ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

অর্থনীতি-ব্যবসা

ফিরে দেখা-২০১৪

ভাগ্য বদলায়নি খুলনার ১৫ হাজার শ্রমিকের

মাহবুবুর রহমান মুন্না, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০২৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩১, ২০১৪
ভাগ্য বদলায়নি খুলনার ১৫ হাজার শ্রমিকের ছবি : বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

খুলনা: দিন যায়, মাস যায়, যায় বছর। বদলায় সব কিছু।

শুধু বদলায়নি খুলনার বন্ধ ৬টি কল-কারখানার ১৫ হাজরের বেশি শ্রমিকের ভাগ্য। অভাব-অনটন আর অনিশ্চয়তা নিয়ে দুর্বিষহ দিন কাটছে এ সব শ্রমিকের। এদের মধ্যে কেউ কেউ পেশা বদলেছেন। কেউ কেউ চালাচ্ছেন রিকশা।

নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি থাকা সত্ত্বেও খুলনার বিভিন্ন বন্ধ কল-কারখানা চালুর উদ্যোগ থমকে আছে। ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে মহাজোটের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল, বন্ধ মিল চালু আর অচল মিল সচল করা হবে। কিন্তু তারপর পর দুই দফা সরকার ক্ষমতায় আসার পরও প্রতিশ্রুতিগুলো বাস্তবায়ন হচ্ছে না। ফলে, অর্ধাহারে-অনাহারে এসব বেকার শ্রমিকরা কলকারখানা চালুর অপেক্ষায় রয়েছেন।
 
বাংলানিউজের অনুসন্ধানে জানা যায়, ব্যক্তি মালিকানাধীন পাটকলগুলোর মধ্যে ৩টি বন্ধ হয়ে গেছে। আরো কয়েকটি বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। অন্যদিকে, রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলিও অর্থসংকটে পড়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, খুলনা-যশোর অঞ্চলে ব্যক্তি মালিকানাধীন পাটকল রয়েছে ১৯টি। এর মধ্যে ৩টি বন্ধ হয়ে গেছে।

মিলগুলো বন্ধের জন্য বেশ কয়েকটি কারণের কথা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে। মিলে উৎপাদিত পণ্য অবিক্রিত থাকা, উৎপাদন খরচের তুলনায় পণ্যের বিক্রি মূল্য কম হওয়ায় প্রয়োজনীয় ব্যাংক ঋণ না পাওয়া,  সময়মতো মিলে প্রয়োজনীয় কাঁচা পাট সংগ্রহ করতে না পারা, বিদ্যুৎ বিল বকেয়া থাকা, শ্রমিক-কর্মচারীদের পাওনা পরিশোধ করতে না পারা উল্লেখযোগ্য কারণ হিসেবে বলা হয়েছে।


মহসেন জুটমিল:

বন্ধের তালিকায় সর্বশেষ যুক্ত হয়েছে মহসেন জুটমিল। কয়েক দফায় ৩৯০ দিন লে-অফ করে রাখার পর ২০১৪ সালের ১৭ জুলাই মিলটি বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এর ফলে এ মিলের দুই হাজার একশ  শ্রমিক-কর্মচারী বেকার হয়ে পড়েন।

মহসেন জুট মিল শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি মো. সুলতান মোল্লা বলেন, শ্রম আইন লঙ্ঘন করে শ্রমিকদের মজুরি পরিশোধ ছাড়াই মিলটির সব শ্রমিককে একযোগে ছাঁটাই করে মিলটি স্থায়ীভাবে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। বন্ধের পর আমরা অনেক আন্দোলন-সংগ্রাম করেছি। কিন্তু, কাজের কাজ কিছুই হয়নি।


সোনালী ও অ্যাজাক্স জুটমিল:

সোনালী জুট মিল ২০১৪ সালের ২৭ মার্চ বিনা নোটিশে বন্ধ করা হয়। মিলের শ্রমিকদের ১২ সপ্তাহ এবং কর্মচারীদের ৯ মাসের মজুরি ও বেতন বকেয়া রয়েছে। বন্ধের সময় এ মিলটিতে প্রায় ৩ হাজার স্থায়ী শ্রমিক-কর্মচারীর সঙ্গে আরো অন্তত ২ হাজার অস্থায়ী শ্রমিক-কর্মচারী কর্মরত ছিলেন।

এছাড়া অনেক দিন ধরে বন্ধ রয়েছে, খুলনার ব্যক্তি মালিকানাধীন অ্যাজাক্স জুটমিল। অ্যাজাক্স জুটমিলে স্থায়ী ১ হাজার ৬শ শ্রমিক-কর্মচারীর পাশাপাশি আরো প্রায় দেড় হাজার অস্থায়ী শ্রমিক ছিলেন।

বছর জুড়েই পাটকল চালু করাসহ বকেয়া পাওনা পরিশোধের দাবিতে মিছিল, পথসভা, অনশন, মশাল ও লাঠি মিছিলের মতো নানান কর্মসূচি পালন করেছে শ্রমিক-কর্মচারীরা।
 

দাদা ম্যাচ ফ্যাক্টরি:

আশ্বাস আর প্রতিশ্রুতিতেই আটকে আছে দাদা ম্যাচ ফ্যাক্টরির সাড়ে ৭শ শ্রমিক পরিবারের ভাগ্য। নগরীর রূপসা শিল্পাঞ্চল এলাকায় রূপসা নদীর তীরে ১৯৫৬ সালে ১৮ একর জমির ওপর সুন্দরবনের গেওয়া কাঠ নির্ভর দাদাম্যাচ ফ্যাক্টরি লাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে যাত্রা শুরু করে।

ফ্যাক্টরি মালিক আব্দুল মারুফ সাত্তার ২০১০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি উৎপাদন ও ১৮ আগস্ট রাতের আঁধারে নোটিশ টানিয়ে ফ্যাক্টরি বন্ধ করে দেন। এতে ফ্যাক্টরির প্রায় সাড়ে ৭শ শ্রমিকের দু’বছরের পাওনা বকেয়া থেকে যায়।

পরবর্তীতে ২০১১ সালের ৫ মার্চ খালিশপুরে এক জনসভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ফ্যাক্টরি চালুর ঘোষণা দেন। আবার ২০১৪ সালের ২৩ আগস্ট শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু দাদা ম্যাচ ফ্যাক্টরি পুনঃচালুর ব্যাপারে দাদা ম্যাচ ফ্যাক্টরির আলোচনা সভায় যোগ দেন।

সভায় ৩ মাসের মধ্যে ফ্যাক্টরি চালুর প্রতিশ্র“তি দিলেও বাস্তবতার সঙ্গে এর কোনো মিল নেই। এ অবস্থায় ফ্যাক্টরির শ্রমিকরা প্রায় ৫ বছর ধরে অর্ধাহারে-অনাহারে জীবন-যাপন করছেন।

দাদা ম্যাচ ফ্যাক্টরির ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সভাপতি মো. দেলোয়ার হোসেন দিলখোশ মিয়া বাংলানিউজকে বলেন,  প্রধানমন্ত্রী ও শিল্পমন্ত্রীর  প্রতিশ্রুতির পরও ফ্যাক্টরিটি চালু হয়নি। দাদা ম্যাচের শ্রমিকদের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হচ্ছে।
 
তিনি প্রধানমন্ত্রীর কাছে নতুন বছরে ফ্যাক্টরিটি দ্রুত চালুর দাবি জানান।

খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিল:
এশিয়ার বৃহত্তম কাগজ কল খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিলস সুন্দরবনের গেওয়া কাঠের ওপর নির্ভর করে ১৯৫৯ সালে খালিশপুর শিল্পাঞ্চলের ভৈরব নদের তীরে ৮৭.৯৬ একর জায়গায় প্রতিষ্ঠিত হয়। চালুর পর থেকে কারখানাটি লাভজনকভাবে চলছিল।

২০০২ সালের ৩০ নভেম্বর তৎকালীন চারদলীয় জোট আমলে বন্ধ করা হয়েছিল খুলনার নিউজপ্রিন্ট মিলটি। ওই সময় মিলটি চালুর দাবিতে আওয়ামী লীগ আন্দোলন করেছিল। নির্বাচনের সময় তারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ক্ষমতায় গেলে নিউজপ্রিন্ট মিলটি চালু করা হবে। কিন্তু তারা ক্ষমতায় গিয়ে ইতোমধ্যে একটি মেয়াদ শেষ করেছে। এখন দ্বিতীয় দফায় সরকারে রয়েছে দলটি। কিন্তু নিউজপ্রিন্ট মিল চালু হয়নি।

বন্ধ করে দেওয়ার সময় ওই কারখানায় দুই হাজার ৩০০ স্থায়ী এবং এক হাজার ২০০ অস্থায়ী শ্রমিক-কর্মচারী কাজ করতেন। বন্ধ হওয়ার পর থেকে শ্রমিক-কর্মচারীসহ খুলনা অঞ্চলের রাজনৈতিক, সামাজিক বিভিন্ন সংগঠন ও সাধারণ মানুষ মিলটি চালুর দাবিতে আন্দোলন-সংগ্রাম করে আসছেন।

সর্বশেষ, ২০১৪ সালের ৫ সেপ্টেম্বরে শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমুর আগমনে খুলনাসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সাধারণ মানুষের মধ্যে আশার সঞ্চার হলেও গেল চার মাসেও কোনো অগ্রগতি হয়নি।

অপরদিকে, র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব-৬) সদর দফতর চলে যাওয়ায় মিলটি আরো নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়ে।

হার্ডবোর্ড মিল:
ভৈরব নদের তীরে নগরীর খালিশপুরে ১৯৬৫ সালে ৯.৯৬ একর জমির ওপর কানাডিয়ান কমার্শিয়াল কর্পোরেশন খুলনা হার্ডবোর্ড মিলটি স্থাপন করে। এটি ১৯৬৬ সালে বাণিজ্যিক উৎপাদনে যায়। উৎপাদন খরচের চেয়ে বেশি লাভ করায় স্বর্ণপদক পায় খুলনা হার্ডবোর্ড মিল।

অর্থিক সংকট ও যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে ২০১১ সালের ১৬ জুলাই খুলনা হার্ডবোর্ড মিলের উৎপাদন প্রায় দুই বছরের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। পরে হার্ডবোর্ড মিল ব্রেক ইভেন্টে যাওয়ার শর্তে ১০ কোটি টাকা ছাড় দেওয়ায় ২০১৩ সালের ৩১ জুলাই মিলটি ওভার হোলিং ও উৎপাদনে যায়।

কিন্তু চারমাসের মধ্যেই ২০১৩ সালের ২৬ নভেম্বর মিলটি ফের বন্ধ হয়ে যায়। চালু-বন্ধের এই খেলায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মিলটির প্রায় এক হাজার শ্রমিক ও কর্মচারী-কর্মকর্তা। বর্তমানে পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবন-যাপন করতে বাধ্য হচ্ছেন  তারা।

২০১৪ সালের ৫ সেপ্টেম্বর শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু মিল পরিদর্শন শেষে মজুদ থাকা কাঠ দিয়ে ৪৫ দিনের বোর্ড তৈরির নির্দেশনা দেন। তারপরও নানা কারণে মিলটি চালু করা সম্ভব হয়নি।

মিলটির শ্রমিক আব্দুস সালাম বাংলানিউজকে বলেন, মিলটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় প্রায় এক হাজার শ্রমিক-কর্মচারী-কর্মকর্তা বেকার হয়ে পড়েছেন।

তিনি জানান, হার্ডবোর্ড মিলটি বন্ধ থাকায় শ্রমিক কর্মচারীরা বেকার হয়ে অর্ধাহারে অনাহারে অতি কষ্টে জীবন-যাপন করছেন।
`
তিনি অবিলম্বে মিলটি চালু ও শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধের করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি জানান।

বৃহত্তর খুলনা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সভাপতি শেখ আশরাফ উজ জামান বাংলানিউজকে বলেন, বরাবরই খুলনা বঞ্চিত। আমরা নিউজপ্রিন্ট-দাদা ম্যাচ ফ্যাক্টরিসহ বন্ধ  মিলকারখানা চালুর জন্য একাধিকবার আন্দোলন সংগ্রাম করেছি। করেছি অনশন, অচল কর্মসূচি। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। তাই, দাবি করছি নতুন বছরে খুলনার বন্ধ মিল কারখানাগুলো চালুর।

বাংলাদেশ সময়: ২০২৮ ঘণ্টা,  ডিসেম্বর ৩১, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।