ঢাকা: অ্যাপল, জিয়াওমিসহ স্মার্টফোন কোম্পানিগুলোর দাপটে গত বছর থেকে মোবাইল বাজারে কোণঠাসা দক্ষিণ কোরিয়ার প্রযুক্তি পণ্য নির্মাতা প্রতিষ্ঠান স্যামসাং। মোবাইল ব্যবসা মুখ থুবড়ে পড়ায় এ প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশ থেকেও তাদের ব্যবসা ধীরে ধীরে গুটিয়ে নিচ্ছে।
এসব অভিযোগের স্তূপ জমা পড়েছে বাংলানিউজে। অভিযোগ অনুযায়ী, লভ্যাংশ কমতে থাকায় দিশেহারা হয়ে উঠেছে স্যামসাং। এ কারণে আগে থেকেই শুল্ক-রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে আসা স্যামসাং নতুনভাবে শুরু করেছে নির্বিচারে কর্মী ছাঁটাই ও শ্রম আইন লঙ্ঘন।
প্রাতিষ্ঠানিক হিসাব মতে, পুরো বিশ্বে স্যামসাংয়ের প্রায় ৩৩টি রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আরঅ্যান্ডডি) সেন্টার রয়েছে। ২০১০ সালে বাংলাদেশে আরঅ্যান্ডডি সেন্টার প্রতিষ্ঠা করে স্যামসাং। শুরুতে মাত্র কয়েকজন ইঞ্জিনিয়ার নিয়ে যাত্রা করলেও ধীরে ধীরে এ সংখ্যা বাড়তে থাকে। ২০১৪ সালের জুন নাগাদ স্যামসাং রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ইন্সটিটিউট বাংলাদেশ লিমিটেড বা এসআরবিডির নিয়োগপ্রাপ্ত ইঞ্জিনিয়ার সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ৬৫০ এ। কিন্তু গত বছরের শেষ দিক থেকে মোবাইল ব্যবসা মুখ থুবড়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই অনিয়মের অভিযোগ উঠতে থাকে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে।
সে বছর থেকে প্রতিদিনই স্যামসাংয়ের লভ্যাংশ কমতে থাকায় প্রতিষ্ঠানটি তাদের খরচ কমাতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়। যেমন- গত ৬ মাসের মধ্যে স্যামসাং তাদের ফিলিপাইন রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট সেন্টারসহ দু’টি আরঅ্যান্ডডি বন্ধ করে দেয়। বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠাতে থাকে অনেক কর্মীকে। এমনকি স্যামসাংয়ের মোবাইল শাখার প্রধান জেকে শিনকেও এ বছর বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হচ্ছে। ওই বছরের জুন-জুলাই থেকে প্রতিষ্ঠানটি তাদের এসআরবিডি সেন্টারের কাজ ভিয়েতনাম এবং ভারতে স্থানান্তর করতে শুরু করে। আর অক্টোবর থেকে বাধ্যতামূলকভাবে অবসরে পাঠাতে শুরু করে ইঞ্জিনিয়ারদের।
একসময় কারওয়ান বাজারের ‘মোনেম বিজনেস ডিস্ট্রিক্ট’ ভবনে ৩, ৪, ৫, ৬, ৭ ও ৮ তলায় এসআরবিডির অফিস থাকলেও গত ৩০ জুন ৭, ৮ তলা ছেড়ে দিয়েছে। আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই ৬ তলা ছেড়ে দেবে। গত বছরের জুনে এসআরবিডি ৬৫০ জন ইঞ্জিনিয়ার থাকলেও এ মুহূর্তে আছে ৩৮০ ইঞ্জিনিয়ার। আগামী ১০ আগস্টের মধ্যে বাধ্যতামূলক অবসনের পাঠানো হচ্ছে আরও ১২৮ ইঞ্জিনিয়ারকে।
স্যামসাং কেবল ‘বাধ্যতামূলক অবসরের’ নামে নির্বিচারে শ্রমিক ছাঁটাই-ই করছে না। খোদ প্রতিষ্ঠানটির বাংলাদেশ আরঅ্যান্ডডি সেন্টারের ম্যানেজমেন্টের বিরুদ্ধেও কিছু অসাধু চর্চার অভিযোগ পাওয়া গেছে-
রাজস্ব ফাঁকি
সারা বিশ্বে স্যামসাংয়ের প্রায় পাঁচ লাখ কর্মী রয়েছে। ২০১৩ সালে স্যামসাং সারা বিশ্ব থেকে তিনজন কর্মীকে ‘বছরের সেরাকর্মী’ ঘোষণা করে। এদের মধ্যে বাংলাদেশের আরঅ্যান্ডডি সেন্টারেরও একজন ছিলেন। জানা যায়, তিনি বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রায় আট কোটি টাকা ‘রাজস্ব’ ফাঁকি দিয়ে বাঁচিয়েছেন স্যামসাংকে। এ প্রক্রিয়া এখনো চালু রয়েছে।
শ্রম আইন লঙ্ঘন
বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হলে বাংলাদেশ সরকারের শ্রম আইনের ১৬, ২০, ২৬ এবং অন্যান্য ধারা অনুসারে যেসব সুবিধাদি একজন কর্মী পাওয়ার কথা সেসব সুবিধা না দেওয়ার জন্য স্যামসাং ভয়ভীতি প্রদর্শনের পন্থা অবলম্বন করে। ভীতি প্রদর্শনের পন্থায় প্রায়ই প্রত্যেক কর্মীকে (যাদের এসআরবিডি ছাটাই করতে চায়) আলাদা ডেকে চাকরি ছেড়ে দেওয়ার জন্য বলে এবং তাদের উপর বিভিন্নভাবে মানসিক চাপ সৃষ্টি করে। শ্রম আইন না জানার কারণে অনেকেই ম্যানেজমেন্টের চাপ সহ্য করতে না পেরে চাকরি ছেড়ে দেন। এর ফলে তাদের কোনো অতিরিক্ত মাসের বেতন না নিয়েই চলে যেতে হয়।
শুল্ক ফাঁকি
স্যামসাং বাংলাদেশ প্রধানত কাজ করে মোবাইল নিয়ে। যদিও কিছু টেস্টিং, আইওটি, স্মার্ট টিভি, অ্যাগিরদম উন্নয়ন, ইমেজ প্রসেসিং ইত্যাদির কাজও হয়। এসব কাজের জন্য প্রতি মাসেই অনেক কর্মীকে দক্ষিণ কোরিয়ায় পাঠানো হয়। ওই কর্মীরা দেশে আসার সময় ম্যানেজমেন্টের নির্দেশে এসআরবিডির জন্য প্রত্যেকেই ৩-১৪টি মোবাইল ফোন এবং বিভিন্ন ইলেক্ট্রনিক সামগ্রী আনতে বাধ্য হন। এই কারণে হ্যান্ডব্যাগ, লাগেজ, ব্যাকপ্যাক করে এসব মোবাইল এবং ইলেক্ট্রনিক সামগ্রী শুল্ক ফাঁকি দিয়ে আনতে কর্মীরা বাধ্য হয়। এসআরবিডি‘র কৌশলে বাংলাদেশ সরকার প্রতি বছর হারায় বিশাল অংকের শুল্ক।
স্যামসাংয়ের অপ্রাসঙ্গিক পরীক্ষা
এসআরবিডির প্রায় সব ইঞ্জিনিয়ারই বুয়েট, কুয়েট, রুয়েট, চুয়েট, ঢাবি, জাবি এবং শাবিপ্রবি থেকে পাস করা। তাদের নিয়োগের সময় কয়েক স্তরে পরীক্ষা নেওয়া হয়। তারপরও কিছুদিন আগ থেকে স্যামসাং তার ইঞ্জিনিয়ারদের মেধা যাচাইয়ের জন্য এক পরীক্ষা পদ্ধতি চালু করে। ওই পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য ইঞ্জিনিয়ারদের কোনো সময়ই দেওয়া হয় না। পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে গিয়ে কাজের কিছু দেরি হলে ম্যানেজমেন্টের শীর্ষ পর্যায় থেকে কৈফিয়ত চাওয়া হয়, কাজে কেন দেরি হচ্ছে; আবার পরীক্ষায় প্রস্তুতির অভাবে খারাপ করা হলেও কৈফিয়ত চাওয়া হয় পরীক্ষায় কেন খারাপ ফল আসছে। যেমন গত ২২ জুলাই একটি পরীক্ষা নেওয়া হয়। ওই পরীক্ষায় ২৫৫ জন অংশ নিয়ে ৬ জন পাস করে এবং বাকি ২৪৯ জন ফেল করে। অনেকে বলছেন, স্যামসাং এটা ইচ্ছাকৃতভাবে করছে, যেন এতে ইঞ্জিনিয়াররা দমে থাকেন।
জোরপূর্বক অ্যাগ্রিমেন্ট সাইন
প্রতিবছর মার্চ মাসে প্রত্যেক কর্মীর কাছ থেকে বিভিন্ন নতুন নতুন চুক্তিতে (অ্যাগ্রিমেন্টে) জোরপূর্বক সই (সাইন) করতে বাধ্য করা হয় স্যামসাংয়ে। সই না করলে বেতন দেওয়া বন্ধ করে দেওয়া হয়। এই বেতন বন্ধের ভয়ে সবাই অ্যাগ্রিমেন্ট সাইন করতে বাধ্য হয়।
সংবাদপত্র এবং টিভি মিডিয়া পরিহারের নির্দেশ
স্যামসাংয়ে অলিখিত নির্দেশনা আছে, প্রতিষ্ঠানটির কোনো কর্মী সংবাদপত্র এবং টিভি মিডিয়ায় এসআরবিডি সম্পর্কিত কোনো তথ্য দিলে কর্মীকে চাকরিচ্যুত করা হবে। চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন এমন কোনো কর্মী স্যামসাংয়ের বিরুদ্ধে কিছু অভিযোগ থাকলে সরাসির এসআরবিডি কর্তৃপক্ষকে জানানোর নির্দেশনা রয়েছে, এর বাইরেও সংবাদপত্রের কাছে গেলে তার বিরুদ্ধে মামলা করার হুমকিও দেওয়া হয়।
৫ দিনে ১২৮ কর্মী ছাটাই
আগামী ২৯ জুলাই থেকে ৩১ জুলাই এসআরবিডিতে ১২৮ কর্মী ছাটাইয়ের প্রক্রিয়া চলছে। এক্ষেত্রেও সরকারের শ্রম আইন মানা হচ্ছে না। প্রত্যেক কর্মীকে দেওয়া হচ্ছে নাম সর্বস্ব প্যাকেজ। ওই প্যাকেজে কী থাকবে সেটা মৌখিকভাবে কোম্পানির মধ্যে প্রচার করা হয়েছে, যেন কোনো কাগুজে রেকর্ড না থাকে এবং কেউ কোম্পানির বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে না পারে।
বাংলাদেশ সময়: ১১৫৮ ঘণ্টা, জুলাই ২৭, ২০১৫
এসএইচ/এইচএ/