ঢাকা: গ্রাহকের সঙ্গে প্রতারণা, অবৈধভাবে অর্থ খরচ, চেক জালিয়াতি, ভূয়া এজেন্ট, মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) পদে অযোগ্য ব্যক্তি, শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ জাল, অতিরিক্ত কমিশন, বাকি ব্যবসাসহ সকল ধরনের দুর্নীতি আর অনিয়ম হরহামেশাই চলছে বিমা খাতে।
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের ভাষায় বিমা খাত ফাঁকিবাজিতে খুবই দক্ষ।
অতি সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের বলেছেন, বিমা খাত নিয়ে আগে কোন কাজ হয়নি। আর্থিক খাতের মধ্যে সব চেয়ে দুর্বল ছিলো বিমা খাত। এ খাতে ভয়ংকর দুর্নীতি ও অনিয়ম হয়। এ খাতের দেখভালের জন্য নতুন নিয়ন্ত্রক সংস্থা বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) গঠন করা হয়েছে।
বিমা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যাপক অনিয়ম আর দুর্নীতির কারণে বিমা খাতের সাবেক নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিমা অধিদফতর বিলুপ্ত করে ২০১১ সালে গঠন করা হয় নতুন নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ। কিন্তু দুর্নীতির কবল থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি বিমা নিয়ন্ত্রক সংস্থা।
বিভিন্ন সময় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত তথা অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তও এর নেপথ্যে ভূমিকা রেখেছে।
তাদের ভাষ্য মতে, নতুন নিয়ন্ত্রক সংস্থায় বার বার দুর্নীতি পরায়ন ও অযোগ্য ব্যক্তিদের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানো হয়েছে। ফলে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জোরালো তেমন কোন পদক্ষেপই নিতে পারেনি নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি। ক্ষেত্রবিশেষে আগের নিয়ন্ত্রক সংস্থার দুর্নীতিও ছাড়িয়ে গেছে নতুন নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ।
এমনকি বর্তমান দিয়েত্বে থাকা ৪ জন সদস্যের মধ্যে ২জনের যোগ্যতা নিয়ে বিমা খাতে নানা গুঞ্জন রয়েছে। এই দুই সদস্যকে বিমা বিশেষজ্ঞ হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হলেও তাদের কেউ কখনো কোন বিমা কোম্পানির শীর্ষ পদে চাকরি করেনি।
এদের মধ্যে একজনের শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। ওই সদস্য সাধারণ বিএ পাশ। অথচ বিমা কোম্পানির সিইও পদের শিক্ষাগত যোগ্যতার শর্ত রাখা হয়েছে মাস্টার্স পাশ।
এছাড়া দুর্নীতির অভিযোগ থাকা একজনকে সম্প্রতি আইডিআরএ’র উপদেষ্টা পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান হুদা ভাসি চৌধুরী অ্যান্ড কোং এর এক নিরীক্ষা প্রতিবেদনে এই উপদেষ্টার বিরুদ্ধে ব্যপক দুর্নীতির অভিযোগ উঠে আসে।
তিনি অনুমোদনহীন ভুয়া এজেন্টের মাধ্যমে প্রগ্রেসিভ লাইফ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা আত্মসাৎ করেন। এ বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনে মামলাও করা হয়েছে।
অর্থমন্ত্রী বক্তব্যের বিষয়ে আইডিআরএ’র চেয়ারম্যান এম শেফাক আহমেদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বাংলানিউজকে বলেন, আমাদের লোকবল সংকট রয়েছে। তারপরও বিমা খাতকে আমরা নিয়মের মধ্যে আনতে কাজ করে যাচ্ছি।
বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি আহসানুল ইসলাম টিটু বাংলানিউজকে বলেন, ব্যাংকিং খাতের এখন যে অবস্থা বিমা খাত তার থেকে অনেক ভালো অবস্থানে রয়েছে। বিমা খাত মানুষের টাকা নিয়ে মেরে খায়নি। তবে এ খাতে অনেক পুরাতন আইন আছে যেগুলো হয়তো প্রতিপালন করা যায়নি।
তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন বিমা খাতের আকার কতো? অথচ ২/৩ ব্যাংকেই তো ৫ থেকে ৬ হাজার কোটি টাকা জালিয়াতি হয়ে গেছে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে এমন কোন খাত নেই যে খাতে অনিয়ম হয় না। আমরা (বিমা খাত) ভিন্ন গ্রহের না। হয়তো এ খাত থেকে কেউ কেউ কিছু সুবিধা নিয়েছে। সেক্টরে দুই একজন খারপ থাকেই। ঢালাও ভাবে সকলকে খারাপ বলা ঠিক না।
তিনি বলেন, আইন যত কড়া হবে বিমা খাতের জন্য ততো ভালো হবে। ৫ বছর আগে আইন পাশ হলেও, আজও তা কার্যকর করা সম্ভব হয়নি। আগে তো আইন ঠিক করতে হবে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ৩জন সিইও বাংলানিউজকে বলেন, অর্থমন্ত্রীকে বিমা খাত সম্পর্কে যে ধারণা দেওয়া হয়েছে তিনি তাই বুঝেছেন। দায়িত্বপূর্ণ পদে থেকে তার এ ধরনের বক্তব্য মানায় না। এর আগে শেয়ারবাজার নিয়ে অর্থমন্ত্রী একাধিকবার উল্টা-পাল্টা বক্তব্য দিয়েছেন।
তারা বলেন, বিমা খাতে বর্তমানে যে অনিয়ম আছে তার জন্য অর্থমন্ত্রী ও আইডিআরএ অনেক অংশে দায়ী। অর্থমন্ত্রী নিজেই যোগ্যতাহীন ও দুর্নীতিবাজ ব্যক্তিদের নিয়ন্ত্রক সংস্থার গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়ে রেখেছেন।
দেড় হাজার কোটি টাকা অবৈধ ব্যয়: আইন লঙ্ঘন করে শেষ ৬ বছরে ১৭টি জীবন বিমা কোম্পানি ১ হাজার ৭৮৫ কোটি ৪৩ লাখ টাকা অবৈধভাবে ব্যয় করেছে। এ টাকার ৯০ শতাংশ বিমা কোম্পানির পলিসি গ্রাহকদের। বাকি ১০ শতাংশ শেয়ার হোল্ডারদের অংশ। এ বিষয়ে আইডিআরএ থেকে অর্থমন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে।
গৃহদ্বন্দ্বে আইডিআরএ: ২০১১ সালে আইডিআরএ গঠনের পর থেকেই প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করে এই নিয়ন্ত্রক সংস্থাটির উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব বিরাজ করছে। প্রথম ধাপে নিয়োগ দেওয়া সদস্যদের বিদায় করে দেওয়ার পরও এ বিরোধের অবসান হয়নি।
সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ে এক পক্ষ অপর পক্ষের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এনে পাল্টা পাল্টি অভিযোগ করেছে।
নেই আইনের প্রবিধান: বিমা আইন পাশের পর একে একে ৫টি বছর পার হলেও তৈরি করা হয়নি আইনের অধিকাংশ বিধি ও প্রবিধানমালা। গত ৫ বছরে গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়েছে মাত্র ৯টি প্রবিধানমালা। আর এখনো আলোর মুখ দেখেনি ১৭টি বিধি ও প্রবিধানমালা। অথচ এই বিধি ও প্রবিধানমালা হলো আইনের ব্যাখ্যা। অর্থাৎ বিধি ও প্রবিধানমালা ছাড়া আইন মূলত অকার্যকর।
নেই নিয়ন্ত্রক সংস্থার সাংগঠনিক কাঠামো: বিমা নিয়ন্ত্রক সংস্থা গঠনের পর ৫ বছর কেটে গেলেও এখনো অনুমোদন করা হয়নি নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ সাংগঠনিক কাঠামো। ফলে ভাড়া করা (চুক্তি ভিত্তিক) লোকবল দিয়েই ৫ বছর ধরে চলছে বিমা খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা।
গ্রাহকের চেক জালিয়াতি: বিমা পলিসির মেয়াদ শেষে বিমা দাবি পরিশোধ অথবা গ্রাহকের মৃত্যুজনিত বিমা দাবির টাকা পরিশোধে জীবন বিমা কোম্পানিগুলো হরহামেশাই টালবাহানা করছে। দিনের পর দিন কোম্পানিতে ঘুরে ঘুরেও গ্রাহক তার পাওনা না পাওয়ার বিষয়ে বাংলানিউজে একাধিক প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। এর সঙ্গে নতুন যোগ হয়েছে গ্রাহকের বিমা দাবির চেক জালিয়াতি। মেঘনা লাইফের গ্রাহকের চেক জালিয়াতির তথ্য বাংলানিউজের কাছে রয়েছে।
কোম্পানির সনদ বাতিল: অনিয়মের অভিযোগ স্ট্যান্ডার্ড ইন্স্যুরেন্সের সনদ তিন মাসের জন্য স্থগিত করেছে আইডিআরএ। এ বিষয়ে উচ্চ আদালতে একটি রিট মামলা চলমান রয়েছে। আগামী ৩০ জুলাই উচ্চ আদালতের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে এ বিষয়ে শুনানি হওয়ার কথা রয়েছে। ওই শুনানিতে স্ট্যান্ডার্ড ইন্স্যুরেন্সের রিট মামলটি খারিজ হলে প্রতিষ্ঠানটির বিমা ব্যবসার সনদ একেবারে স্থগিত হয়ে যাবে। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানটি নতুন করে দেশে আর কোন বিমা ব্যবসা করতে পারবে না। আইডিআরএর চেয়ারম্যান বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
কোটি টাকার জরিমানা: অতিরিক্ত কমিশন দেওয়া ও বাকি ব্যবসার অভিযোগ সম্প্রতি আইডিআরএ প্রগতী ইন্স্যুরেন্সকে ৩ কোটি টাকা জরিমানা করেছে। এছাড়া ৩ লাখ থেকে ৪৭ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা করা হয়েছে আরও ২৭টি কোম্পানিকে।
কোম্পানিগুলোর মধ্যে আছে-স্ট্যান্ডার্ড ইন্স্যুরেন্স, মেঘনা, বাংলাদেশ ন্যাশনাল, এশিয়া, ফিনিক্স, রিপাবলিক, ইস্টল্যান্ড, ইসলামী কমার্শিয়াল, ইউনাইটেড, রূপালী, সেন্ট্রাল, সোনার বাংলা, নিটল, ক্রিস্টাল, পিপলস, গ্রিন ডেল্টা, পাইওনিয়ার, অগ্রণী, গ্লোবাল, দেশ জেনারেল, প্রাইম, কন্টিনেন্টাল, প্যারামাউন্ট, রিলায়েন্স, বাংলাদেশ জেনারেল, সিটি জেনারেল, মার্কেন্টাইল, তাকাফুল ইসলামী, বাংলাদেশ কো-অপারেটিভ এবং জনতা ইন্স্যুরেন্স।
মাসের পর মাস ফাইল আটক: মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার নিয়োগ অনুমোদনসহ বিভিন্ন ধরণের ফাইল মাসের পর মাস আটকে থাকে আইডিআরএ’র কার্যালয়ে। এমনকি ১৫ দিনের মধ্যে মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার নিয়োগ অনুমোদনের আবেদনের সিদ্ধান্ত জানানো কথা থাকলেও কয়েক মাস আগে করা বেশকটি আবেদন বর্তমানে পড়ে আছে।
১৬ কোম্পানি সিইও পদে অনিয়ম: অভিযোগ আছে প্রয়োজনীয় যোগ্যতা না থাকার পরও অর্থমন্ত্রীর বাল্যবন্ধুর মেয়ে হওযার কারণে গ্রিন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্সের সিইও পদে নিয়োগ অনুমোদন পেয়েছেন ফারজানা চৌধুরী। আইনকে বৃদ্ধা আঙ্গুল দেখিয়ে বহাল তবিয়তে প্রতিষ্ঠানটিতে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।
এছাড়া যোগ্য ব্যক্তিকে সিইও পদে বসানো অথবা দীর্ঘদিন ধরে পদ খালি রেখে অইন লঙ্ঘন করছে আরও ১৫টি কোম্পানি। এরমধ্যে আছে প্রভাতী ইন্স্যুরেন্স, স্ট্যান্ডার্ড ইন্স্যুরেন্স, ইউনিয়ন ইন্স্যুরেন্স, গ্লোবাল ইন্স্যুরেন্স, এশিয়া প্যাসিফিক ইন্স্যুরেন্স, রিপাবলিক ইন্স্যুরেন্স, রিলায়েন্স ইন্স্যুরেন্স, পদ্মা ইসলামী লাইফ, এনআরবি গ্লোবাল লাইফ, গার্ডিয়ান লাইফ,ট্রাস্ট ইসলামী লাইফ, বায়রা লাইফ, আলফা ইসলামী লাইফ ও হোমল্যান্ড লাইফ।
বাংলাদেশ সময়: ১০৩৭ ঘণ্টা, জুলাই ০৯, ২০১৫
এএসএস/এনএস/