ঢাকা, বুধবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

কিরণমালা-রাইকিশোরীতে চাপা পড়ছে তাঁতশিল্প!

স্বপন চন্দ্র দাস, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১১২ ঘণ্টা, জুলাই ১১, ২০১৫
কিরণমালা-রাইকিশোরীতে চাপা পড়ছে তাঁতশিল্প! ছবি : বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

সিরাজগঞ্জ: পাখি-ঝিলিকের পর এবার কিরণমালা ও রাইকিশোরীতে চাপা পড়ছে দেশীয় তাঁতশিল্প। টিভি সিরিয়ালের নায়ক-নায়িকাদের নামে বাজারে আসা এসব পোষাক ও ভারতীয় শাড়ির সহজলভ্যতার কারণে সিরাজগঞ্জের তাঁত শিল্পে ধস নামতে শুরু করেছে।



এ কারণে জেলার তাঁতীদের কাপড় বিক্রি তুলনামূলকভাবে অর্ধেকে নেমে এসেছে। রোজার শুরুর দিক থেকেই তাঁতশাড়ির চাহিদা কম বোঝা গেলেও আশা করা হচ্ছিল ঈদের ১০/১২ দিন থাকতে কাপড় বিক্রি বাড়তে পারে।

কিন্তু ঈদ ঘনিয়ে এলেও আশানুরূপ কাপড় বিক্রি না হওয়ায় তাঁতীদের মাঝে হতাশা বিরাজ করছে। ২০১৪ সাল থেকে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। গত বছর ছিল পাখি আর ঝিলিক জামার দাপট। এ বছর কিরণমালা এবং রাইকিশোরী জামা দখল করে রেখেছে ঈদের মার্কেটগুলো।

বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড সিরাজগঞ্জ বেসিক অফিস ও পাওয়ারলুম অ্যান্ড হ্যান্ডলুম তাঁতমালিক সমিতি সূত্র জানায়, জেলার সদর, কাজিপুর, বেলকুচি, শাহজাদপুর, উল্লাপাড়া, চৌহালী, রায়গঞ্জ ও কামারখন্দ উপজেলায় প্রায় ৩ লাখ পাওয়ারলুম ও দেড় লাখ হস্তচালিত (হ্যান্ডলুম) তাঁত রয়েছে।

এর সঙ্গে ১৫ লাখ মালিক-শ্রমিকের জীবিকা জড়িত। এ অঞ্চল থেকে উৎপাদিত তাঁতপণ্য এনায়েতপুর, বেলকুচি, শাহজাদপুর ও সিরাজগঞ্জ নিউমার্কেট কাপড়ের হাটের মাধ্যমে রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের চাহিদা মিটিয়ে এক সময়ে ভারতসহ পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে রফতানি হতো।

গুণগত মানসম্মত আর দামে কম হওয়ার দেশজুড়ে রয়েছে সিরাজগঞ্জের তাঁতের শাড়ির খ্যাতি। এসব এলাকার উৎপাদিত জামদানি, কাতান, সিল্ক সহ বাহারি সব শাড়ির সুনাম দীর্ঘদিনের। তাই প্রতিবছর ঈদকে সামনে রেখে নড়েচড়ে বসে তাঁত মালিক শ্রমিক ও ব্যবসায়ীরা।

রোজা শুরুর আগ থেকে প্রায় দেড়মাস ধরে রাত-দিন পরিশ্রমে উৎপাদিত তাঁতবস্ত্র চাহিদানুযায়ী বিক্রি না হওয়ায় সংশ্লিষ্টরা হতাশ হয়ে পড়েছে। ঈদের আগে শ্রমিকদের বেতন দেওয়া নিয়েও সংশয়ে রয়েছে মালিকরা।

প্রতি রোববার দেশের বৃহত্তম শাহজাদপুরের কাপড়ের হাট বসে। ঈদকে সামনে রেখে এ হাটে উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি হয়। ঈদের হাটগুলোতে ক্রেতা-বিক্রেতার ভিড়ে থাকে জমজমাট। দেশের বিভিন্ন স্থানে থেকে পাইকাররা আসে এখানকার তাঁতের শাড়ি কেনার জন্য। নানা কারণে এবারের ঈদ হাটটি এবার জমে ওঠেনি।

তাঁত ব্যবসায়ীরা বাংলানিউজকে জানান, শাড়ির চাইতে থ্রি-পিস আর জামার ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ায় পাইকারদের উপস্থিতি কমে গেছে। পাশাপাশি ব্যাপক হারে ভারতীয় শাড়ির আমদানি ও সহজলভ্য হওয়ায় ক্রেতারা সেদিকেই ঝুঁকছে।

শাহজাদপুরের পোতাজিয়ার তাঁত ব্যবসায়ী আবুল হোসেন বাংলানিউজকে জানান, কোনো ঈদে শাহজাদপুর হাটের এ অবস্থা হয়নি। এবার তাঁতে লোকসান দিয়ে শাড়ি বিক্রি করলেও গুদামে পড়ে থাকবে লাখ লাখ টাকার শাড়ি।

আরেক তাঁত ব্যবসায়ী শহিদুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, প্রত্যেক বছর ঈদের ক্রেতার ভিড়ে পা ফেলানোর জায়গা থাকে না। এবার চিত্রটি ভিন্ন। পাইকারি ক্রেতাদের সঙ্গে খুচরা ক্রেতাদেরও উপস্থিতি অনেক কম। গত বছর থেকেই এ অবস্থা শুরু হয়েছে বলে তিনি জানান।

বৃহস্পতিবার (৯ জুলাই) জেলা সদরের বৃহত্তম কাপড়ের হাট নিউমার্কেটে গিয়ে দেখা গেছে, তাঁতবস্ত্রের শো-রুমগুলোতে ভিড় নেই। দোকানিরা নতুন নতুন ডিজাইনের কাপড়ের পসরা সাজালেও ক্রেতাদের উপস্থিতি ছিল একেবারেই কম। একই অবস্থা এনায়েতপুর ও বেলকুচি কাপড়ের হাটের।

নিউমার্কেট হাটের লিটন বস্ত্রালয়ের মালিক উজ্জ্বল মালাকার বাংলানিউজকে জানালেন, কিরণমালা, রাই কিশোরী, পাখি জামা আর থ্রি-পিসের প্রভাবে আমাদের ব্যবসা লাটে উঠতে শুরু করেছে। পাশাপাশি আমদানি ও চোরাইপথে বিপুল পরিমাণ ভারতীয় শাড়ি আসার কারণে ধস নামতে শুরু করেছে তাঁতশিল্পে।

একই হাটেররাজীব ব্রাদার্সের স্বত্ত্বাধিকারী আলহাজ আব্দুল আলীম বাংলানিউজকে জানান, শিহাব ক্লথ সোসাইটির আব্দুল হাকিমসহ অধিকাংশ তাঁতকাপড় বিক্রেতারা বাংলানিউজকে জানান, গত বছর ছিল, পাখি আর ঝিলিক। এবার বাজারে এসেছে রাইকিশোরী, কিরণমালা, ইষ্টিকুটুমসহ ভারতীয় সিরিয়ালের নায়ক-নায়িকাদের নামে জামা।

কিশোরী তরুণী থেকে শুরু করে গৃহবধূ এমনকি প্রবীণদেরও ঝোঁকও ওইসব পোশাকের দিকে। এসব পোষাকের কারণে শাড়ির প্রতি চাহিদা কমে যাচ্ছে।

এনায়েতপুরের মিটন কটেজ লি. এর স্বত্ত্বাধিকারী হাজী শফিকুল ইসলাম শফি বাংলানিউজকে জানান, এখন পর্যন্ত উৎপাদিত কাপড়ের ১৫ ভাগও বিক্রি করতে পারিনি। এ অবস্থা চলতে থাকলে শ্রমিকদের বেতনও দিতে পারবো না।

অপরদিকে, শহরের বিভিন্ন বস্ত্রালয় ঘুরে দেখা গেছে, সব বয়সী নারী ক্রেতাদের প্রচণ্ড ভিড়। প্রতিদিন লাখ লাখ টাকার থ্রি-পিস ও জামা বিক্রি হচ্ছে এসব দোকানে। তবে, সবেচেয়ে বেশি বিক্রি হচ্ছে কিরণমালা জামা। এর নিচেই রয়েছে রাই কিশোরী, ইষ্টি কুটুম এবং পাখি জামা। পাশাপাশি বিভিন্ন ডিজাইনের থ্রি-পিসেরও চাহিদা রয়েছে।

নিউ মার্কেটের নন্দীনী থ্রি-পিস কর্ণারের স্বত্ত্বাধিকারী আসমা পারভীন বাংলানিউজকে জানান, গতবারের তুলনায় এবার ভারতীয় সিরিয়ালের নায়িকাদের নামে পোষাক বিক্রি হচ্ছে বেশি।

রফিক বস্ত্রালয়ের স্বত্ত্বাধিকারী রফিকুল ইসলাম বাংলানিউজকে জানান, নারীদের পাশাপাশি পুরুষরাও কিনছে ভারতীয় সিরিয়ালের নায়কদের নামে বের হওয়া পোষাক। এর মধ্যে অরবিন্দ শার্ট বেশি চলছে বলে তিনি জানান।

সিরাজগঞ্জ পাওয়ারলুম অ্যান্ড হ্যান্ডলুম তাঁতমালিক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হাজী আব্দুল বাকী বাংলানিউজকে জানান, সিরাজগঞ্জের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে তাঁতশিল্পটি অত্যাধিক গুরুত্বপূর্ণ। এখন যে অবস্থায় দাঁড়িয়েছে তাতে এ শিল্প টিকিয়ে রাখাই দায় হয়ে পড়েছে।

একদিকে রঙ, সুতা আর মুজুরীর দাম দিন দিন বাড়ছে অন্যদিকে বাজারে চাহিদা দিন দিন কমছে। ফলে সব মিলিয়ে হুমকির মুখে পড়ছে তাঁত শিল্প।

তিনি আরও জানান, লাখ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে তাঁতমালিকরা বস্ত্র উৎপাদন করছে। এসব বস্ত্র না বিক্রি করতে পারলে ঋণের দায়ে অনেককেই ব্যবসা ছেড়ে পথে এসে দাঁড়াতে হবে।

বাংলাদেশ সময়: ২১১০ ঘণ্টা, জুলাই ১১, ২০১৫
পিসি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।