আমাদের দেশে ব্যাংকিং খাতের সমস্যা দীর্ঘদিনের। বলা যেতে পারে যে গত শতাব্দীর আশির দশকে বেসরকারি ব্যাংকের যাত্রা শুরুর সঙ্গে সঙ্গে অনিয়মও সংঘটিত হয়েছে সমান তালে।
আজকের ব্যাংকিং খাত যে নানামুখী সমস্যায় জর্জরিত, তা মূলত চার দশক ধরে চলা চরম অনিয়ম-অব্যবস্থার পরিণতি। তবে অনিয়ম-অব্যবস্থা যে মাত্রারই হোক না কেন, কোনো ব্যাংক আমানতকারীর গচ্ছিত অর্থ ফেরত দিতে পারেনি—এমন ঘটনা আগে কখনোই ঘটেনি, আজ যেসব ব্যাংক খারাপ অবস্থায় পড়েছে। এ কারণে গ্রাহকদের অর্থ ফেরত দিতে পারছে না বলে দাবি করা হচ্ছে। তার চেয়েও অনেক বেশি খারাপ অবস্থায় পড়েছিল একসময়ের আল-বারাকা ব্যাংক।
কিন্তু সেই ব্যাংকও গ্রাহকদের অর্থ ফেরত দিয়েছে এবং কয়েকবার নাম পরিবর্তন করে এখনো টিকে আছে।
সম্প্রতি গ্রাহকরা, বিশেষ করে আমানতকারীরা কয়েকটি ব্যাংক থেকে তাদের গচ্ছিত আমানতের অর্থ উত্তোলন করতে পারছে না। গত বছরের শেষের দিকে এবং এ বছরের শুরুতে কয়েকটি ব্যাংক প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েই গ্রাহকদের অর্থ প্রদানে অপারগতা প্রকাশ করেছে, যা নিয়ে গ্রাহকদের মধ্যে চরম হতাশা এবং অসন্তোষ দেখা দেয়। এই অবস্থার বিরুদ্ধে তীব্র সমালোচনা হয় এবং বাংলাদেশ ব্যাংক কিছু পদক্ষেপ নেওয়ায় সেসব ব্যাংক প্রকাশ্যে গ্রাহকদের অর্থ ফেরত দিতে অস্বীকৃতি জানানোর অবস্থান থেকে সরে এসেছে।
কিন্তু কয়েকটি ব্যাংক সেভাবে গ্রাহকদের অর্থ ফেরত দিতে চাইছে না বা পারছে না। সেসব ব্যাংকে এসে গ্রাহকরা যখন তাদের গচ্ছিত অর্থ ফেরত নিতে চাইছে, তখন সেসব ব্যাংক প্রথমেই জানার চেষ্টা করে যে গচ্ছিত অর্থ মেয়াদি আমানত হিসাবে জমা আছে, নাকি সঞ্চয়ী বা চলতি হিসাবে জমা আছে। যদি মেয়াদি আমানত হিসাবে জমা থাকে, তাহলে সেই আমানতের মেয়াদ পূর্ণ হয়েছে, নাকি মেয়াদপূর্তির আগেই উত্তোলনের জন্য আবেদন করা হয়েছে। যদি মেয়াদি আমানত মেয়াদপূর্তির আগেই উত্তোলনের জন্য গ্রাহক আসে, তাহলে তো কথাই নেই। সরাসরি বলে দেওয়া হচ্ছে যে মেয়াদপূর্তির আগে উত্তোলন করার সুযোগ নেই।
আর যে ক্ষেত্রে সঞ্চয়ী হিসাব, চলতি হিসাব বা মেয়াদপূর্তিতে মেয়াদি আমানতের অর্থ উত্তোলনের জন্য গ্রাহকরা ব্যাংকে আসে, সে ক্ষেত্রে ব্যাংক অর্থ ফেরত না দিয়ে জোরপূর্বক নতুন মেয়াদে ব্যাংকে জমা রেখে মাসে মাসে সুদ নিয়ে যাওয়ার জন্য বলে দেয়। সেই সঙ্গে এটিও জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে যে আগামী দিনগুলোতে ব্যাংকের অবস্থা যখন ভালো হবে, তখন তারা টাকা ফেরত পাবে। এহেন পরিস্থিতিতে সেসব ব্যাংকের কর্মকর্তাদের কথামতো ভবিষ্যতে গ্রাহকরা সেই ব্যাংকের কাছ থেকে যে সুদের অর্থ সময়মতো নিতে পারবে, সেই ভরসাও রাখতে পারছে না।
এসব ব্যাংকে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ অর্থ জমা রেখেছে। একদিকে যেমন সাধারণ মানুষ কিছুটা বেশি সুদের আশায় এসব ব্যাংকে অর্থ জমা রেখেছে, অন্যদিকে তেমনি নানা কানেকশন বা যোগাযোগের কারণে সমাজের বিত্তশালীরাও এখানে অর্থ জমা রেখেছে। এর বাইরে অনেক ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরাও তাঁদের ব্যবসার প্রয়োজনে জমানো অর্থ এসব ব্যাংকে স্থায়ী আমানত হিসেবে জমা রেখেছেন। ফলে ব্যাংকে থেকে আমানতের টাকা ফেরত না পাওয়ার কারণে সমাজের সব শ্রেণি-পেশার মানুষই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিত্তবানদের তুলনায় সাধারণ মানুষ এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। সাধারণ মানুষ ভবিষ্যতে চিকিৎসা ব্যয়, ছেলেমেয়ের শিক্ষা ব্যয় বা বিয়েশাদির খরচ মেটানোর উদ্দেশ্যে বা কোনো স্থাবর সম্পত্তি; যেমন—জমি ক্রয়ের জন্য যা কিছু সঞ্চয় করে, তা-ই ব্যাংকে জমা রেখে থাকে। একইভাবে ব্যবসার প্রয়োজনে ভবিষ্যতে খরচ বা বিনিয়োগ করার উদ্দেশ্যে যে অর্থ জমা করে, তা-ই ব্যাংকে গচ্ছিত রাখে। এসব প্রয়োজন দেখা দিলেই মানুষ ব্যাংক থেকে অর্থ উত্তোলন করতে চায়। এ কারণেই ব্যাংক যখন আমানতকারীর চাহিদা মোতাবেক অর্থ ফেরত দিতে অপারগতা প্রকাশ করে, তখন সাধারণ মানুষ মারাত্মক সমস্যায় পড়ে যায়। এ ধরনের পরিস্থিতিতে অবশ্য আতঙ্কিত উত্তোলনের পরিমাণ বেড়ে যায়, যা খুবই স্বাভাবিক। এই আতঙ্কিত উত্তোলন বন্ধ করতে হলে আমানতকারীদের চাহিদা মোতাবেক অর্থ ফেরত প্রদান নিশ্চিত করতে হবে।
সবচেয়ে মারাত্মক সমস্যা হচ্ছে যে এ ঘটনা দেশের ব্যাংকিং খাতে এক নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করল। ব্যাংক আমানতকারীর অর্থ ফেরত দিতে পারবে না, অথচ ব্যাংকিং ব্যবসা চালিয়ে যাবে—এমন অবস্থা ছিল কল্পনাতীত। আগে ব্যাংক অর্থ ফেরত দিতে না পারলে মারাত্মক সমস্যায় পড়ে যেত। হয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা বা বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে শাস্তি পেতে হতো অথবা আদালত থেকে শাস্তি পেতে হতো। আর এই শাস্তির ভয়েই ব্যাংকগুলো আমানতকারীদের অর্থ ফেরত প্রদানে বদ্ধপরিকর ছিল। এখন ব্যাংকের অবস্থা খারাপ—এই অজুহাতে আমানতকারীর অর্থ ফেরত প্রদানে অস্বীকৃতি জানানো যায় এবং কোনো রকম শাস্তির সম্মুখীন না হয়ে অনায়াসে ব্যাংকিং ব্যবসাও চালিয়ে যাওয়া যায়। ভবিষ্যতে এই খারাপ দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে অনেক ব্যাংক ইচ্ছা করলেই আমানতের অর্থ ফেরত না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। এ ধরনের ঘটনা ভবিষ্যতে দেশের ব্যাংকিং খাতে ভয়াবহ এক পরিণতির সূচনা করে রাখল।
একটি ব্যাংক আমানতকারীর অর্থ ফেরত না দিয়ে টিকে থাকে কিভাবে? হয় আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতে হবে, নতুবা ব্যাংক বন্ধ করে দিতে হবে। এর কোনো রকম বিকল্প নেই। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, আমাদের দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার বাস্তবতায় চাইলেও একটি ব্যাংক বন্ধ করা সম্ভব নয়। তাই বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে ব্যাংকের পরিচালকদের মালিকানা নিয়ে নেওয়া যেতে পারে। কেননা মালিকদের কারণেই আজ ব্যাংকের এই অবস্থা। তাই তাঁদের মালিকানা রাখার কোনো অধিকার নেই। বেশি মূল্যে এই মালিকানা অন্যদের কাছে বিক্রি করে দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, বর্তমান অবস্থায় এসব ব্যাংক ক্রয়ের জন্য নতুন বিনিয়োগকারী না পাওয়ারই কথা। তাই সাময়িক ব্যবস্থা হিসেবে সরকারের তত্ত্বাবধানে পেশাজীবী ব্যাংকার, নিরীক্ষা ফার্ম এবং আইনজীবীদের সমন্বয়ে একটি কনসোর্টিয়াম গঠন করে সমস্যায় থাকা ব্যাংকগুলো পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে। সেই সঙ্গে কিছু ব্যাবসায়িক পরিকল্পনা এবং সহযোগিতা প্রদান করতে পারলে ব্যাংকগুলো তিন থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে ঘুরে দাঁড়াতে পারবে। এবং তখন বেশ উচ্চমূল্যেই এসব ঘুরে দাঁড়ানো ব্যাংক দেশের ব্যবসায়ী বা বিনিয়োগকারীদের কাছে বিক্রি করে দেওয়া সম্ভব। এ ধরনের সমাধান কিভাবে হতে পারে, তা ব্যাখ্যা করতে গেলে বিস্তারিত আলোচনার প্রয়োজন, যা এই সীমিত পরিসরে সম্ভব নয়।
অনেকেই বলার চেষ্টা করবেন যে এসব ব্যাংকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ এত বেশি যে এই ব্যাংকগুলো ঠিক করা যাবে না। কথাটি সঠিক হলেও পুরোপুরি সঠিক নয়। কেননা খেলাপি ঋণ যে শুধু এই ব্যাংকগুলোর সমস্যা তেমন নয়। মাত্রাতিরিক্ত খেলাপি ঋণ পুরো ব্যাংকিং খাতের সমস্যা। কোনো ব্যাংকের বেশি আর কোনো ব্যাংকের কম, এই যা। এ কারণেই কিছু বিশেষ পদক্ষেপের মাধ্যমে এই খেলাপি ঋণ সমস্যার সমাধান করতে হবে। মোটকথা, আমানতকারীর অর্থ ফেরত দিতে না পারার মতো অবস্থা ব্যাংকিং খাতে এক দিনের জন্যও চলতে পারে না এবং চলতে দেওয়াও উচিত নয়। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের কঠোর অবস্থান গ্রহণ করা প্রয়োজন। বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয় গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবে বলেই আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস।
লেখক: সার্টিফায়েড অ্যান্টি মানি লন্ডারিং স্পেশালিস্ট ও ব্যাংকার, টরন্টো, কানাডা