ঢাকা, শুক্রবার, ১৬ কার্তিক ১৪৩১, ০১ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ রবিউস সানি ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

দাবির টাকা দেয় না জীবন বিমা কর্পোরেশন!

সাঈদ শিপন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২০৬ ঘণ্টা, আগস্ট ৩, ২০১৫
দাবির টাকা দেয় না জীবন বিমা কর্পোরেশন!

ঢাকা: বছরের পর বছর চরম অব্যবস্থাপনা ও অনিয়মের মধ্য দিয়ে চলছে দেশের একমাত্র সরকারি জীবন বিমা প্রতিষ্ঠান জীবন বিমা কর্পোরেশন। গ্রাহকের বিমা দাবির টাকাও ঠিকমতো পরিশোধ করছে না প্রতিষ্ঠানটি।



সর্বশেষ ২০১৪ সালের হিসাব (প্রভিশনাল) অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠানটিতে ৫৬ হাজার ৬৮৬টি বিমা দাবি অনিষ্পত্তিকৃত অবস্থায় আছে। অর্থাৎ বছরটিতে এই সরকারি জীবন বিমা প্রতিষ্ঠানটি ৫৬ হাজার ৬৮৬ জন গ্রাহককে বিমা দাবির টাকা দেয়নি। টাকার অঙ্কে এই বিমা দাবির পরিমাণ ২ হাজার ৫৬৬ কোটি।

আগের বছর ২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠানটির অনিষ্পত্তিকৃত বিমা দাবির সংখ্যা ছিলো ৫৭ হাজার ৩৪৯টি। টাকার অঙ্কে যার পরিমাণ ২ হাজার ৫১৯ কোটি। ২০১২ সালে প্রতিষ্ঠানটির অনিষ্পত্তিকৃত বিমা দাবির সংখ্যা ছিলো ৫০ হাজার ৯৫০টি। টাকার অঙ্কে যার পরিমাণ ১ হাজার ৯৯৩ কোটি।

অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো বিমা নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) এক প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। প্রতিবেদনের তথ্য আইডিআরএকে জীবন বিমা কর্পোরেশন থেকেই সরবরাহ করা হয়েছে।

বিমা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আইন লঙ্ঘন করে প্রতিবছর গ্রাহকের মোটা অঙ্কের টাকা অবৈধভাবে ব্যয় করা, ভুয়া এজেন্ট দেখিয়ে কোম্পানি থেকে টাকা তুলে নেওয়াসহ উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অদক্ষতার কারণেই প্রতিষ্ঠানটির এ অবস্থা।

ভুয়া এজেন্ট থাকার বিষয়টি আইডিআরএর কাছে স্বীকার করেছেন খোদ জীবন বিমা কর্পোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ মান্নান।

তিনি আইডিআরএকে বলেছেন, প্রতিষ্ঠানটিতে ৫০ হাজারের উপর এজেন্ট কর্মরত আছে। তবে এদের বেশির ভাগই নামমাত্র এজেন্ট। মূলত যারা কাজ করছেন তারা অন্যদের নাম ব্যবহার করে কমিশন নিচ্ছেন।

তবে বড় অঙ্কের বিমা দাবি অনিষ্পত্তি থাকা ও ভুয়া এজেন্টের বিষয়ে বাংলানিউজের পক্ষ থেকে জীবন বিমা কর্পোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ মান্নানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি।

এ বিষয়ে তিনি বলেন, বিষয়টি আমার পিএস বলতে পারবে। সে এখন নেই। তাই এ বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারছি না।

এদিকে অর্থ মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠানটিতে ৫১ হাজার ৬৮৩ জন এজেন্ট রয়েছে। এরমধ্যে নারী এজেন্টের সংখ্যা ১৭৪ জন।

তবে কর্পোরেশনটির এজেন্টদের বিষয়ে আইডিআরএ’র কাছে যে তথ্য আছে তাতে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটিতে ৬ হাজার ৭১৪ জন এজেন্ট কাজ করছে এবং তাদের তত্ত্বাবধানের জন্য কোন এমপ্লয়ার অব এজেন্ট নেই।

প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সালে প্রতিষ্ঠানটির প্রথম বর্ষ প্রিমিয়াম আয় হয়েছে ৬৭ কোটি টাকা। যা ২০১৩ সালে ছিলো ৬০ কোটি টাকা। অর্থাৎ ২০১৪ সালে প্রতিষ্ঠানটির প্রথম বর্ষ প্রিমিয়াম আয় বেড়েছে।

তবে নবায়ন প্রিমিয়াম আয়ের ক্ষেত্রে উল্টো চিত্র বিরাজ করছে। ২০১৪ সালে প্রতিষ্ঠানটি নবায়ন প্রিমিয়াম আয় করেছে ২ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। যা ২০১৩ সালে ছিলো ২ হাজার ৮১১ কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানটির নবায়ন প্রিমিয়াম আয় আগের বছরের তুলনায় কমেছে।

নবায়ন প্রিমিয়াম আদায়ে এ নেতিবাচক প্রবণতা ২০০৯ সাল থেকেই প্রতিষ্ঠানটিতে বিরাজ করছে। ২০০৯ সালে প্রতিষ্ঠানটি ৪৭ দশমিক ৭৭ শতাংশ নবায়ন প্রিমিয়াম আদায় করতে সক্ষম হয়। ২০১০ সালে তা কিছুটা বেড়ে দাঁড়ায় ৫৭ দশমিক ২৩ শতাংশে।

এরপর ২০১১ সালে ৩৩ দশমিক ৬০ শতাংশ, ২০১২ সালে ৪৮ দশমিক ৩৫ শতাংশ ও ২০১৩ সালে ৪৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ নবায়ন প্রিমিয়াম আদায় করতে সক্ষম হয় প্রতিষ্ঠানটি।

এদিকে ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের ক্ষেত্রেও প্রতিষ্ঠানটি প্রতিবছর বড় ধরনের অনিয়ম করছে। শেষ ৬ বছরে (২০০৯ থেকে ২০১৪) প্রতিষ্ঠানটি আইন লঙ্ঘন করে ব্যবস্থাপনা ব্যয় হিসেবে অতিরিক্ত খরচ করেছে ২৩১ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। এ টাকার ৯০ শতাংশই অর্থাৎ ২০৮ কোটি ৬৬ লাখ টাকা পলিসি গ্রাহকদের অংশ। বাকি ১০ শতাংশ বা ২৩ কোটি ১৮ লাখ টাকা সরকারের।

আইডিআরএ সূত্রে জানা গেছে, দুই বছর পর পর দায় মূল্যায়নের বিধান থাকলেও তা করছে না কর্পোরেশনটি। ২০১০ সাল থেকেই প্রতিষ্ঠানটির দায় মূল্যায়নের জন্য কোন উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। কর্পোরেশনের প্রকৃত আর্থিক অবস্থা নিরুপন ও বিক্রি করা পলিসির সঠিক বোনাস হার নির্ণয়ের জন্য এই দায় মূল্যায়ন করা হয়। ফলে দায় মূল্যায়ন না করার কারণে ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন প্রতিষ্ঠানটির গ্রাহকরা।

আইডিআরএ সূত্রটি আরও জানিয়েছে, কর্পোরেশনের উচ্চপদে নিয়োগ দেওয়া হয় মন্ত্রণালয় থেকে। তাদের বিমা সম্পর্কে ধারণা কম। আবার তারা বছর দুয়েক পরেই অন্যত্র বদলি হয়ে যান। ফলে তারা প্রত্যাশা মাফিক কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেন না।

এছাড়া প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা বাড়াতে উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের(ব্যবস্থাপনা পরিচালক, জিএম, ডিজিএম পদ মর্যদার কর্মকর্তা) নিয়মিত ফিল্ড অফিস পরিদর্শন গুরুত্বপূর্ণ হলেও জীবন বিমা কর্পোরেশনে তার প্রচলন নেই।

এ নিয়ে যোগাযোগ করা হলে আইডিআরএ’র চেয়ারম্যান এম শেফাক আহমেদ বলেন, সমস্যা সমাধানে জীবন বিমা কর্পোরেশনকে বেশকিছু দিক নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

বিমা দাবির টাকা না পাওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, কোন গ্রাহক বিমা দাবির টাকা না পাওয়ার বিষয়ে আইডিআরএ’র কাছে অভিযোগ করলে আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবো।

বাংলাদেশ সময়: ১২০৭ ঘণ্টা, আগস্ট ৩, ২০১৫
এএসএস/এন‌এস/জেডএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।