ঢাকা: বহু আলোচনা ও সমালোচনার পর সরকারিভাবে শ্রমিক পাঠানোর পাশাপাশি মালয়েশিয়ায় বাণিজ্যিকভাবে (বি-টু-বি বিজনেস টু বিজনেস) শ্রমিক পাঠানোর দরজাও উন্মুক্ত করলো সরকার।
বছরে প্রায় পাঁচ লাখ করে শ্রমিক নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে মালয়েশিয়া।
অনেকদিন ধরে বাংলাদেশের অন্যতম শ্রমবাজারগুলো বন্ধ থাকায় বৈধপথে শ্রমিক যাওয়ার গতি ছিল বেশ শ্লথ।
সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদির আরবের মতো বাজারে বছরে যেখানে লাখ লাখ শ্রমিক যাওয়ার রেকর্ড আছে, সেখানে গত ছয় বছরে সর্বোচ্চ শ্রমিক গেছেন ২১ হাজার। ২০১২ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাতে সোয়া দুই লাখ শ্রমিক যায়। অথচ গত আড়াই বছরে দেশটিতে গেছেন মাত্র ৫০ হাজারের মতো বাংলাদেশি শ্রমিক।
সম্প্রতি ঢাকঢোল পিটিয়ে সৌদি আরবের বাজার উন্মুক্ত হলেও শুধুমাত্র নারী গৃহশ্রমিক নেওয়ার বিষয়ে আগ্রহ দেখিয়েছে তারা। এর ফলে ধীরে ধীরে জনশক্তি রফতানির গতি শ্লথ হয়ে আসছিল। ঠিক সেই সময়ে শ্রমবাজার নিয়ে নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খোলে মালয়েশিয়া।
কিছুদিন আগে থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার উপকূলে পাচার হওয়া মানুষের গণকবর উদ্ধারের বিষয়টি নাড়া দেয় দেশটিকে। বেশি সংখ্যক শ্রমিক নিতে এবার জি-টু-জি’র (গভর্নমেন্ট টু গভর্নমেন্ট) পাশাপাশি বাণিজ্যিকভাবেও শ্রমিক নিতে আগ্রহ প্রকাশ করে মালয়েশিয়া সরকার। জিটুজির ক্রমাগত ব্যর্থতার সমালোচনার মুখে এটাই যেন চেয়েছিল বাংলাদেশ। এককথায় রাজি হয় সরকার। মালয়েশিয়াতে গিয়ে বিষয়টি চূড়ান্ত করে তবেই ফেরেন সে সময়ের প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন।
খুব শিগগিরই দেশটির প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ সফর করে শ্রমিক পাঠানোর নিয়মাবলি চূড়ান্ত করবে।
বৃহৎ এই শ্রমবাজার উন্মুক্ত হওয়াকে স্বাগত জানিয়েছেন, রিফ্যুজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসোর্স ইউনিট-এর (রামরু) পরিচালক তাসনিম সিদ্দিকী।
তিনি বাংলানিউজকে বলেন, অনেকদিন ধরে জিটুজি’র নামে বাজারটি মূলত বন্ধ হয়েছিল। আমরা নানাভাবে সরকারকে বলে এসেছি। সরকারকে ধন্যবাদ আমাদের সে উদ্বেগ আমলে নিয়ে বাণিজ্যিকভাবে শ্রমিক পাঠানোর ব্যবস্থা করেছে। তবে যদি সঠিকভাবে মনিটরিং করা না হয়, তাহলে আগের মতোই রিক্রুটিং এজেন্সি মালিকেরা প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত জনবল নিয়ে বাজারটি ভারসাম্যহীন করে তুলতে পারে।
এক্ষেত্রে আগের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে একধরনের প্রক্রিয়া তৈরি করার তাগিদ দেন ড. তাসনিম।
তিনি বলেন, মালয়েশিয়ার রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর তালিকা সংগ্রহ করে তাদের অতীতের দক্ষতা যাচাই করতে হবে। যে এজেন্সি এর আগে মাত্র পাঁচজন লোক নিয়েছে, তারা যদি ৫শ লোকের চাহিদা নিয়ে আসে, তাহলে মনে করতে হবে, সে ভুয়া চাহিদা এনেছে। তাকে পাঁচজনের শ্রমিক নেওয়ার জন্য অনুমতি দিতে হবে। আবার যাদের পাঁচশ শ্রমিক নেওয়ার রেকর্ড আছে, তাদের পাঁচশ শ্রমিক দেওয়ার জন্য সুপারিশ করা যেতে পারে। এসব কাজ অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে তথ্যের মাধ্যমে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাসকে করতে হবে। আর দেশের রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোকেও অনেক বেশি দায়বদ্ধ করে তুলতে হবে।
মালয়েশিয়া যেতে ইচ্ছুক শ্রমিকদের ডাটাবেজ আরো আপডেট করার ওপর জোর দেন অভিবাসন বিষয়ে গবেষণাকারী এই ব্যক্তিত্ব তাসনিম সিদ্দিকী।
তিনি বলেন, শুধুমাত্র প্ল্যানটেশন (গাছ রোপন) খাতে শ্রমিক নেওয়ার জন্য ১৪ লাখ শ্রমিক নিজেদের নিবন্ধিত করেন। কিন্তু এখন সব খাতে শ্রমিক নেবে মালয়েশিয়া। সে জন্য প্রত্যেকের দক্ষতা অনুযায়ী ডাটাবেজ আপডেট করা দরকার।
জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর দেওয়া পরিসংখ্যান অনুসারে, ২০১২ সালে সর্বমোট বিদেশে গেছেন ৬ লাখ ৭ হাজার ৭৯৮ জন বাংলাদেশি শ্রমিক। কিন্তু সে বছর থেকে আরব আমিরাত শ্রমিক নেওয়া বন্ধ ঘোষণা করলে পরের বছর শ্রমশক্তি রফতানি দুই লাখ কমে দাঁড়ায় ৪ লাখ ৯ হাজার ২৫৩ জনে। ২০১৪ সালেও সেই সংখ্যা খুব বেশি বাড়েনি। সে বছর যান মাত্র চার লাখ ২৫ হাজার ৬৮৪ জন।
সরকার বলছে, মালয়েশিয়ার বাজারে শ্রমিক যাওয়া শুরু হলে চলতি বছর শেষে রেকর্ড সংখ্যক জনশক্তি রফতানি হবে।
তবে মালয়েশিয়া শ্রমিক পাঠানোর বিষয়ে সতর্ক উচ্চারণ করেছেন অভিবাসীকর্মী উন্নয়ন প্রোগ্রামের (ওকাপ) নির্বাহী পরিচালক ওমর ফারুক।
তিনি বাংলানিউজকে বলেন, জিটুজি পদ্ধতিতে স্বল্প অভিবাসন মূল্যের বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছিল। বাণিজ্যিকভাবে মালয়েশিয়া যাওয়ার ক্ষেত্রেও যেন এ বিষয়টি গুরুত্ব পায়, সেটি লক্ষ্য রাখতে হবে। তা না হলে আবারও অতিমূল্যে বিদেশে গিয়ে নির্দিষ্ট সময়ে অর্থ তুলতে না পেরে শ্রমিকদের মধ্যে চুক্তি শেষ হলেও অবৈধভাবে মালয়েশিয়ায় থেকে যাওয়ার প্রবণতা বেড়ে যাবে। অপরাধে জড়িয়ে পড়বে বাংলাদেশি শ্রমিকরা। ফলে, বাজারটিতে সেই চেনা অস্থিরতা শুরু হবে। তাই, যখন বাণিজ্যিকভাবে শ্রমিক পাঠানোর চূড়ান্ত নীতি তৈরি হবে, তখন অবশ্যই এসব বিষয়গুলোর প্রতি বিশেষভাবে সরকারকে গুরুত্ব দিতে হবে।
জানা যায়, ঈদের পর মালয়েশিয়ার একটি টেকনিক্যাল টিম ঢাকা সফরে এসে শ্রমিক পাঠানোর নীতিমালা চূড়ান্ত করবে।
এ বিষয়ে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, বাণিজ্যিকভাবে শ্রমিক পাঠালেও রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর ওপর উভয় সরকারের কঠোর নিয়ন্ত্রণ থাকবে; যাতে বাজারে বিশৃঙ্খলার পুনরাবৃত্তি না ঘটে।
তিনি বলেন, এছাড়া অভিবাসন মূল্য যাতে শ্রমিকের দুই থেকে তিন মাসের বেতনের বেশি না হয়, সে বিষয়টিও নিশ্চিত করা হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৪৪৫ ঘণ্টা, জুলাই ১১, ২০১৫
জেপি/এবি