খুলনা: এক সময়ের মৃতপ্রায় মংলা আর রুগ্ন শিল্পনগরী খুলনায় এখন উন্নয়নের সুবাতাস বইছে। অবকাঠামোগত উন্নয়নের ফলে মংলা বন্দর দ্রুত আধুনিকায়নের দিকে অগ্রসর হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, পদ্মাসেতু, খানজাহান আলী বিমান বন্দর, খুলনা-মংলা রেল লাইন, সাইলো নির্মাণ কাজ শেষ হলে মংলায় বিপুল পরিমাণ দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি হবে। এতে মংলাসহ খুলনার অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধিত হবে।
তাদের মতে, এসব কাজ শেষ হলে রাজধানীর ঢাকা কাছে চলে আসবে। এ কারণে মংলাসহ খুলনাঞ্চলের অপেক্ষাকৃত সস্তা শ্রম এবং সস্তা জমির সহজলভ্যতার সুবিধায় ক্ষুদ্র, মাঝারি এবং বৃহৎ শিল্প বিনিয়োগ, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ড ব্যাপকভাবে বাড়বে।
২০০৯ সালের শুরুতেই দক্ষিণ ও দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়নে যথাযথ ভূমিকা রাখার প্রয়াসে মংলা বন্দরের উন্নয়নের দিকে সরকার বিশেষ গুরুত্ব ও নজর দেয়। মৃতপ্রায় মংলা বন্দরকে কার্যক্ষম ও কর্মচঞ্চল করার লক্ষ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়।
সূত্রে জানা যায়, মংলা বন্দরের উন্নয়নে (২০০৮-০৯ হতে ২০১৪-১৫) বর্তমান সরকার অগ্রাধিকার ও বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করে। বন্দর উন্নয়নের জন্য এ সরকারের আমলে মোট ৫২২ কোটি ২৩ লক্ষ টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে ৮টি উন্নয়ন প্রকল্প ও ৪টি উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের কাজ হাতে নেয়া হয়। যার মধ্যে ৫টি উন্নয়ন প্রকল্প এবং ৪টি উন্নয়ন কর্মসূচি ইতোমধ্যে সমাপ্ত হয়েছে এবং ৩টি প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন আছে। এছাড়া মংলা বন্দরের আরও উন্নয়নের জন্য ৩টি প্রকল্প এবং ৫টি উন্নয়ন কর্মসূচি অনুমোদনের প্রক্রিয়াধীন আছে।
মংলা বন্দর ব্যবহারকারীদের দক্ষ ও দ্রুত সেবা প্রদানের লক্ষ্যে বিভিন্ন উন্নয়ন কার্যক্রমের আওতায় নিম্নবর্ণিত সুবিধাদি সৃষ্টি করা হয়েছেঃ
* মংলা বন্দরে মালামাল দ্রুত ও দক্ষতার সাথে হ্যান্ডলিং এর জন্য ২টি স্ট্রাডেল ক্যারিয়ার, ৬টি ফর্কলিফট ট্রাক, ২টি টার্মিনাল ট্রাক্টর ও ২টি কন্টেইনার ট্রেইলর সংগ্রহ করা হয়েছে।
* সিডর’২০০৭ এ ক্ষতিগ্রস্ত জ্যাফর্ড পয়েন্টে লাইট টাওয়ার পুনঃনির্মাণসহ বন্দরের বিভিন্ন ক্ষতিগ্রস্ত স্থাপনাদি পুনর্বাসন/পুনঃ নির্মাণ করা হয়েছে।
* মংলা বন্দরে দিবারাত্রি নির্বিঘ্নে জাহাজ আগমণ ও নির্গমনের জন্য ৬২টি বিভিন্ন ধরনের লাইটেড বয়া, ২টি রোটেটিং বিকন এবং ৬টি জিআরপি লাইট টাওয়ার ও আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি সংগ্রহ করে এসব মংলা বন্দরের পশুর চ্যানেলে স্থাপন করা হয়েছে।
* মংলা বন্দরের পশুর চ্যানেলের ক্যাপিটাল ড্রেজিং এর অর্জিত সাফল্য ধরে রাখা এবং নব্যতা সংরক্ষণের জন্য নিয়মিত ড্রেজিং কার্য পরিচালনার জন্য ১টি ক্রেন বোট, ১টি হাউজ বোট, পাইপ, ফ্লোটার পাইপ সহ ১টি কাটার সাকশান ড্রেজার সংগ্রহ করা হয়েছে।
* মংলা বন্দরে আগত জাহাজ হ্যান্ডলিং এর লক্ষ্যে মংলা হতে হিরণপয়েন্ট পর্যন্ত পাইলট আনা নেয়ার নিমিত্তে ১টি পাইলট বোট ও ১টি পাইলট ডেসপাচ বোট সংগ্রহ করা হয়েছে।
* মংলা বন্দরের যান চলাচলে অনুপযোগী প্রায় ১০ কিঃমিঃ প্রধান সড়ক ও বাইপাস সড়ক মেরামত ও উন্নয়ন করা হয়েছে।
* মংলা বন্দরের মাধ্যমে আমদানিকৃত গাড়ি রাখার জন্য সংযোগ সড়কসহ ২টি ইয়ার্ড নির্মাণ করা হয়েছে।
* মংলা বন্দরের বিভিন্ন স্থাপনায় ৮০ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিতরণের জন্য সৌর প্যানেল স্থাপন করা হয়েছে।
এছাড়া মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের নিজস্ব অর্থায়নে
* রুজভেল্ট জেটিতে নিজস্ব অর্থায়নে মোট ১ কোটি ৯০ লক্ষ ৯০ হাজার টাকা ব্যয়ে ২টি পন্টুন ও ২টি গ্যাংওয়ে এবং ৫৬.৭৫ লক্ষ টাকা ব্যয়ে পশুর চ্যানেলে ৬টি মুরিং বয়া স্থাপন করা হয়েছে।
* ৩ টন ক্ষমতা সম্পন্ন ৫টি ফর্কলিফট ট্রাক, ৩০ টন ক্ষমতা সম্পন্ন একটি মোবাইল ক্রেন, ২টি টার্মিনাল ট্রাক্টর, ২টি টার্মিনাল ট্রেইলর এবং ৯ টন ক্ষমতা সম্পন্ন ১টি ফর্কলিফট সংগ্রহ করা হয়েছে।
চলমান উল্লেখযোগ্য প্রকল্পসমূহ
* বন্দরে ৭.৫ মিটার ড্রাফটের জাহাজ বন্দরে নির্বিঘ্নে প্রবেশের জন্য পশুর চ্যানেলের হারবার এলাকায় মোট ৩৪.০৬ লক্ষ ঘনমিটার ড্রেজিং কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এই কাজে ১১১ কোটি ৮৫ লক্ষ টাকা ব্যয় হবে। ইতোমধ্যে ৭০ কোটি ৬৫ লক্ষ টাকার বিল পরিশোধ করা হয়েছে।
* বন্দরের মুরিং এলাকায় ৯ মিটার ড্রাফটের জাহাজ আগমণ নির্গমণের লক্ষ্যে পশুর চ্যানেলের আউটার বারে গভীরতা বৃদ্ধির নিমিত্তে মোট ৪৩.৫২ লক্ষ ঘনমিটার ড্রেজিং কার্য সম্পাদনের জন্য ১৭৮ কোটি ৬৮ লক্ষ টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে একটি প্রকল্পের আরডিপিপি অনুমোদনের প্রক্রিয়াধীন আছে।
* ভারত সরকারের অর্থায়নে ১০৪ কোটি ২৬ লক্ষ টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে আনুসঙ্গিক সুবিধাদিসহ ১টি ড্রেজারের নির্মাণ কাজ চলছে।
অনুমোদিত নতুন প্রকল্প
* মংলা বন্দরে ক্রমবর্ধমান কন্টেইনার ও কন্টেইনারজাত পণ্য দ্রুত ও দক্ষতার সাথে হ্যান্ডলিং এর জন্য ৮৭ কোটি ৫৬ লক্ষ টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে মংলা বন্দরের জন্য কন্টেইনার ও কার্গো হ্যান্ডলিং যন্ত্রপাতি সংগ্রহ শীর্ষক প্রকল্পটি গত ২৪/০৬/২০১৪ তারিখে একনেক কর্তৃক অনুমোদিত হয়েছে। প্রকল্পটির অধীনে বিভিন্ন ধরণের ২২টি কন্টেইনার ও কার্গো হ্যান্ডলিং যন্ত্রপাতি সংগ্রহ করা হবে।
এ সব উন্নয়ন প্রকল্পের ব্যাপারে মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, বন্দরের অবকাঠামোগত অনেক উন্নয়ন হওয়ায় ইতিমধ্যে নেপাল, ভুটান ও ভারত আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে মংলা বন্দর ব্যবহারে আগ্রহী হয়েছে। ৬ জুন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরকালে মংলা বন্দর ব্যবহার বিষয়ে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। এছাড়া ভুটান ও নেপালের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
তিনি বলেন, মংলা বন্দর এলাকায় ২০৫ একর জমিতে নতুন অর্থনৈতিক জোন প্রতিষ্ঠা, রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু, খানজাহান আলী বিমান বন্দর নির্মাণ, খুলন-মংলা রেল লাইন স্থাপন ও ২০১৮ সালের মধ্যে পদ্মা সেতু নির্মাণ বাস্তবায়নের মাধ্যমে মংলা বন্দর কেন্দ্রীক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাবে।
মংলা বন্দর ব্যবহারকারী সমন্বয় কমিটির মহাসচিব অ্যাডভোকেট সাইফুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, খুলনা-মংলা রেললাইন নির্মাণ হলে নেপাল, ভূটানসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রের সাথে দক্ষিণাঞ্চলের যোগাযোগ রাখা সহজ হবে। এতে এ অঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নয়ন হবে।
তিনি আরও বলেন, দ্বিতীয় সমুদ্র বন্দর মংলার সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন হলে বিশ্ববিখ্যাত ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবনে পর্যটক বাড়বে। এতে বাড়বে রাজস্ব।
বাগেরহাট-৩ আসনের (রামপাল-মংলা) সংসদ সদস্য তালুকদার আব্দুল খালেক বাংলানিউজকে বলেন, ২০০৯ সালের শুরুতেই দক্ষিণ ও দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়নে যথাযথ ভূমিকা রাখার প্রয়াসে মংলা বন্দরের উন্নয়নের দিকে সরকার বিশেষ গুরুত্ব ও নজর দেয়।
তিনি আরও বলেন, ২০১৮ সালে খুলনায় হবে অর্থনৈতিক জোন। এই অর্থনৈতিক জোনকে শক্তিশালী করতে খানজাহান আলী বিমান বন্দর স্থাপন এবং পদ্ম সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে। এটা কোন আশার বাণী বা স্বপ্ন নয়; এটি এখন বাস্তবতা মাত্র।
তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চলতি বছরের ৫ মে একনেকের বৈঠকে বিমান বন্দরের জন্য ৫৪৪ কোটি ৭৫ লাখ টাকার অনুমোদন দিয়েছেন। বিমান বন্দরের পাশাপাশি খুলনায় অত্যাধুনিক রেলস্টেশন নির্মাণ হচ্ছে এবং একই ধারাবাহিকতায় মংলার সাথে খুলনাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে রেল যোগাযোগের লক্ষ্যে খুলনা-মংলা রেললাইন নির্মান করা হচ্ছে। এর মধ্যে রেল সেতুও নির্মাণ করা হবে।
খুলনা-২ আসনের সংসদ সদস্য খুলনা মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান মিজান বলেন, বর্তমান সরকারের আমলে মংলা ও মৃত প্রায় শিল্প নগরী খুলনার ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। ইতমধ্যে কয়েকটি জুট মিল চালু হয়েছে। অন্যান্য শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোও পর্যায়ক্রমে চালু করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
এছাড়া আধুনিক রেল স্টেশন, শিল্পকলা একাডেমি ভবন, পাইপ লাইনের মাধ্যমে গ্যাস সংযোগ, খুলনা-কলকাতা রেল লাইন, খুলনা-মংলা সড়ক, মংলা বন্দর আধুনিকায়ন, পুর্ণঙ্গ টেলিভিশন সেন্টার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সরকারিকরণ, আইটি ভিলেজ, মেরিন একাডেমিসহ যে সকল উন্নয়নের দাবিতে খুলনাবাসী দীর্ঘ সময় ধরে আন্দোলন সংগ্রাম করে আসছেন সেসকল বিষয়ের উন্নয়ন সরকারও চান। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী এ ব্যাপারে খুবই আন্তরিক।
বাংলাদেশ সময়: ০৮২৫ ঘণ্টা, জুলাই ২৭, ২০১৫
এমআরএম/আরআই