ঢাকা, শনিবার, ১৬ কার্তিক ১৪৩১, ০২ নভেম্বর ২০২৪, ০০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

সোডিয়ামের মাত্রা ভারতের চেয়েও বেশি

আসলেই কী সীসামুক্ত বাংলাদেশের ম্যাগি?

মাহমুদ মেনন, হেড অব নিউজ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩১৬ ঘণ্টা, জুন ৪, ২০১৫
আসলেই কী সীসামুক্ত বাংলাদেশের ম্যাগি?

ঢাকা: ম্যাগি নিয়ে পাশের দেশ ভারতে যখন তোলপাড়, ঠিক তখনই বাংলাদেশে ম্যাগি উৎপাদনকারী নেসলের হয়ে ‘ভালোত্বের’ সার্টিফিকেট দিয়ে দিয়েছে বিএসটিআই। প্রশ্ন উঠেছে তড়িঘড়ি করে দেওয়া এই সনদের ফলে নির্বিঘ্ন থাকতে পারে কি বাংলাদেশের ক্রেতারা?

ক্রেতারা বলছেন, পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণকারী সরকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউট (বিএসটিআই)‘র পরীক্ষার মান বরাবরই প্রশ্নবিদ্ধ।

আর খাবারটি যেহেতু শিশুদের কাছে অত্যন্ত প্রিয় তাই দাবি উঠেছে আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষার।  

এদিকে, বাংলানিউজের নিজস্ব বিশ্লেষণে দেখা গেছে ভারতের বাজারে বিক্রিত নুডলসের চেয়ে ‍বাংলাদেশের বাজারে বিক্রিত নুডলসে ক্ষতিকর সোডিয়াম ও স্যাচুরেটেড ফ্যাটের মাত্রা অনেক বেশি।

ভারতের বাজারের বিক্রিত নুডলসে এই সোডিয়ামেই পাওয়া গেছে মোনো সোডিয়াম গ্লুটামেট (এমএসজি), যা ক্ষতিকর মাত্রার সীসার উৎস বলে নির্দিষ্ট করা হয়েছে।  

প্রশ্ন উঠেছে, ম্যাগি নুডলস বাংলাদেশে যে উপাদানে তৈরি তা কী ভারতের চেয়ে আলাদা? নেসলে কি দুই দেশে দুই ধরনের ও ভিন্ন মাত্রার উপাদানে নুডলস তৈরি করে?

যদি সেটা করে থাকে তাও যেমন মেনে নেওয়ার মতো নয়, তেমনি যদি না করে থাকে তাহলে ভারতের নুডলসে অতিরিক্ত মাত্রার সীসা মিললে বাংলাদেশের নুডলসেও একই মাত্রা থাকতে পারে বলেই সন্দেহ করা যায়।

পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণকারী সরকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউট (বিএসটিআই) গত মঙ্গলবার নিজেই সাংবাদিকদের ডেকে জানিয়েছে, ম্যাগি নুডলসে ক্ষতিকারক কোনো উপাদান পাওয়া যায়নি।

প্রতিষ্ঠানটির সার্টিফিকেশন মার্কস বিভাগ সরাসরি বলে দিয়েছে, পরীক্ষা করে ক্ষতিকারক মাত্রায় কোনো উপাদান পাওয়া যায়নি।
 
বাংলাদেশে ম্যাগির প্রস্তুত ও বিপননকারী আন্তর্জাতিক কোম্পানি নেসলেও তাদের নুডলসে যে ক্ষতিকারক মাত্রায় সীসা নেই সে দাবি করে আসছে।

একই দাবি তারা করছে ভারতেও। অথচ ভারত সরকার সে দাবি প্রত্যাখ্যান করেছে। দেশটির সেনাবাহিনীর জন্য ম্যাগি নুডলসকে নিষিদ্ধ খাবার হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। সাধারণ বাজারেও ম্যাগির ওপরে এসেছে নিষেধাজ্ঞা।

দুই দেশে বিক্রিত ম্যাগি নুডলসের প্যাকেট বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে ভারতের বাজারের প্যাকেটে এর গুনাগুন যেভাবে বর্ণিত একইভাবে বাংলাদেশেও।

‘মেরি মাসালা ম্যাগি’ হয়ে গেছে ‘আমার মাসালা ম্যাগি’ আর দুই মিনিটের ইনস্ট্যান্ট নুডলস সে কথাতো রয়েছেই। একই ভিটামিন এ, আয়রন, প্রোটিন, আর আয়োডিনের কথা উল্লেখ রয়েছে খাদ্যগুনের কাছে।

পার্থক্য যে কিছু নেই তা নয়। ভারতের একেকটি ছোট ইনস্ট্যান্ট মাসালা নুডলস প্যাকের ওজন ৯৫ গ্রাম যার দাম ১২.৫০ রুপি। বাংলাদেশে প্রতি প্যাকেটের দাম ১৭ টাকা রয়েছে ৬২ গ্রাম। ভারতের সঙ্গে মুদ্রা দরের হেরফেরে ঢাকায় এই পণ্যের দাম হতে পারতো ১০ টাকা ০৮ পয়সা। যা খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ১৭ টাকা দরে।

সেসব প্রশ্ন এড়িয়ে গেলেও কিছু কিছু উপাদান দেখা গেছে ভারতের ম্যাগির তুলনায় বাংলাদেশের ম্যাগিতে অনেক বেশি। এসব উপদান ক্ষতিকর হিসেবেই বিবেচিত।
 
ভারতের একটি ৯৫ গ্রাম নুডলস প্যাকের সঙ্গে ‍বাংলাদেশে উৎপাদিত ৬২ গ্রাম প্যাকের পার্থক্যগুলোও বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে গড়ে প্রায় প্রতিটি উপদানই বাংলাদেশে বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে।

ভারতে যেখানে ৯৫ গ্রামের প্যাকেটে চর্বি ব্যবহৃত হয় ১৪ গ্রাম সেখানে বাংলাদেশে ৬২ গ্রামের প্যাকেটে চর্বি থাকে ১০.৪ গ্রাম। তুলনামূলক হিসাবে যা ১.৩০ গ্রাম বেশি। এর মধ্যে ক্ষতিকর স্যাচুরেটেড ফ্যাট ভারতের ৯৫ গ্রামের প্যাকেটে রয়েছে ৬ গ্রাম সেখানে বাংলাদেশের ৬২ গ্রামের প্যাকেটে রয়েছে ৪ গ্রাম। তুলনামূলক হিসাবে বাংলাদেশের প্রতি প্যাকেটে ক্ষতিকর এই ফ্যাট প্রায় ১ (প্রকৃত .৯) গ্রাম করে বেশি রয়েছে।
 
আসা যাক সোডিয়ামের প্রসঙ্গে। ভারতের ৯৫ গ্রামের নুডলস প্যাকে সোডিয়ামের মাত্রা ১১৩০ মিলিগ্রাম। বাংলাদেশের ৬২ গ্রামের প্যাকেটে ৭৬৮.৮ মিলিগ্রাম। এই মাপের ভারতীয় নুডলসের  চেয়ে ৩১.৪ মিলিগ্রাম বেশি সোডিয়াম রয়েছে বাংলাদেশে। ভারতের নুডলসে এই সোডিয়ামেই মিলেছে মাত্রাতিরিক্ত সীসা।
 
ভারত যেখানে পুরো বিষয়টি নিয়ে সতর্ক ও কঠোর প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে তখন বাংলাদেশে ‘ম্যাগি’র বিষয়টি কম গুরুত্ব পাচ্ছে বলেই সন্দেহ অনেকের।
 
গোটা ভারতেই এখন ম্যাগি একটি অন্যতম ইস্যু। সবশেষ মেঘালয়ের ম্যাগিতেও পাওয়া গেছে ক্ষতিকর মাত্রায় সীসা। উড়িশ্যা ও হরিয়ানায় শুরু হয়েছে পরীক্ষা। দিল্লিতে ১৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা দিয়ে বাজার থেকে সব প্যাকেট তুলে নিতে বলা হয়েছে।

গোটা দেশে পুলিশ, সেনা ও আধাসামরিক বাহিনীর ক্যান্টিনে ম্যাগি নুডলস নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বড় বড় বাজার গুলোতে আর ম্যাগি মিলছে না।

পশ্চিমবঙ্গে প্রথম দফা পরীক্ষা করে পুরোপুরি নিশ্চিত না হয়ে দ্বিতীয় দফা পরীক্ষার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
 
কেন্দ্রীয় সরকার ম্যাগির প্রস্তুতকারক নেসলের বিরুদ্ধে (জাতীয় ক্রেতা সমস্যা প্রতিকার কমিশনে (এসসিডিআরসি) অভিযোগ দায়ের করেছে।

এরই মধ্যে ভারতের একটি আদালত ম্যাগি নুডলসের বিজ্ঞাপনে মডেল হওয়ায় দেশটির তিন সেরা তারকা অমিতাভ বচ্চন, মাধুরী দিক্ষিত ও প্রীতি জিনতার বিরুদ্ধে প্রয়োজনে গ্রেফতার এমন নির্দেশ জারি করেছেন।

বিগবি খ্যাত অমিতাভ বচ্চন বলে দিয়েছেন, নোটিস পেলে আইনি প্রক্রিয়ায় সহযোগিতা করবেন। তিনি নিজে ম্যাগি নুসলসের বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দিয়েছেন বলেও জানান।

ভারতের নুডলসে পাওয়া গেছে মোনো সোডিয়াম গ্লুটামেট। এটি গ্লুটামেটিক এসিডমিশ্রিত সোডিয়াম লবন। যা সীসার অন্যতম উৎস। তৈরি খাবারে স্বাদ আর গন্ধ যুক্ত করতেই এই সোডিয়াম লবনের ব্যবহার। ম্যাগি নুডলস তেমনই একটি খাবার। সোডিয়ামের ব্যবহার বেশি হলে এই এসিডের মাত্রা বেশি থাকার সম্ভাবনাই প্রকট। আর হিসাবে দেখা গেছে বাংলাদেশের ম্যাগি নুডলসে সোডিয়ামের ব্যবহারের মাত্রা ভারতের ম্যাগির চেয়েও বেশি।

এ অবস্থায় বাংলাদেশে বিএসটিআই খুব দ্রুত তার পরীক্ষা সম্পন্ন করে সংবাদ সম্মেলন করে যে ঘোষণা দিয়ে দিয়েছে তাতে নেসলেরই প্রভাব রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

অনেকেই বিএসটিআই’র পরীক্ষণ পদ্ধতি নিয়েও কথা তুলেছেন। কারো কারো মন্তব্য পণ্যের সঠিক মান নির্ধারণে বিএসটিআই সারা দেশে খুব কমই আস্থা অর্জন করতে পেরেছে। সে কারণে বিএসটিআই’র সার্টিফিকেটের খুব একটা মূল্য সাধারণ ক্রেতার কাছে নেই।

আরও সতর্ক পরীক্ষা নিশ্চিত করা প্রয়োজন বলেই মনে করছে ক্রেতা সাধারণ।

বাংলাদেশ সময় ১৩১৭ ঘণ্টা, জুন ০৪, ২০১৫
এমএমকে/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।