ঢাকা: ট্রাস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স। নতুন ব্যবসা শুরু করা জীবন বিমা কোম্পানি এটি।
বাংলানিউজের অনুসন্ধানে এমনই চিত্র পাওয়া গেছে।
ব্যবসার শুরুতেই কোম্পানিটির আর্থিক ভিত্তি অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়েছে। পরিশোধিত মুলধন থেকে ৪ কোটি টাকা উত্তোলন করেও প্রতিষ্ঠানটির ব্যাংক ও ক্যাশ ব্যালেন্সে আছে মাত্র ৮৭ কোটি ৭৬ লাখ টাকা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিমা আইনের শর্ত না মেনেই নিবন্ধন সনদ পেতে আবেদন করে ট্রাস্ট ইসলামী লাইফ। তারপরও প্রতিষ্ঠানটিকে জীবন বিমা ব্যবসার জন্য নিবন্ধন সনদ দিয়েছে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)।
বিমা আইন অনুযায়ী, কোন বিমা কোম্পানিতে একটি পরিবার থেকে দুই জনের বেশি পরিচালক থাকতে পারবে না। আর একটি পরিবার থেকে দুই জন পরিচালক থাকলে তাদের সম্মিলিত শেয়ার ধারণের পরিমাণ ১০ শতাংশের বেশি হতে পারবে না।
আইনে এমন বাধ্যবাধকতা থাকলেও ট্রাস্ট ইসলামী লাইফে পদ্মা ইসলামী লাইফে অনিয়মের অভিযোগ থাকা পরিচালক জয়নাল আবেদিন ফাজরের পরিবার থেকেই রয়েছেন ৪ জন। আর তাদের সম্মিলিত শেয়ার ধারণের পরিমাণ ২১ শতাংশের উপরে।
এরা হলেন, জয়নাল আবেদিন জাফরের দুই ভাই জাকের আহমেদ ভূইয়া ও মোহাম্মদ রাকিব আহমেদ। অপর দু’জন জয়নাল আবেদিন জাফরের স্ত্রী শওকত আরা বেগম ও তার ছেলে রাসেদ আবেদিন।
প্রতিষ্ঠানটির পরিচালকদের এই চিত্র দেখে বিস্ময় প্রকাশ করে একাধিক জীবন বিমা কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা বাংলানিউজকে বলেন, একই পরিবার থেকে ৪ জন পরিচালক থাকার পরও কোম্পানিটির আইডিআরএ থেকে অনুমোদন পাওয়া বিস্ময়কর।
এ অনুমোদনের জন্য আইডিআরএ’র শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা অনৈতিক সুবিধা নিয়েছে কি না তা খতিয়ে দেখা উচিত।
আইডিআরএ’র শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের যোগসাজশ ছাড়া এভাবে আইন লঙ্ঘন সম্ভব না বলেও মন্তব্য করেন তারা।
বিষয়টি নিয়ে আইডিআরএ’র দায়িত্বশীল কারও বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে আইডিআরএ’র এক কর্মকর্তা বলেন, প্রতিষ্ঠানটির আড়ালে আওয়ামী লীগের এক শীর্ষ নেতা রয়েছেন। ওই নেতার তদবিরে অর্থমন্ত্রীর নির্দেশে ট্রাস্ট ইসলামী লাইফকে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
যোগাযোগ করা হলে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক মোহাম্মদ রাকিব আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, আমরা দুই ভাই, আমার ভাবী ও ভাইয়ের ছেলে ট্রাস্ট ইসলামী লাইফে পরিচালক হিসেবে আছি। তবে আমরা একই পরিবারের সদস্য না। কারণ আমার ভাবি ও তার ছেলে আলাদা পরিবার হিসেবে বিবেচিত হবে। এ বিষয়টি নিশ্চিত হয়েই আমরা নিবন্ধন সনদের জন্য আবেদন করেছিলাম।
তবে বিমা আইনে একই পরিবার সম্পর্কে বলা হয়েছে, বাবা, মা, ভাই, বোন, ছেলে, মেয়ে, ভাই ও বোনের ছেলে-মেয়ে, তাদের স্ত্রী অথবা স্বামী সবাই একই পরিবারের সদস্য হিসেবে বিবেচিত হবে।
এদিকে ব্যবসা পরিচালনার ক্ষেত্রেও নানা অনিয়ম করছে নতুন অনুমোদন পাওয়া এই বিমা প্রতিষ্ঠানটি। কোম্পানির এজেন্টদের সংখ্যা, প্রিমিয়াম আয়, উন্নয়ন কর্মকর্তা, ব্যবস্থাপনা ব্যয়সহ প্রতিটি স্তরেই অনিয়ম করে যাচ্ছে ট্রাস্ট ইসলামী লাইফ। এমনকি দিনের পর দিন খালি রাখা রয়েছে মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার পদটিও।
জানা গেছে, জীবন বিমা কোম্পানিতে এমপ্লয়ার অব এজেন্ট ও এজেন্ট’র আদর্শ অনুপাত ১:১৮। অর্থাৎ একজন এমপ্লয়ার অব এজেন্ট থাকলে এজেন্ট থাকবে ১৮ জন। অথচ এই প্রতিষ্ঠানটিতে এমপ্লয়ার অব এজেন্ট আছে ১ হাজার ৭৬৬ জন। এর বিপরীতে এজেন্ট আছে মাত্র ৪৮৯ জন।
এমপ্লয়ার অব এজেন্ট ও এজেন্টের অনুপাত ১:০.২৮। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানটিতে এমপ্লয়ার অব এজেন্ট ও এজেন্টের কাঠামো সম্পূর্ণ উল্টো।
ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের ক্ষেত্রেও প্রতিষ্ঠানটির অনিয়মের চিত্র পাওয়া গেছে। বিমা আইন অনুযায়ী একটি জীবন বিমা প্রতিষ্ঠান ব্যবস্থাপনা ব্যয় বাবদ প্রথম বর্ষ প্রিমিয়াম আয়ের সাড়ে ৯৭ শতাংশ পর্যন্ত খরচ করতে পারে।
অথচ এই প্রতিষ্ঠানটি ১০০ টাকা প্রিমিয়াম আয়ের বিপরীতে খরচ করেছে ১৩২ টাকার উপরে। ২০১৪ সালে ১১ কোটি ২৩ লাখ টাকা প্রিমিয়াম আয়ের বিপরীতে প্রতিষ্ঠানটি ব্যবস্থাপনা ব্যয় বাবদ খরচ করেছে ১৪ কোটি ৮৫ লাখ টাকা।
প্রতিষ্ঠানটিতে উন্নয়ন কর্মকর্তা আছে ২৮৩ জন। তাদের পিছনেই ২০১৪ সালে ব্যয় হয়েছে ২ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। যা মোট ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের ১৬ শতাংশ। উন্নয়ন কর্মকর্তার পদটি মূলত সুপারভাইজরি পর্যায়ের। তাই প্রতিষ্ঠানটিতে ২৮৩ জন উন্নয়ন কর্মকর্তা থাকাকে মাত্রাতিরিক্ত ও অপ্রয়োজনীয় বলছে খোদ বিমা নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ। এটিকে অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের জন্যও দায়ি করেছে আইডিআরএ।
এদিকে কমিশন ব্যয় ও উন্নয়ন কর্মকর্তাদের বেতন ছাড়াও প্রশাসনিক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বাবদ প্রতিষ্ঠানটি খরচ করেছে ১ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। অফিস ভাড়া বাবদ খরচ করেছে ৮১ লাখ টাকা। এছাড়া অন্যান্য খাতে ব্যয় করেছে ৪ কোটি ৬২ লাখ টাকা। প্রতিষ্ঠানটির এসব ব্যয় কোনভাবেই বাস্তবসম্মত নয় বলছেন বিমা সংশ্লিষ্টরা।
যোগাযোগ করা হলে আইডিআরএ’র চেয়ারম্যান এম শেফাক আহমেদও ট্রাস্ট ইসলামী লাইফের ব্যয়ের পরিমাণকে বস্তবসম্মত নয় বলে বাংলানিউজের কাছে উল্লেখ করেন।
তিনি বলেন, ট্রাস্ট ইসলামী লাইফের এজেন্ট সংখ্যা, প্রিমিয়াম আয়, উন্নয়ন কর্মকর্তাদের সংখ্যা, ব্যবস্থাপনা ব্যয়সহ প্রতিটি স্তরে অব্যবস্থাপনার চিত্র দেখা যাচ্ছে। এভাবে কোম্পানিটি চললে অচিরেই দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিবে। যা বিমা খাতের জন্য ভীষণ ক্ষতিকর।
অব্যবস্থাপনার কারণে কোম্পানিটির আর্থিক ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
বাংলাদেশ সময়: ০৮১৮ ঘণ্টা, জুন ২৮, ২০১৫
এএসএস/এনএস