ট্যানারি শিল্প আর হাজারিবাগে থাকছে না। রাজধানীর অদূরে সাভারে বিশাল এলাকাজুড়ে গড়ে তোলা হচ্ছে চামড়ানগর।
ঢাকা: রাজধানীর হাজারীবাগের ঘনবসতিপূর্ণ এলাকার পরিবেশ বিপর্যয় রোধে ট্যানারি শিল্প অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা করে সরকার। ২০০৩ সালে তৎকালীন সরকার রাজধানীর অদূরে সাভার বলিয়াপুর উপজেলার হরিণধরায় ট্যানারি পল্লী গড়ার সিদ্ধান্ত নেয়। সে সময় সরকারের সিদ্ধান্তে বেঁকে বসে ট্যানারি মালিকরা। প্রক্রিয়াটি বন্ধ করতে উচ্চ আদালতে মামলাও করা হয়।
সব প্রতিবন্ধিকতা দূর করে বর্তমান সরকার হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি শিল্প সাভারে স্থানান্তরে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়। হাজারীবাগে ২০০ একর জমির উপর নির্মিত হচ্ছে ট্যানারি শিল্পনগর। এখানে ২০৫টি প্লটে ১৫৫টি ট্যানারি শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে।
গত ১০ আগস্ট নতুন ট্যানারি শিল্পনগর ঘুরে প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সরকার নির্ধারিত সময়ে ট্যানারি স্থানান্তর সম্ভব হচ্ছে না এবারও।
হাজারীবাগের চামড়া শিল্পে ‘এ’, ‘বি’ ও ‘সি’ এই তিন শ্রেণীর চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণ ফ্যাক্টরি রয়েছে। ‘এ’ শ্রেণীভুক্ত ফ্যাক্টরিগুলো আয়তন, মেশিনারিজ ও লোকবলের দিক থেকে বড়। আর বি ও সি শ্রেণীভুক্ত ফ্যাক্টরিগুলো এক্ষেত্রে মধ্যম ও ক্ষুদ্রাকারের ফ্যাক্টরি হিসেবে গণ্য করা হয়। সাভারের ট্যানারি পল্লীতে প্লট বরাদ্দের ক্ষেত্রে এই শ্রেণী বিন্যাস অনুসরণ করা হয়েছে। ‘এ’ শ্রেণীভুক্ত বড় আকারের ফ্যাক্টরিগুলোর ক্ষেত্রে প্রত্যেককে এক লাখ থেকে দুই লাখ বর্গফুটের প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে মাঝারী ও ছোট ফ্যাক্টরিগুলোকে দেওয়া হয়েছে মাত্র ১০ হাজার বর্গফুটের প্লট।
সাভার ট্যানারি শিল্পনগরীতে ছোট বড় ১৫৫টি প্রতিষ্ঠানের নামে প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়। এরমধ্যে বড় ট্যানারিগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘বাটা কোম্পানি’, ‘বে’, ঢাকা ট্যানারি, এ্যাপেক্সসহ প্রায় ১৫টির মতো বড় ট্যানারি শিল্প রয়েছে। এদের মধ্যে বড় কোম্পানিগুলোর কাজের অগ্রগতি সামান্যই। তবে এদিক দিয়ে এগিয়ে রয়েছে ছোট প্লটের মালিকরা।
সাভার ট্যানারি শিল্প নগরীতে প্রবেশের শুরুতেই রয়েছে এ্যাপেক্সের জন্য নির্ধারিত প্লট। এখানে সীমানা প্রাচীর নির্মাণ ছাড়া উল্লেখযোগ্য কাজ হয়নি। বৃহৎ আকারে এই প্লটের চারদিকে টিন বেড়া দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয়েছে। একইভাবে ঢাকা ট্যানারি এবং বাটা ও বে সীমানা প্রাচীর দিয়েই বসে আছে।
বড়দের মধ্যে আরএমএম লেদার ইন্ডাস্ট্রিজের নামে ওয়াই ডি-৯, ওয়াই ই-৮, ৯০ হাজার বর্গফুটের প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। সরেজমিনে দেখা যায়, এ প্রতিষ্ঠানের বাউন্ডারি ওয়াল শেষ করে পাইলিং এর কাজ চলছে।
এর পাশেই মেসার্স সারোয়ার লেদার কর্পোরেশনেরও দুটি প্লট নিয়ে কাজ চলছে। ওয়াই ডি-৫, ওয়াই ই -৬ প্লটেরও বাউন্ডারি ওয়ালের পর আর কাজ শুরু হয়নি। এরকম বেশীর ভাগ ট্যানারিতে বাউন্ডারি ওয়াল দেওয়া। কোনটির আবার পাইলিং এর কাজ চলছে। কোনটির খুঁটি বসানো হয়েছে।
অথচ ২০০৩ সালে নেওয়া এই প্রকল্প ২০০৫ সালেই শেষ হওয়ার কথা ছিলো। এরপর মামলা মোকাবেলা ও সরকার পরিবর্তনের ফলে কাজের অগ্রগতি পিছিয়ে যায়। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রথম ২০১৫ সালের মার্চ মাসের মধ্যে হাজারীবাগ থেকে সব ট্যানারি সাভারে স্থানান্তরের নির্দেশ দেয়। তখন সম্ভব না হওয়ায় সময় বাড়িয়ে জুন মাস করা হয়। তাতেও শেষ হয়নি। এখন লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে সেপ্টেম্বর। কিন্তু অগ্রগতি সামান্যই।
ট্যানারি স্থানান্তরের বিষয়ে সাভার ট্যানারি শিল্পনগর প্রকল্পের পরিচালক সিরাজুল হায়দার বাংলানিউজকে জানান, এর আগে দুটি সময় পার হলেও আমরা কাজ সম্পন্ন করতে পারি নাই। তবে এবার টার্গেট অনুযায়ী সেপ্টেম্বরের মধ্যে কাজ শতভাগ না হলেও ট্যানারি চালু করার মতো সক্ষমতা তৈরি হবে। আশা করছি, ডিসেম্বরের মধ্যে সবাই এখানে চলে আসবে।
বড়দের মধ্যে রিলায়েন্স ট্যানারির কাজ অনেকটা এগিয়ে। এই প্রতিষ্ঠানের ৬৪ হাজার বর্গফুটে ৫টি প্লট রয়েছে। ওয়াই-৭,ওয়াই এ-৮, ওয়াই বি-৪, ওয়াই বি-২, ওয়াই এস-১৫। রিলায়েন্সে ইতোমধ্যে ৯টি ড্রাম বসানো হয়েছে। বাকীগুলোর কাজ চলছে।
এ প্রতিষ্ঠানের কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে ম্যানেজার নিবাস সরকার বাংলানিউজকে বলেন, আমরা গত বছর থেকে কাজ শুরু করি। ইতোমধ্যে ৯টি ড্রাম বসানো হয়েছে। আমাদের দুটি ইউনিটে ২৮টি ড্রাম বসানো হবে। বেশীরভাগ ড্রাম-ই বাইরে থেকে আনা হচ্ছে। তাই একটু সময় লাগছে।
তিনি বলেন, আমাদের ট্যানারি চালু করার মতো প্রস্তুতি রয়েছে। সরকার সিইটিপি, পানি, গ্যাস, বিদ্যুৎ সুবিধা দিলে আমরা ছোট আকারে কাজ শুরু করতে পারি।
অপেক্ষাকৃত ছোট আকারের ট্যানারি প্রতিষ্ঠান আজমিরী, মেসার্স ভূঁইয়া ট্রেডার্স, ইসমাইল লেদার, মিরাজ লেদার কমপ্লেক্সসহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের কাজ দ্রুততার সঙ্গে এগিয়ে চলছে।
এরমধ্যে আজমীর ট্যানারির চতুর্থ তলা পর্যন্ত নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে। ড্রাম বসানোর জন্য সব প্রস্তুতি শেষ হয়েছে।
আজমীর ট্যানারির ম্যানেজার মো. ইসহাক বাংলানিউজকে বলেন, আমরা গত বছর কাজ শুরু করেছি। আমাদের ৬ তলা ভবনের ৪ তলার কাজ শেষ হয়েছে। এখন বাকী কাজ চলছে। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে শতভাগ কাজ শেষ হবে।
ট্যানারি স্থানান্তরের বিলম্ব প্রসঙ্গে পরিবেশ বিশেষজ্ঞ পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবার) নির্বাহী সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী মো. আবদুস সোবহান বাংলানিউজকে জানান, ট্যানারি মালিকরা খামখেয়ালি করে কাজ করছেন। ছোট কোম্পানিগুলো কাজ করলেও বড়দের সাড়া নেই। যারা সবচেয়ে বেশী উৎপাদন করে তারা সাভারে না গেলে সিইটিপি চালু করাই কষ্টকর। তখন সরকারকে মোটা অংকের লোকসান গুণতে হবে।
তিনি বলেন, বাটা, বে, এ্যাপেক্স, ঢাকা ট্যানারিসহ সব প্রতিষ্ঠানকে সাভারে স্থানান্তরের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে কঠোর চাপ দিতে হবে। প্রয়োজনে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও গ্রহণ করা যেতে পারে। ওরা পরিবেশ ধ্বংস নিয়ে কখনই মাথা ঘামাবে না। ওদের চাপে না রাখলে কিছুই হবে না।
সাভারের বলিয়াপুর ২০০ একর জায়গাজুড়ে পরিবেশবান্ধব চামড়া শিল্পনগর গড়ে তোলা হচ্ছে। এরমধ্যে সাড়ে ১৭ একর জায়গায় নির্মাণ করা হচ্ছে শুধু সিইটিপি। ২০০৩ সালের ১৬ আগস্ট একনেকে চামড়া শিল্পনগর প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়। চীনা কোম্পানি জেএলইপিসিএল-ডিসিএলজেভি লিমিডেট নামে একটি প্রতিষ্ঠান সিইটিপি নির্মাণের কাজ পায়। প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছিল ৪৭৭ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। যদিও পরবর্তীতে কয়েকগুণ ব্যয় বাড়ানো হয়েছে। ২০০৫ সালেই সব কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিলো। শিল্পনগরে ২০৫টি প্লটে ১৫৫টি কারখানা স্থাপন করা হবে। শিল্প মন্ত্রণালয়ের এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক)।
বাংলাদেশ সময়: ১৩০৫ ঘণ্টা, আগস্ট ২০, ২০১৫
এসএম/জেডএম
** ট্যানারি শিল্পনগরে নতুন দুয়ার-১
** আরও দুই সেপ্টেম্বর লাগবে-২
অর্থনীতি-ব্যবসা
চামড়া শিল্পনগরে সরেজমিন-৩
বড়দের খবর নেই, ছোটরা লোকসানের শঙ্কায়
শাহজাহান মোল্লা, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।