ঢাকা: চেয়ারম্যান ইউসুফ আলী হাওলাদারের স্বেচ্ছাচার ও লাগামহীন দুর্নীতিতে ডুবতে বসেছে বাংলাদেশ কর্মাস ব্যাংক। নিজের ইচ্ছেমতো সিদ্ধান্ত নেওয়ায় ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ অন্য কর্মকর্তাদের সঙ্গেও তার বিরোধ এখন তুঙ্গে।
তবে সব অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে জানার পরও রাজনৈতিক চাপের কারণে চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
২০১৩ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি ইউসুফ আলী হাওলাদার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পরই নিজের আধিপত্য বিস্তার শুরু করেন। বিভিন্ন ব্যাংকের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়ার চেষ্টা করেন। পর্ষদের অনুমতি ছাড়াই নামে নামে দেন কোটি কোটি টাকা ঋণ।
ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবু সাদেক মো. সোহেল এসব বিষয়ের বিরোধিতা করায় তর ওপর চেয়ারম্যান নাখোশ হন। নানাভাবে হয়রানিরও চেষ্টা করেন। সর্বশেষ চলতি বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্ষদ সভায় এমডির ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হয়। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিধান পরিপন্থি হওয়া তাকে অপসারণ করতে পারেনি। ক্ষমতা ফিরিয়ে দিতে হয়েছে ১৪ মে এর পর্ষদ সভায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সম্প্রতি চেয়ারম্যানের রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে নিয়ম বহির্ভূতভাবে কয়েকটি শিল্প প্রতিষ্ঠানকে বড় অংকের ঋণ দেওয়া হয়েছে। জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য শওকত চৌধুরীর মালিকানাধীন যমুনা এগ্রো কেমিক্যালকে ঢাকার বংশাল শাখা থেকে ১শ’ ১২ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছে। বংশাল শাখার ম্যানেজার হাবিবুল ইসলামের স্ত্রীর মালিকানাধীন ফারহান ট্রেডিংসহ আরও দুটি প্রতিষ্ঠান হাতিয়ে নিয়েছে ৪৩ কোটি টাকা।
বংশাল শাখার ঋণ কেলেঙ্কারীর ঘটনায় চেয়ারম্যান নিজেকে আড়াল করতে অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. আসাদুজ্জামানকে সাময়িক অপসারণ করেন। অবৈধভাবে কেড়ে নেন এমডির ক্ষমতাও।
চেয়ারম্যানের হস্তক্ষেপে এসবি গ্রুপ অব ইন্ড্রাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান শাহজাহান বাবলু নিয়ম লঙ্ঘন করে কর্মাস ব্যাংকের দিলকুশা শাখা থেকে প্রায় ৫০ কোটি টাকা ঋণ নেন। এসব ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে চেয়ারম্যানের সুপারিশে নেওয়া হয়নি প্রয়োজনীয় জামানতও। অভিযোগ রয়েছে সরকারি জমির ভূয়া দলিল দেওয়ারও।
চট্টগ্রামের নুরজাহান গ্রুপের মেরিন ভেজিটেবল অয়েল মিলের নামে ৫৫ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছে চেক জামানত নিয়ে। এখনও আদায় করা সম্ভব হয়নি সে টাকা। ব্যাংক থেকে হাতিয়ে নেওয়া টাকা ও খেলাপী ঋণ আদায় না হওয়ায় মূলধন ঘাটতি বৃদ্ধির বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তে উঠে এসেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিধানমতে ব্যাংকটির ১শ’ ২৫ কোটি ১৫ লাখ টাকা সঞ্চিতি রাখার কথা। কিন্তু খেলাপী ঋণ বৃদ্ধি পাওয়ায় এখন সঞ্চিতি ঘাটতি রয়েছে ৪৬ কোটি ৯৩ লাখ। মুনাফা কমে যাওয়ায় সঞ্চিতি বাড়াতে পারছে না ব্যাংকটি।
২০১৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত এই ব্যাংকের মোট খেলাপী ঋণের পরিমাণ ২শ’ ৪৮ কোটি টাকা। শুধু ২০১৪ সালে খেলাপী হয়েছে ১শ’ ৫১ কোটি টাকা। আদায় অযোগ্য হয়েছে ৯৭ কোটি টাকা। খেলাপী ঋণ ও সঞ্চিতি ঘাটতির কারণে ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদ বেড়ে যাচ্ছে ব্যাংকটির।
খেলাপী ঋণ বৃদ্ধি ও আদায় অযোগ্য ঋণের পরিমাণ বেড়ে মূলধন ঘাটতি দেখা দিয়েছে ১শ’ ২ কোটি টাকা। এসব কারণে গত বছর ব্যাংকটির আর্থিক সূচকেরও অবনতি হয়েছে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে।
এসব অনিয়মের অভিযোগ থেকে বাঁচতে ব্যাংকের এমডিকে দোষী প্রমাণিত করার চেষ্টা করেন চেয়ারম্যান ইউসুফ আলী হাওলাদার। বিষয়টি খতিয়ে দেখতে তদন্ত করে চেয়ারম্যানের হস্তক্ষেপ ও সম্পৃক্ততা খুঁজে পাওয়া গেলেও রাজনৈতিক চাপে চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নিতে পারছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
স্বেচ্ছাচারিতা, অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে কি কমার্স ব্যাংক ডুবছে- এমন প্রশ্নের জবাবে ইউসুফ আলী হাওলাদার বাংলানিউজকে বলেন, বংশাল শাখার ঋণ কেলেঙ্কারীর ঘটনায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রতিবেদন দিলেই বোঝা যাবে কে জড়িত। ব্যাংকের একটি মহল চায় আমি এখানে না থাকি। তাই আমার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তোলা হচ্ছে।
বাংলাদেশ সময়: ১০৫৫ ঘণ্টা, জুন ২৭, ২০১৫
এসই/জেডএম