্টদের। এতে অস্থিতিশীল হতে পারে ভোগ্যপণ্যের বাজার।
আমদানি-রপ্তানি ব্যাহত হলে ঈদের আগে দেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি খাত পোশাক খাতে বড় ধরনের দুর্যোগ তৈরি হতে পারে। বেতন-বোনাস নিয়ে সংকটের আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা। তাই দ্রুততম সময়ের মধ্যে এ বিষয়ের সমাধানের জন্য সরকারের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন তাঁরা।
বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী বলেন, ‘এনবিআরের কর্মসূচির প্রভাব সর্বত্রই। প্রতিদিনই কোনো না কোনো কাজে কাস্টমসে ব্যবসায়ীদের যেতে হচ্ছে। উৎপাদনশীল খাত, শিল্প খাত, আমদানি ও রপ্তানিতে এর বিরাট প্রভাব পড়ছে। চট্টগ্রাম বন্দরেও কনটেইনার বসে থাকছে। ফলে ভোগ্যপণ্যের বাজারে একটা বড় প্রভাব পড়তে পারে। দাম বেড়ে যাবে। এখন কী করা উচিত ব্যবসায়ীরা বুঝতে পারছেন না। ’
তিনি আরো বলেন, ‘সরকারের উচিত ছিল অংশীজন হিসেবে এনবিআরের কর্মকর্তাদের বুঝিয়ে তাঁদের অনুমোদন নিয়ে বাস্তবায়নে যাওয়া। এত বড় একটা বিষয় চট করে চাপিয়ে দেওয়ার জিনিস না। সরকার এটা আনপ্রফেশনালি হ্যান্ডেল করেছে। মাথায় নেয়নি যে সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। দ্রুততম সময়ে বিষয়টির সমাধান হওয়া উচিত। ’
বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘এনবিআরের ইস্যুতে যদি আমাদের আমদানি-রপ্তানি ব্যাহত হয়, তাহলে ঈদের আগে বড় ধরনের দুর্যোগ তৈরি হবে। আমদানি-রপ্তানি ব্যাহত হলে ঈদের আগে বেতন-বোনাস নিয়ে আমরা একটা সংকটে পড়ে যাব। সুতরাং এটাকে যেভাবে হোক সরকারের আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা উচিত। ’
এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সিনিয়র সহসভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু বলেন, ‘এনবিআরের কর্মকর্তাদের আন্দোলনের ফলে ব্যবসায়ীদের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। কাস্টমস, ভ্যাট ও আয়করের নীতিনির্ধারণ প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা করতে পারবেন না। কারণ তারা এই বিষয়ে অভিজ্ঞ না। অন্যদিকে এটাই রাজস্ব কর্মকর্তাদের কাজ। পরামর্শক কমিটি যে প্রস্তাব দিয়েছিল, সেটা বাস্তবায়ন করলেই কর্মবিরতি উঠে যায়। সরকারকে বাস্তবতা মেনে নিতে হবে। অতীতেও দেখা গেছে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করে। এখনো তাই করছে। তাহলে দেশে পরিবর্তন তো আসছে না। সরকার হয়তো চেষ্টা করছে, পারছে না। ’
বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুটস ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘আমদানি-রপ্তানি বন্ধ থাকলে আমাদের বিরাট ক্ষতি হবে। কনটেইনার আটকে থাকায় খেসারত গুনতে হবে বন্দরে। শিপিং এজেন্টকেও দিতে হবে বাড়তি টাকা। পণ্য ছাড় না করতে পারলে বিক্রিও করা যাবে না। ব্যাংকের টাকাও পরিশোধ করা যাবে না। দাম বেড়ে অস্থিরতা তৈরি হবে দেশের বাজারে। আমদানি-রপ্তানি ব্যাহত হলে দেশের পোশাক খাতসহ সব ধরনের শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ’
এদিকে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে গত মঙ্গলবারের বৈঠক ফলপ্রসূ না হওয়ায় আগামী শনিবার থেকে পূর্ণাঙ্গ কর্মবিরতির ডাক দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে গতকাল বৃহস্পতিবার প্রধান উপদেষ্টার কাছে স্মারকলিপি দেওয়ার পাশাপাশি এনবিআরের অধীন সব দপ্তরে অবস্থান কর্মসূচি পালন করা হয়েছে।
গতকাল বিকেলে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনায় এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের পক্ষ থেকে এপিএস সাব্বির আহমেদের কাছে স্মারকলিপি হস্তান্তর করা হয়েছে। পরিষদের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন কর পরিদর্শক মুতাসিম বিল্লাহ, রাজস্ব কর্মকর্তা মো. শফিউল বসর, উপকর কমিশনার শিহাবুল ইসলাম কুশল, অতিরিক্ত কর কমিশনার সেহেলা সিদ্দিকা ও অতিরিক্ত কমিশনার হাছান মুহম্মদ তারেক।
স্মারকলিপিতে এনবিআর বিলুপ্তির স্বপক্ষে যথাযথ তথ্য-উপাত্তবিহীন প্রচলিত ধারণা ও প্রকৃত বাস্তবতা, সংস্কারের উদ্যোগ, অধ্যাদেশ জারি, পরবর্তী প্রতিক্রিয়া, অধ্যাদেশের কোথায় আপত্তি, কেমন সংস্কার চান ও চার দফা দাবি তুলে ধরা হয়েছে। দাবিগুলো হলো—এনবিআর বিলুপ্তির অধ্যাদেশ বাতিল, এনবিআর চেয়ারম্যানের অপসারণ, পরামর্শক কমিটির সুপারিশ জনসাধারণের জন্য প্রকাশ ও সব অংশীজনের মতামতের ভিত্তিতে টেকসই সংস্কার।
এর আগে গত ১৩ মে এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের ব্যানারে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কলমবিরতির ঘোষণা দিয়েছিলেন। মে মাসের ১৪ তারিখ থেকে ১৯ তারিখ পর্যন্ত এই কর্মসূচি পালন করা হয়েছে। এরপর আলোচনার আশ্বাসে ২০ মে আন্দোলন স্থগিত থাকে। এরপর ২১ মে নতুন কর্মসূচির ঘোষণা দেয় পরিষদ। দাবি আদায় না হলে আগামী সোমবার থেকে পূর্ণাঙ্গ কর্মবিরতির ডাক দেওয়া হয়েছে।
সংশোধনের পরেই অধ্যাদেশ বাস্তবায়ন— অর্থ মন্ত্রণালয়: ‘রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা অধ্যাদেশ-২০২৫’ প্রয়োজনীয় সংশোধন আনার পর বাস্তবায়ন করা হবে। তাই এনবিআর এখনই বিলুপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা নেই। গতকাল অর্থ মন্ত্রণালয় এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানিয়েছে। বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, অধ্যাদেশের বিধি ও প্রবিধানেও পরিবর্তন আনা সময়সাপেক্ষ। বৃহস্পতিবার দিনব্যাপী এনবিআরের সাবেক দুই সদস্যের মধ্যস্থতায় দফায় দফায় বৈঠকে সমঝোতা প্রস্তাব সম্পূর্ণ মেনে নেওয়ার পরও কর্মসূচি প্রত্যাহার হয়নি।
বিজ্ঞপ্তিতে চারটি বিষয় তুলে ধরা হয়েছে, অধ্যাদেশ বাস্তবায়ন সময়সাপেক্ষ হওয়ায় এনবিআরের কার্যক্রম আগের মতোই থাকবে। কর ও শুল্ক ক্যাডারের স্বার্থ বজায় রেখে অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে অধ্যাদেশের প্রয়োজনীয় সংশোধন আনা হবে। বর্তমানে এনবিআরে সব কাজ আগের মতোই থাকবে। কর ও শুল্ক ক্যাডারের পদ-পদবি কমানোর পরিকল্পনা সরকারের নেই, বরং সংস্কার হলে সচিব পদে নিয়োগসহ পদোন্নতির সুযোগ আরো অনেক বাড়বে। দেশের স্বার্থে এনবিআরের সব কর্মকর্তা-কর্মচারীকে অফিস সময়ে দপ্তরে উপস্থিত থেকে কাজ করতে অনুরোধ জানানো হয়েছে বিজ্ঞপ্তিতে।
দাবি পূরণের আগ পর্যন্ত কর্মসূচি চলবে—ঐক্য পরিষদ: অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে যৌক্তিক দাবিগুলোর অংশবিশেষ পূরণ হলেও মৌলিক চারটি দাবির বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট আশ্বাস পাওয়া যায়নি। চারটি দাবি পূরণ হওয়ার আগ পর্যন্ত পূর্বঘোষিত কর্মসূচি চলবে। দাবি পূরণের ঘোষণা আসার সঙ্গে সঙ্গে কর্মসূচি প্রত্যাহারের ঘোষণা দেওয়া হবে বলে জানিয়েছে এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ। গতকাল অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তির জবাবে পাল্টা সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বিষয়টি জানানো হয়েছে।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ‘আমরা যথেষ্ট সময় দিয়ে কর্মসূচি তীব্র করতে বাধ্য হয়েছি। এই যৌক্তিক দাবির বিষয়ে সরকারের সদিচ্ছা থাকলে আরো আগেই সমস্যার সুরাহা হয়ে যেত। বর্তমানে সদিচ্ছা শুরু হওয়াকে আমরা স্বাগত জানাই। আশা করি, শিগগির চারটি দাবি পূরণের আশ্বাস পাব। ’
বিজ্ঞপ্তিতে আরো বলা হয়েছে, ‘আজকে (গতকাল) আনুষ্ঠানিক কোনো বৈঠক হয়নি। সমঝোতা প্রস্তাব মেনে নেওয়ার বিষয়েও ঐক্য পরিষদ অবগত নয়। পদ-পদবি বিষয়ে আমরা কোনো বক্তব্য দিইনি, এগুলো আমাদের দাবিও নয়। পরিষদের চারটি দাবি হলো, অধ্যাদেশ বাতিল, এনবিআর চেয়ারম্যানের অপসারণ, পরামর্শক কমিটির সুপারিশ জনসমক্ষে প্রকাশ ও অংশীজনের মতামতের ভিত্তিতে টেকসই সংস্কার। ’
সূত্র: কালের কণ্ঠ
এসআই