খুলনা: ইমেজ সংকট কাটিয়ে দক্ষ ব্যবস্থাপনায় অর্থনৈতিক ভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে এক সময়ে মুখ থুবড়ে পড়া মংলা বন্দর। সরকার বন্দরের উপর শুভ দৃষ্টি দেয়ায় মংলা বন্দরের আমদানি-রফতানি বাণিজ্যে এসেছে গতি।
বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) বিনিয়োগ ও রফতানি আয় বৃদ্ধি এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির জন্য মংলায় অর্থনৈতিক জোন (অঞ্চল) তৈরি করছে। যা নিয়ে এ অঞ্চলের মানুষের মধ্যে নতুন আশাবাদ তৈরি হয়েছে।
মংলা বন্দর ব্যবহারকারী সমন্বয় কমিটির মহাসচিব অ্যাডভোকেট সাইফুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, বর্তমান সরকার মংলা বন্দরের অবকাঠামোগত ব্যাপক উন্নয়ন করেছে। যার ফলে সচল হয়েছে বন্দর।
তিনি আরও বলেন, পদ্মা সেতুকে টার্গেট করে মংলায় গড়ে উঠছে অর্থনৈতিক জোন। ফলে এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক চিত্র পাল্টে যাবে। সৃষ্টি হবে কর্মসংস্থান।
বন্দর সূত্রে জানা যায়, বর্তমান সরকার দুই দফায় ক্ষমতায় আসার পর লোকসানি এই বন্দরটি লাভজনক ও সেবামূলক সংস্থার সুনাম অর্জন করেছে। বন্দরটির উন্নয়নের জন্য ২০০৯ সালের পর থেকে প্রায় ৫৫২ কোটি টাকা ব্যয়ে মোট ৮টি উন্নয়ন প্রকল্প ও ৪টি উন্নয়ন কর্মসূচির বাস্তবায়ন কাজ হাতে নেওয়া হয়। যার মধ্যে ৫টি উন্নয়ন প্রকল্প এবং সবগুলো কর্মসূচির বাস্তবায়ন কাজ এরইমধ্যে সম্পন্ন করা হয়েছে।
সূত্রে আরও জানা যায়, কর্মসূচি ও প্রকল্পের আওতায় এরইমধ্যে মংলা বন্দরে মালামাল দ্রুত ও দক্ষতার সঙ্গে হ্যান্ডলিংয়ের জন্য ২টি স্ট্রাডেল ক্যারিয়ার, ৬টি ফর্কলিফট ট্রাক, ২টি টার্মিনাল ট্রাক্টর ও ২টি কন্টেইনার ট্রেইলর সংগ্রহ করা হয়েছে। চ্যানেলের নাব্যতা/গভীরতা ৫.৫ মিটার থেকে ৭.৫ মিটার পর্যন্ত বৃদ্ধির জন্য ১৪ কিলোমিটার এলাকায় ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের কাজ শেষ করা হয়েছে।
দিন রাত নির্বিঘ্নে জাহাজ আসা-যাওয়ার জন্য ৬২টি বিভিন্ন ধরনের লাইটেড বয়া, ২টি রোটেটিং বীকন এবং ৬টি জিআরপি লাইট টাওয়ার ও আনুসঙ্গিক যন্ত্রপাতি সংগ্রহ করে মংলা বন্দরের পশুর চ্যানেলে স্থাপন করা হয়েছে। পশুর চ্যানেলের ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের অর্জিত সাফল্য ধরে রাখা এবং নব্যতা সংরক্ষণের জন্য নিয়মিত ড্রেজিং কাজ পরিচালনার জন্য ১টি ক্রেন বোট, ১টি হাউজ বোট, পাইপ, ফ্লোটার পাইপসহ ১টি কাটার সাকশান ড্রেজার সংগ্রহ করা হয়েছে।
মংলা বন্দর হতে হিরণপয়েন্ট পর্যন্ত পাইলট আনা নেওয়ার জন্য ১টি পাইলট বোট ও ১টি পাইলট ডেসপাচ বোট সংগ্রহ করা হয়েছে। যানবাহন চলাচলে অনুপযোগী প্রায় ১০ কি.মি. প্রধান সড়ক, বাইপাস সড়ক মেরামত ও উন্নয়ন করা হয়েছে।
বন্দরের মাধ্যমে আমদানিকরা গাড়ি রাখার জন্য সংযোগ সড়কসহ ২টি ইয়ার্ড নির্মাণ করা হয়েছে। কন্টেইনার রাখার জন্য ১টি আধুনিক কন্টেইনার ইয়ার্ড নির্মাণ ও বন্দরের বিভিন্ন স্থাপনায় ৮০ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং বিতরণের জন্য সৌর প্যানেল স্থাপন করা হয়েছে।
এছাড়া মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের নিজস্ব অর্থায়নে রুজভেল্ট জেটিতে ২টি পন্টুন, ২টি গ্যাংওয়ে, পশুর চ্যানেলে ৮টি মুরিং বয়া স্থাপন, ৩ টন ক্ষমতা সম্পন্ন ৫টি ফর্কলিফট ট্রাক, ৩০ টন ক্ষমতা সম্পন্ন ১টি মোবাইল ক্রেন সংগ্রহ করা হয়েছে।
মংলা বন্দর এলাকায় ২০৫ একর জমিতে নতুন অর্থনৈতিক জোন প্রতিষ্ঠা করা হবে। এ লক্ষ্যে বন্দর কর্তৃপক্ষ স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদি কিছু পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। যা পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
সেগুলো হলো- স্বল্প মেয়াদি পরিকল্পনা (১-২ বছর) ( জুলাই ২০১৪- জুন ২০১৬) : ই-সার্ভিস প্রবর্তন, কন্টেইনার ইয়ার্ড নির্মাণ, পশুর চ্যানেলের আউটার বারে ড্রেজিং, মংলা বন্দরের জেটির সামনে শিট পাইলিং।
মধ্য মেয়াদি পরিকল্পনা (১-৩ বছর) ( জুলাই ২০১৪- জুন ২০১৭): মংলা বন্দরের সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার, মংলা বন্দরের জন্য কন্টেইনার ও কার্গো হ্যান্ডেলিং যন্ত্রপাতি সংগ্রহ, মংলা বন্দর হতে রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র পর্যন্ত পশুর চ্যানেলে ক্যাপিটাল ড্রেজিং।
দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা (১-৫বছর) ( জুলাই ২০১৪- জুন ২০১৯): পশুর চ্যানেলের ডুবন্ত রেক অপসারণ, মংলা বন্দরের জন্য জলযান সংগ্রহ, মংলা বন্দরের জন্য একটি ট্রেলিং সাকশান হপার ড্রেজার সংগ্রহ, সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বের (পিপিপি) আওতায় মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের অসমাপ্ত ৩ ও ৪ নম্বর জেটি নির্মাণ, এমপিএ টাওয়ার ও পাঁচ তারা হোটেল নির্মাণ (যৌথ উদ্যোগে), দু’টি আধুনিক মাল্টি পারপাস কন্টেইনার জেটি নির্মাণ।
মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, বন্দরের অবকাঠামোগত অনেক উন্নয়ন হওয়ায় ইতিমধ্যে নেপাল, ভুটান, ভারত আমদানি-রফতানি বাণিজ্যে এ বন্দর ব্যবহারে আগ্রহী হয়েছে। ৬ জুন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেদ্র মোদি বাংলাদেশ সফরকালে মংলা বন্দর ব্যবহার বিষয়ে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করেছেন। এছাড়া ভুটান ও নেপালের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
তিনি বলেন, মংলা বন্দর এলাকায় ২০৫ একর জমিতে নতুন অর্থনৈতিক জোন প্রতিষ্ঠা, রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু, খানজাহান আলী বিমানবন্দর নির্মাণ, খুলনা-মংলা রেল লাইন স্থাপন ও ২০১৮ সালের মধ্যে পদ্মা সেতু নির্মাণ বাস্তবায়নের মাধ্যমে মংলা বন্দর কেন্দ্রীক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাবে।
তিনি আরও বলেন, বন্দর ঘুরে দাঁড়ানোর ফলে মংলা ইপিজেডে নতুন নতুন প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে। অনেকে মংলা বন্দরের আশপাশের জায়গা কিনছেন। বন্দর কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে জায়গা লিজ নিচ্ছেন। এতে দ্রুত শিল্পায়ন, কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি ও দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারী এ বন্দর ব্যবহারে আগ্রহী হচ্ছেন।
বাগেরহাট-৩ আসনের (রামপাল-মংলা) সংসদ সদস্য তালুকদার আব্দুল খালেক বাংলানিউজকে বলেন, বন্দরটির উন্নয়নের জন্য ২০০৯ সালের পর থেকে প্রায় ৫৫২ কোটি টাকা ব্যয়ে মোট ৮টি উন্নয়ন প্রকল্প ও ৪টি উন্নয়ন কর্মসূচির বাস্তবায়ন কাজ হাতে নেওয়া হয়। যার মধ্যে ৫টি উন্নয়ন প্রকল্প এবং সবগুলো কর্মসূচির বাস্তবায়ন কাজ ইতিমধ্যে সম্পন্ন করা হয়েছে। ফলে দিন দিন বন্দরের প্রতি আমদানিকারকদের আগ্রহ বাড়ছে। এখানে গড়ে উঠছে অর্থনৈতিক জোন।
তিনি আরও বলেন, খুলনা-মংলা রেল, খানজাহান আলী বিমানবন্দর, স্বপ্নের পদ্মা সেতু নির্মাণের পর দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থার যে বৈপ্লবিক উন্নতি সাধিত হবে তা মংলা বন্দরকে কর্মচাঞ্চল্যে ভরপুর রাখবে।
বাংলাদেশ সময়: ১০৪২ ঘণ্টা, জুলাই ৪, ২০১৫
এমআরএম/এসএইচ