ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

জীবন বিমায় বেপরোয়া খরচ

সাঈদ শিপন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০১৩ ঘণ্টা, জুন ২৫, ২০১৫
জীবন বিমায় বেপরোয়া খরচ

ঢাকা: আইন লঙ্ঘনের মাধ্যমে গ্রাহকের টাকা বেপরোয়াভাবে খরচ করছে সরকারি একমাত্র জীবন বিমা প্রতিষ্ঠান জীবন বিমা কর্পোরেশন। এমনকি ৯০১টি পদ শূন্য রেখেও খরচের লাগাম টেনে ধরা সম্ভব হচ্ছে না প্রতিষ্ঠানটির।


 
এমন খরচের কারণে দুর্বল হয়ে পড়ছে প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক অবস্থা। পলিসি গ্রাহকরা বঞ্চিত হচ্ছেন তাদের প্রাপ্য বোনাস থেকে। একই সঙ্গে লভ্যাংশ থেকে সরকারও বঞ্চিত হচ্ছে।

আর উপযুক্ত বোনাস দিতে না পারায় গ্রাহকের আস্থা হারাচ্ছে এই সরকারি বিমা প্রতিষ্ঠানটি। ফলে প্রতিবছরই কমছে প্রিমিয়াম আয়।
 
তথ্য অনুসন্ধানে দেখা গেছে, শেষ ৬ বছরে (২০০৯ থেকে ২০১৪) প্রতিষ্ঠানটি আইন লঙ্ঘন করে ব্যবস্থাপনা ব্যয় হিসেবে অতিরিক্ত খরচ করেছে ২৩১ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। এ টাকার ৯০ শতাংশই অর্থাৎ ২০৮ কোটি ৬৬ লাখ টাকা পলিসি গ্রাহকদের অংশ। বাকি ১০ শতাংশ বা ২৩ কোটি ১৮ লাখ টাকা সরকারের।
 
প্রতিষ্ঠানটি আইন লঙ্ঘন করে সব থেকে বেশি খরচ করেছে ২০১৪ সালে। বছরটিতে অতিরিক্ত খরচ করা হয়েছে ৫০ কোটি ১৯ লাখ টাকা। যা নির্ধারিত সীমার চেয়ে প্রায় ৫০ শতাংশ বেশি।
 
আগের বছর ২০১৩ সালে এ অবৈধ ব্যয়ের পরিমাণ ছিলো ৪৫ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। যা নির্ধারিত সীমার চেয়ে ৪০ শতাংশ বেশি। ২০১২ সালে এ খাতে অবৈধ ব্যয় হয় ৪১ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। যা নির্ধারিত সীমার তুলনায় ৪১ শতাংশেরও বেশি।
 
একই ভাবে ২০১১ সালে নির্ধারিত সীমার তুলনায় ৫০ শতাংশের বেশি ব্যবস্থাপনা ব্যয় বাবদ খরচ করা হয়। টাকার অঙ্কে যার পরিমাণ ৪৯ কোটি ১২ লাখ টাকা। ২০১০ সালে অতিরিক্ত ব্যয়ের পরিমাণ ২৯ কোটি ১০ লাখ টাকা এবং ২০০৯ সালে আইনি সীমা লঙ্ঘন করে ব্যয় করা হয় ১৬ কোটি ৬১ লাখ টাকা।
 
ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের খাতে প্রতিষ্ঠানটির এমন বেপরোয়া ব্যয়ের কারণে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)। এ জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি জীবন বিমা কর্পোরেশনের ব্যবস্থাপনা পর্ষদ ও পরিচালনা পর্ষদের সঙ্গে পৃথক দুটি বৈঠকও করেছে।
 
বৈঠকে প্রতিষ্ঠানটির এমন অবস্থার কারণে ব্যবস্থাপনা পর্ষদকে দায়ী করে আইডিআরএ চেয়ারম্যান এম শেফাক আহমেদ বলেন, সরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে জীবন বিমা কর্পোরেশনের উপর মানুষের আস্থা আছে। কিন্তু আপনারা সে আস্থাকে কাজে লাগাতে পারছেন না। এটি আপনাদের ব্যর্থতা।
 
আইনি সীমা লঙ্ঘন করে যে অতিরিক্ত অর্থ খরচ করা হয়েছে তার ৯০ শতাংশই পলিসি গ্রাহকরা প্রাপ্য উল্লেখ করে শেফাক আহমেদ বলেন, আইন অনুযায়ী আপনারা এ অর্থ কোনভাবেই খরচ করতে পারেন না। অতিরিক্ত ব্যয় পলিসি গ্রাহক ও শেয়ার গ্রাহক উভয়ের জন্য ক্ষতিকর। এই অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় না হলে পলিসি গ্রাহকরা বর্ধিত হারে বোনাসে পেতেন।
 
এদিকে প্রিমিয়াম আয়ের তথ্যে দেখা গেছে, ২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠানটি প্রথম বর্ষ প্রিমিয়াম আয় করেছে ৫৯ কোটি ১৮ লাখ টাকা। যা ২০১২ সালে ছিলো ৬৪ কোটি ৩১ লাখ টাকা। ২০১১ সালে এই আয় ছিলো ৬৮ কোটি ৪ লাখ টাকা, ২০১০ সালে ৬৩ কোটি ৬১ লাখ টাকা এবং ২০০৯ সালে ৭০ কোটি ৩৩ লাখ টাকা।
 
প্রিমিয়াম আয়ের এ চিত্র থেকে দেখা যাচ্ছে ২০০৯ সালের পর থেকে প্রতিবছরই ধারাবাহিকভাবে প্রতিষ্ঠানটির প্রথম বর্ষ প্রিমিয়াম আয় কমেছে। একই চিত্র নবায়ন প্রিমিয়াম আয়ের ক্ষেত্রেও। ২০০৯ সালের পরে বছরে নবায়ন প্রিমিয়াম আয়ের ৫০ শতাংশ আদায় করায় প্রতিষ্ঠানটির পক্ষে দুরহ হয়ে পড়েছে।
 
২০০৯ সালে জীবন বিমা কর্পোরেশনের নবায়ন প্রিমিয়াম আদায়ের পরিমাণ ছিলো ৪৭ দশমিক ৭৭ শতাংশ। পরের বছর ২০১০ সালে তা কিছুটা বেড়ে দাঁড়ায় ৫৭ দশমিক ২৩ শতাংশ। এরপর আর ৫০ শতাংশ নবায়ন প্রিমিয়াম আয় করতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি।
এরমধ্যে ২০১১ সালে ৩৩ দশমিক ৬০ শতাংশ, ২০১২ সালে ৪৮ দশমিক ৩৫ শতাংশ ও ২০১৩ সালে ৪৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ নবায়ন প্রিমিয়াম আদায় করতে সক্ষম হয় প্রতিষ্ঠানটি।
 
প্রিমিয়াম আয়ের এ চিত্রে উদ্বেগ প্রকাশ করে আইডিআরএ চেয়ারম্যান বলেন, মানসম্পন্ন ব্যবসা হলে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ নবায়ন প্রিমিয়াম আদায় হয়। কিন্তু জীবন বিমা কর্পোরেশনের নবায়ন প্রিমিয়াম আয়ের যে চিত্র দেখা যাচ্ছে তাতে মানসম্পন্ন ব্যবসা হচ্ছে না বলে প্রতীয়মান হয়।
 
সরকারি এই প্রতিষ্ঠানটির শাখা অফিসের সংখ্যা নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে আইডিআরএ। এ বিষয়ে আইডিআরএ চেয়ারম্যান বলেন, জীবন বিমা কর্পোরেশনের মাত্র ৬৮টি শাখা অফিস আছে।

অথচ শুধু ঢাকাতেই আলিকোর ১২৫টি এজেন্সি অফিস আছে। জীবন বিমা কর্পোরেশনের মতো বড় একটি প্রতিষ্ঠানে এত অল্প সংখ্যক শাখা দিয়ে প্রত্যাশিত ব্যবসা অর্জন কঠিন।
 
গত মে মাসে আইডিআরএ সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকে ব্যবস্থাপনা ব্যয়ে আইনি সীমা লঙ্ঘন ও প্রিমিয়াম আয়ের দুরবস্থার কারণ হিসেবে জীবন বিমা কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান এম শামছুল আলম কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পেনশন ফান্ড, কমিশনের স্ট্রাকচার এবং মাঠ পর্যায়ে এজেন্ট ও অফিসারদের মধ্যকার কোন্দলকে দায়ী করেন।
 
ওই সভাতেই প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ মান্নান বলেন, ব্যবস্থাপনা ব্যয় আইনি সীমার মধ্যে রাখতে বেশকিছু পদক্ষেপ নেওয়া হবে। এরমধ্যে প্রিমিয়াম বাড়াতে ফিল্ড অফিস ভিজিট করা, ব্যবসা উন্নয়ন সভা করা, গ্রাহক সেবার মান উন্নয়ন, প্রিমিয়াম আয়ের কোটা ও বেতন-ভাতা পুনঃনির্ধারণ, প্রডাকশন বোনাস ও নতুন পরিকল্প চালু উল্লেখ যোগ্য।
 
যোগাযোগ করা হলে আইডিআরএ’র চেয়ারম্যান এম শেফাক আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, জীবন বিমা কর্পোরেশনের ব্যবস্থাপনা ব্যয় ও প্রিমিয়াম আয়ের চিত্র খুবই হতাশাজনক। আমরা প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা পর্ষদকে বৈঠকে ঠেকে তাদের সামনে চিত্র তুলে ধরে পরিস্থিতির উন্নয়নে বিভিন্ন দিক নির্দেশনা দিয়েছি।
 
প্রতিষ্ঠানটির অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের প্রকৃত কারণসহ অন্যান্য অনিয়ম খতিয়ে দেখতে প্রয়োজন হলে নিরক্ষকও নিয়োগ দেওয়া হতে পারে বলে জানান এম শেফাক আহমেদ।
 
বিষয়টি নিয়ে বাংলানিউজের পক্ষ থেকে জীবন বিমা কর্পোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ মান্নানের মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করেও তা বন্ধ পাওয়া যায়।
 
বাংলাদেশ সময়: ১০১৪ ঘণ্টা, জুন ২৫, ২০১৫
এএসএস/এনএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।