ঢাকা: চরম অব্যবস্থাপনা ও অনিয়মের মধ্য দিয়ে চলছে দেশের একমাত্র সরকারি মালিকানাধীন জীবন বিমা প্রতিষ্ঠান জীবন বিমা কর্পোরেশন।
প্রতিষ্ঠানটি থেকে যে ‘এজেন্ট’দের কমিশন দেওয়া হচ্ছে তাদের ৯০ শতাংশের কোনো অস্তিত্বই নেই।
বিমা পলিসির মেয়াদ শেষে দাবির টাকা পেতেও চরম ভোগান্তিতে পড়ছেন গ্রাহকরা। বিষয়টি নিয়ন্ত্রক সংস্থা বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষকে (আইডিআরএ) জানিয়েছে খোদ প্রতিষ্ঠানটিরই ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ মান্নান।
এমনকি কর্পোরেশনের প্রকৃত আর্থিক অবস্থা নিরূপণ ও বিক্রি করা পলিসির বোনাসের সঠিক হার নির্ণয়ের জন্য ২ বছর পর পর দায় মূল্যায়নের বিধান থাকলেও তা মানা হচ্ছে না।
২০১০ সাল থেকেই এই কর্পোরেশনটির দায় মূল্যায়নের কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। এতে একদিকে প্রকৃত হারে বোনাস পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন পলিসি গ্রাহকরা। অন্যদিকে প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক শক্তি কতটুকু, তা-ও নির্ণয় করা যাচ্ছে না বলে জানিয়েছে আইডিআরএ।
আইডিআরএ সূত্রে জানা গেছে, কর্পোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ মান্নান জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটিতে ৫০ হাজারের উপর এজেন্ট কর্মরত আছেন। তবে এদের বেশির ভাগই নামমাত্র এজেন্ট। মূলত যারা কাজ করছেন তারা অন্যদের নাম ব্যবহার করে কমিশন গ্রহণ করছেন।
এদিকে কর্পোরেশনটির এজেন্টদের বিষয়ে আইডিআরএ’র কাছে যে তথ্য আছে তাতে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটিতে ৬ হাজার ৭১৪ জন এজেন্ট কাজ করছেন এবং তাদের তত্ত্বাবধানের জন্য কোনো এমপ্লয়ার অব এজেন্ট নেই।
এছাড়া প্রতিষ্ঠানটি আইডিআরএ’র কাছে ১ হাজার ১’শটি এজেন্ট লাইসেন্স’র জন্য আবেদন করে। যা তিন মাস ধরে প্রস্তুত। কিন্তু এ সময়ে কর্পোরেশনের এজেন্টরা মাত্র ৭০টি লাইসেন্স সংগ্রহ করেছেন।
এমনই যখন এজেন্টদের চিত্র, তখন কাজে নিয়োজিত ৬ হাজার ৭১৪ জন এজেন্টের সক্রিয়তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন আইডিআরএ’র চেয়ারম্যান এম শেফাক আহমেদ।
তিনি বলেন, ‘জীবন বিমা কোম্পানির এজেন্টরাই মূলত ব্যবসা সংগ্রহ করেন। এক্ষেত্রে এজেন্টদের সংখ্যা যত বাড়বে ব্যবসার পরিধি বাড়ার সম্ভাবনাও তত বাড়বে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, জীবন বিমা কর্পোরেশনে এজেন্ট নেই বললেই চলে। ’
শেফাক আহমেদ আরও বলেন, ‘কর্পোরেশনের ১ লাখ ৫৩ হাজার টাকা ব্যবসার জন্য ডেভলপমেন্ট অফিসার পান ৫৬ হাজার ৪’শ টাকা। আর এজেন্ট পান ৫৩ হাজার ৫৫০ টাকা। অর্থাৎ ১ লাখ ৫৩ হাজার টাকা ব্যবসার জন্য ডেভলপমেন্ট অফিসার ও এজেন্টরাই তুলে নেন ১ লাখ ৯ হাজার ৯৫০ টাকা। এক্ষেত্রে ব্যবসা মানসম্পন্ন না হলে প্রতিষ্ঠানের কিছুই থাকবে না। ’
প্রতিষ্ঠানটিতে ‘এজেন্ট ও তাদের তত্ত্বাবধানকারী কর্মকর্তাদের কাঠামোতে ত্রুটি আছে’ উল্লেখ করে আইডিআরএ চেয়ারম্যান বলেন, ‘একজন এমপ্লয়ার অব এজেন্টের অধীনে ১৮ জন এজেন্ট থাকবে এটিই আদর্শ অনুপাত। কিন্তু জীবন বিমা কর্পোরেশনে এ নিয়ম একদমই মানা হয়নি। ’
এদিকে বিমা আইনের ৫৯(৬) ধারায় বলা হয়েছে, এজেন্ট ছাড়া অন্য কাউকে কমিশন বা অন্য কোনো নামে পারিশ্রমিক বা কোনো পারিতোষিক দেওয়া ও দেওয়ার চুক্তি করা এবং আইন অনুসারে নির্ধারিত হারের বেশি কমিশন দেওয়া বা গ্রহণ করার শাস্তি সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা।
আর বিমা আইনের ৫৮(১) ধারায় বলা হয়েছে, এজেন্ট ছাড়া অন্য কাউকে কমিশন বা অন্য কোনো নামে কোনো পারিশ্রমিক বা পারিতোষিক দেওয়া বা দেওয়ার চুক্তি করা যাবে না।
১২৪(১) ধারায় বলা হয়েছে, এজেন্টকে অব্যশ্যই সরকারি নিয়ন্ত্রক সংস্থা থেকে নিবন্ধন নিতে হবে।
আইনে কমিশন দেওয়া সংক্রান্ত বিধানের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বিমা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আইনে লাইসেন্স ছাড়া কোনো এজেন্টকে কমিশন বা অন্য কোনো নামে কমিশন দেওয়া যাবে না বলা হয়েছে। লাইসেন্সের জন্য আবেদন করেই কমিশন দেওয়া যাবে এ ধরনের কেনো নির্দেশনা নেই। ফলে লাইসেন্স না পেয়ে কমিশন দিলে তা হবে শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
সংশ্লিষ্টরা আরও জানান, আইন অনুসারে অনুমোদনবিহীন এজেন্টদের মাধ্যমে বিমা পলিসি করা অবৈধ। এসব পলিসির আইনগত কোনো ভিত্তি নেই। এতে মেয়াদ শেষে অথবা মৃত্যুজনিত কারণে দাবি উত্থাপিত হলে তা আদায়ে গ্রাহকরা আইনগত জটিলতায় পড়েন। ফলে গ্রাহকের দাবি আদায় হবে কিনা এ-নিয়ে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়।
এদিকে সম্প্রতি আইডিআরএ’র সঙ্গে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে জীবন বিমা কর্পোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ মান্নান জানান, কর্পোরেশনের দাবি নিষ্পত্তি করতে প্রচুর সময়ক্ষেপণ হয়। ঝিনাইদহের একজন পলিসি গ্রাহকের ১৬ হাজার টাকার দাবি নিষ্পত্তি করতে প্রায় দুই বছর সময় লেগেছে।
এম এ মান্নানের এ সংক্রান্ত বক্তব্যের নথি বাংলানিউজের সংগ্রহে রয়েছে।
এ বিষয়ে আইডিআরএ’র চেয়ারম্যান এম শেফাক আহমেদ বলেন, ‘একজন গ্রাহকের ১৬ হাজার টাকা দাবি আদায় করতেই ২ বছর সময় লেগেছে। এতে তার যে ধকল ও যাতায়াত বাবদ খরচ হয়েছে তা নিশ্চয় ১৬ হাজার টাকার কম হবে না। তাহলে দীর্ঘদিন ধরে বিমার প্রিমিয়াম জমা করে গ্রাহকের স্বার্থকতা কোথায়?’
প্রতিষ্ঠানের ব্যবসাবৃদ্ধিতে উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের (ব্যবস্থাপনা পরিচালক, জিএম, ডিজিএম পদ মর্যদার কর্মকর্তা) নিয়মিত ফিল্ড অফিস পরিদর্শন গুরুত্বপূর্ণ হলেও জীবন বিমা কর্পোরেশনে তার চল নেই।
এ বিষয়ে আইডিআরএ চেয়ারম্যান বলেন, ‘জীবন বিমা কর্পোরেশনের সকল ক্ষেত্রেই প্রচুর সমস্যা বিদ্যমান বলে মনে হচ্ছে। প্রধান কার্যালয়ে বসে ব্যবসা বাড়ানো করা যাবে না। ব্যবসা বৃদ্ধির জন্য কর্মকর্তাদের অবশ্যই ফিল্ড অফিস নিয়মিত পরিদর্শন করতে হবে। পাশাপাশি গ্রাহকসেবার মান উন্নত করা, এজেন্ট বাড়ানো ও তাদের ট্রেনিং’র ব্যবস্থা করতে হবে। ’
প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা নিয়োগের বিষয়ে শেফাক আহমেদ বলেন, ‘কর্পোরেশনে উচ্চ পদে নিয়োগ দেওয়া হয় মন্ত্রণালয় থেকে। তাদের বিমা সম্পর্কে ধারণা কম থাকাই স্বাভাবিক। আবার তারা বছর দুয়েক পরেই অন্যত্র বদলি হয়ে যান। ফলে তারা প্রত্যাশামাফিক কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেন না। ’
এছাড়া তারা ডেপুটেশনে নিয়োগ পাওয়ায় কোম্পানির অধীনস্থ অন্য কর্মকর্তাদের সাথে তাদের দূরত্ব তৈরি হয়। যা সম্মিলিতভাবে ব্যবসায় প্রসারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এক্ষেত্রে ডেপুটেশনে মন্ত্রণালয় থেকে এভাবে কর্মকর্তা না এনে সম্পূর্ণ পেশাদারিত্বের ভিত্তিতে কর্পোরেশনের নিজস্ব জনবল বৃদ্ধি করা উচিত। এমনটাই অভিমত শেফাক আহমেদের।
বাংলাদেশ সময়: ০৮১৭ ঘণ্ট, জুন ২৯, ২০১৫
জেএম