ঢাকা: নগরীর বিভিন্ন স্থানে সড়ক এখন বেহাল দশায়। বৃষ্টির পানিতে সড়কের উপরে বিটুমিন উঠে গেলে লাল ইটের বড় বড় টুকরো বেরিয়ে এসেছে।
বৃষ্টিতে সড়কের এই দশা হলেও সমস্যাটি মনুষ্যসৃষ্ট বলেই নিশ্চিত করছেন সংশ্লিষ্টরা। নগরবাসীও মনে করে স্রেফ অবহেলা ও অব্যবস্থাপনার কারণেই সামান্য বৃষ্টিতেই রাস্তাগুলো বেহাল হয়ে পড়ে। আর এসব কিছু হচ্ছে দেশের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা অমান্য করেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশও এক্ষেত্রে থেকে যাচ্ছে অবহেলিত।
এ নিয়ে কথা বলতে রাজধানীর তেজগাঁওয়ে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরে (সওজ) যাওয়ার পথে আহসানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের সড়কটিতেও দেখা গেলো একই বেহাল দশা।
বৃষ্টিতে সড়কের বিটুমিন উঠে বড় বড় গর্তে পরিণত হয়েছে। এতে করে সব সময় যানজট লেগেই থাকছে স্থানটিতে।
স্থানীয় বাসিন্দা দোকানদার শাওন জানান, গত বর্ষার মৌসুমে সড়কটি মেরামত করা হয়েছে। বছর না ঘুরতেই সড়কটি আগের অবস্থায় ফিরে গেছে। ’
শুধু তেজাগাঁওয়ের সড়ক নয় নগরীর প্রায় সকল সড়কের এখন একই দশা। প্রধানতম সড়ক এয়ারপোর্ট রোডের বিভিন্ন স্থানে বৃষ্টিতে বড় বড় গর্ত সৃষ্টি হয়েছে। রোকেয়া সরণি, মিরপুর সড়ক সবগুলোরই একই দশা। এসব সড়কে এখানে সেখানে পিচ ঢালাই উঠে গিয়ে ইট-পাথর বেরিয়ে এসেছে।
বছরে বছরে সড়কের এই দশার পেছনে অন্যতম কারণ হিসেবে রাস্তার পিচ ঢালাইয়ে বিটুমিনের ব্যবহারকেই চিহ্নিত করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
হিসাবগুলো বলছে প্রতিবছর স্রেফ এই কারণে সরকারের হাজার কোটি টাকা গচ্চা যাচ্ছে। তবুও অনেকে ছাড়তে পারছেন না বিটুমিনের প্রতি প্রেম।
সড়ক পরিকল্পনা ও রক্ষণাবেক্ষণ সূত্র জানা জানায়, গত চার বছরে সড়কগুলো রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামত বাবদ খরচ হয়েছে ৫ হাজার ১৮৬ কোটি টাকা। সদ্য সমাপ্ত (২০১৪-১৫) অর্থবছরেই খরচ হয়েছে ১ হাজার ৩৬৮ কোটি ৪৫ লাখ টাকা।
সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের পরিকল্পনা ও রক্ষণাবেক্ষণ বিভাগের হিসাবে দেশে বর্তমানে মোট সড়ক ও মহাসড়কের দৈর্ঘ ২১ হাজার ৩০২ দশমিক ০৮ কিলোমিটার। এর মধ্যে জাতীয় মহা-সড়কের দৈর্ঘ্য তিন হাজার ৮১২ দশমিক ৭৮ কিলোমিটার, আঞ্চলিক মহাসড়কের দৈর্ঘ্য চার হাজার ২৪৬ দশমিক ৯৭ কিলোমিটার এবং জেলা সড়কের দৈর্ঘ্য ১৩ হাজার ২৪২ দশমিক ৩৩ কিলোমিটার।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনেক আগেই কংক্রিট দিয়ে সড়ক নির্মাণের নির্দেশনা দিয়েছেন। কিন্তু সে নির্দেশ না মেনে সড়কগুলো নির্মিত হচ্ছে বিটুমিনের ব্যবহারে। প্রতিবছর বৃষ্টিতে সে বিটুমিন সহজেই ধুয়ে যায়। আর বছর বছর সড়কের বেহাল দশা সৃষ্টি হয়।
সূত্র জানায়, সরকারের রাজস্ব ও উন্নয়ন আয় থেকে সড়কগুলোর সংস্কার করা হচ্ছে প্রতি বছর।
সওজ অবশ্য এ জন্য বরাদ্দ স্বল্পতার কথা বলছে। কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে সংস্কারের জন্য বছরে মোট চাহিদা প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা হলেও এক থেকে দেড় হাজার কোটি টাকার বেশি বরাদ্দ পাওয়া যায় না। ফলে প্রতিবছরই জোড়াতালির সংস্কার চলে। আর বছর ঘুরতে আবারও আগের অবস্থায় ফিরে যায সড়কগুলো।
তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, কংক্রিট ব্যবহার না করে বিটুমিনের ব্যবহার করার কারণেই এমনটা হচ্ছে। বার্ষিক বরাদ্দকে রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কম মনে করছেন না তারা। বরাদ্দের পুরো অর্থ খরচ না করে নানা পথে তসরুপ করার কারণেই এমনটা ঘটছে বলে মত তাদের।
এদিকে পরিকল্পনা ও রক্ষণাবেক্ষণ সূত্র জানায়, প্রতি অর্থবছরের সড়ক রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বর্ষার কারণে সৃষ্ট ক্ষতিতেই চারভাগের তিন ভাগ অর্থ খরচ করা হয়।
সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগের পরিকল্পনা ও রক্ষণাবেক্ষণ উইংয়ের এক ঊর্ধতন কর্মকর্তা বাংলানিউজকে বলেন, সাধারণত বর্ষার কারণে বিটুমিনের সড়ক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
তিনি বলেন, ‘আমরা পরিশ্রম করে যদি একবার কংক্রিকেটর সড়ক তৈরি করতে পারি তবে ২০ থেকে ২৫ বছর সড়ক মেরামত করতে হবে না। ’
কংক্রিটের রাস্তার গুরুত্ব তুলে ধরে পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, আমরা কংক্রিটের রাস্তা তৈরি করতে পারলে খরচ অনেক কমে আসবে। সড়ক দুর্ঘটনাও কমবে।
বিশ্নের বিভিন্ন দেশে যদি কংক্রিটের রাস্তা হতে পারে তবে আমরা কেন পারব না? এমন প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, বৃষ্টির পানিতে বিটুমিনের সড়ক দ্রুত নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। প্রতিনিয়ত দেশের আর্থিক অপচয়ও হচ্ছে। আসুন আমরা কংক্রিটের সড়ক তৈরি করি।
কংক্রিটের সড়ক হলে দেশে দুর্ঘটনাও কম ঘটবে বলে মত পরিকল্পনা মন্ত্রীর। তিনি বলেন, বিটুমিনের সড়কে দ্রুত সময়ে পরিবহনের টায়ার নষ্ট হয়ে যায়। যানবাহন ব্রেক ফেল করে। এর ফলে প্রতিনিয়তই দুর্ঘটনা ঘটছে।
তিনি বলেন, আমাদের কংক্রিটের সড়কে যেতেই হবে, কারণ প্রধানমন্ত্রী আমাদের সে নির্দেশ দিয়েছেন।
এ বিষয়ে ঢাকার দুই মেয়র আনিসুল হক ও সাঈদ খোকনের সঙ্গে আলোচনা করেছেন বলেও জানান পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।
নগরীর আগারগাঁও থেকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় পযর্ন্ত বর্ধিত পুরাতন বিমানবন্দর সংলগ্ন সড়ক দ্রুত সময়ের মধ্যে কংক্রিটের হবে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
এই বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য (সচিব) আরাস্তু খান বাংলানিউজকে বলেন, মন্ত্রী(আ হ ম মুস্তফা কামাল) নগরীতে স্বল্প পরিসরে হলেও কংক্রিটের সড়কের সুফল দেখতে চান সেই লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের এক পাশ কংক্রিটের সড়ক হবে। স্থানীয় মেয়রকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে যাতে করে এই স্থানে কংক্রিকেটর সড়ক তৈরি করা হয়। ’
২০১০ সাল থেকে বিটুমিন ও কংক্রিটের সড়ক নিয়ে গবেষণা করে আসছেন পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের পুর প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মো. শামসুল হক।
তিনি কংক্রিটের সড়কের গুরুত্ব তুলে ধরে বাংলানিউজকে বলেন, বিটুমিনের ফ্লেক্সিবল পেভমেন্টের চেয়ে কংক্রিটের রিজিড পেভমেন্টই সময়োপযোগী ও সাশ্রয়ী। এ ধরনের সড়কের স্থায়িত্ব প্রায় ৫০ বছর। নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ করলে আরো বহু বছর তা ব্যবহার করা যায়।
বিটুমিন সড়কের আয়ুষ্কাল সর্বোচ্চ ১০ বছর বলে জানিয়ে এই বিশেষজ্ঞ বলেন, বিটুমিন সড়কের চারটি স্তর থাকলেও তা শুধু ওপরের স্তরকেই আঁকড়ে রাখতে পারে। পক্ষান্তরে রিজিড পেভমেন্টের কংক্রিট তার সব উপাদানের মধ্যে দৃঢ় বন্ধন সৃষ্টি করে বলে অবকাঠামো সহজে নষ্ট হয় না।
বিটুমিনের প্রলেপে তৈরি সড়ক দ্রুত নষ্ট হলেও একই সড়কে একটি সেতু কংক্রিটে নির্মিত থাকে বলে ৩০-৪০ বছরেও তা নষ্ট হয় না। ’
তিনি আরও বলেন, দেশের ৯৯ ভাগ সড়কই বিটুমিনের, যে কারণে বর্ষার সময় সকল সড়কই দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়। পানি ও ওভারলোডিং বিটুমিনের সড়কের প্রধান শত্রু।
অধ্যাপক শামসুল হক বলেন, আমি বিজ্ঞানসম্মতভাবে গবেষণা করে দেখেছি, খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে মহাসড়কগুলো কংক্রিটের করা দরকার। সরকার আমার কাছ থেকে এই বিষয়ে মতামত চেয়েছে আমি উচ্চ পর্ায়ে মতামত দিয়েছি দ্রুত সময়ের মধ্যে কংক্রিকেটর সড়ক করতে হবে।
বর্তমানে পাশের দেশ ভারতও কংক্রিটের সড়কের দিকে ঝুঁকছে, বলে জানান এই বিশেষজ্ঞ।
কংক্রিটের সড়কের গুরুত্ব তুলে ধরতে শামসুল হক বলেন, যত বৃষ্টি হবে কংক্রিটের সড়ক তত বেশি টেকসই হবে। সড়ক দূর্ঘটনাও কম ঘটবে।
তিনি বলেন, বিটুমিনের সড়কে দূর্ঘটনা বেশি হওয়ার কারণ এই সড়ক খুবই কালো দেখায়। রাতের বেলায় বিটুমিনের সড়ক আলো শোষণ করে নেয় ফলে দূরের বাঁক ও ছোট গর্ত চালকরা দেখতে পান না। যে কারণে প্রায়ই মহাসড়কে দুর্ঘটনা ঘটে। কিন্তু কংক্রিটের সড়কে দূর্ঘটনা কম ঘটবে। কংক্রিটের সড়ক সাদাটে। এতে যানবাহনের আলো পড়লে আরও বেশি উজ্জ্বল দেখায়। দূরের বাঁক ও গর্ত খুব সহজেই চোখে পড়ে চালকদের।
সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও কেন এই বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না এমন প্রশ্নের জবাবে কংক্রিট ও বিটুমিন গবেষক বলেন, আমি শিক্ষক মানুষ সরাসরি অনেক কথা বলতে পারি না। তবে কারোর হয়তো অন্য কোনো উদ্দেশ্য থাকতে পারে, যে কারণে বিটুমিনের সড়কের মায়া অনেকে ছাড়তে পারছেন না!’
বাংলাদেশ সময়: ১১৫৬ ঘণ্টা, জুলাই ৩০, ২০১৫
এমআইএস/এমএমকে