খুলনা: মৃতপ্রায় শিল্পনগরী খুলনার অতীত ঐতিহ্য বহন করে চলেছে খুলনা শিপইয়ার্ড।
ইউরোপের বিস্ময় জাগানো শিল্প বিপ্লবের কথা শুনে এলেও আমরা অনেকেই জানি না নিজেদের কিছু শিল্প বিপ্লবের ইতিহাস।
বৃহস্পতিবার (২৭ আগস্ট) দুপুরে খুলনা শিপইয়ার্ড লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কমোডর সৈয়দ ইরশাদ আহমেদ শিপইয়ার্ডে বাংলানিউজকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাতকারে এ কথা বলেন।
তিনি বলেন, খুলনা শিপইয়ার্ড একটি জাহাজ নির্মাণ ও মেরামতকারী প্রতিষ্ঠান। খুলনা শহরের রূপসা নদীর কোল ঘেঁষে অবস্থিত এ প্রতিষ্ঠানটি ১৯৫৪ সালে নির্মাণকাজ শুরু করে তিন বছরে তা শেষ করেছিল। ২৩ নভেম্বর ১৯৫৭ সালে খুলনা শিপইয়ার্ড আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে।
তিনি জানান, খুলনা শিপইয়ার্ড লিমিটেড মূলত সরকারি প্রতিষ্ঠান। এখন এর তত্ত্বাবধানে রয়েছে বাংলাদেশ নৌবাহিনী। সামরিক এই সংস্থার তত্ত্বাবধানে গত এক দশকে এ প্রতিষ্ঠানে সফলতার সঙ্গে নির্মিত হয়েছে বেশ কিছু ছোট-বড় নৌযান, যুদ্ধ জাহাজসহ কন্টেইনারবাহী জাহাজ। এতে ডুবন্ত অবস্থা কাটিয়ে গত পাঁচ বছর ধরে খুলনা কর অঞ্চলের সবচেয়ে বেশি করদাতা প্রতিষ্ঠানও হয়েছে এটি।
খুলনা শিপইয়ার্ড লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, একসময় দেনার ভারে খুলনা শিপইয়ার্ড বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছিলো। সেখানেই এখন তৈরি হচ্ছে যুদ্ধজাহাজ। যুদ্ধজাহাজ নির্মাণে নেমে প্রথম প্রকল্পেই এসেছে সফলতা। এরই ধারাবাহিকতায় নৌবাহিনীর জন্য আরও দুটি অত্যাধুনিক যুদ্ধজাহাজ 'লার্জ পেট্রোল ক্রাফট' বা এলপিসি বানানোর প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে এখানে।
এরই মধ্যে নকশা তৈরিসহ যাবতীয় প্রাথমিক কাজ শেষ। আগামী ৬ সেপ্টেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে এই প্রকল্প উদ্বোধন করার কথা রয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার।
যুদ্ধ জাহাজ নির্মাণের কাজ কিভাবে শুরু হলো জানতে চাইলে তিনি বলেন, ২০১১ সালের ৫ মার্চ প্রধানমন্ত্রী এ শিপইয়ার্ডেই সর্বপ্রথম দেশের মাটিতে ৫টি যুদ্ধ জাহাজ তথা পেট্রোল ক্রাফট নির্মাণের ঘোষণা দেন। খুলনা শিপইয়ার্ড অত্যন্ত সফলভাবে ২০১৩ সালের মধ্যে সেই ৫টি পেট্রোল ক্র্যাফট নির্মাণ করে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর কাছে হস্তান্তর করে। এ সাফল্যের ধারাবাহিকতা এবং প্রধানমন্ত্রীর প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় খুলনা শিপইয়ার্ড এবার নির্মাণ করতে যাচ্ছে আরও বড় আকারের অত্যাধুনিক যুদ্ধ জাহাজ তথা 'লার্জ পেট্রোল ক্রাফট' বা এলপিসি। আর্থিক ও কারিগরি দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশের জাহাজ নির্মাণ শিল্পে এটিই হচ্ছে সবচেয়ে বৃহৎ প্রজেক্ট। ৬৪.২০ মিটার দৈর্ঘ্য, ০৯ মিটার প্রস্থ, ০৪ মিটার ড্রাফট এবং ২৫ নট গতি সম্পন্ন এ এলপিসি দুটিতে থাকবে টর্পেডোসহ বিভিন্ন আধুনিক ইকুইপমেন্ট ও যন্ত্রপাতি।
খুলনা শিপইয়ার্ডের সুদৃঢ় অবস্থানের পেছনে কাদের অবদান বেশি জানতে চাইলে সৈয়দ ইরশাদ আহমেদ বলেন, খুলনা শিপইয়ার্ড দেশের একটি অগ্রগামী শিল্প প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিনিয়ত নতুন সম্ভাবনার দুয়ার উন্মোচন করার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। বর্তমান সরকারের শিল্পবান্ধব নীতিমালা, বিভিন্ন সরকারি ও স্বায়ত্ব-শাসিত সংস্থার আন্তরিক সহযোগিতা, বাজারমুখী সক্রিয় কার্যক্রম, প্রতিযোগিতামূলক মূল্য নির্ধারণ ও সর্বেপরি দক্ষ শ্রমশক্তি এবং কার্যকর ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে আজ আমরা আমাদের অবস্থানকে ক্রমাগত সুদৃঢ় করতে পেরেছি।
তিনি বলেন, মাত্র কিছুদিন আগে আমরা বাংলাদেশ নৌ-ফাউন্ডেশনের জন্য একটি কন্টেইনার ভেসেল এবং নৌবাহিনীর জন্য দুটি LCU নির্মাণের কাজ সম্পন্ন করেছি।
আরেকটি নৌ ফাউন্ডেশনের কন্টেইনার ভেসেল প্রায় শেষ পর্যায়ে। এছাড়া, ফায়ার সার্ভিসের ৩টি পন্টুন ও ৩টি ফায়ার ফ্লোটসহ বেসরকারি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের দু’টি কার্গো ভেসেল নির্মাণের কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে। অচিরেই আমরা নৌবাহিনীর Submarine Tug -এর নির্মাণ কাজ হাতে নেবো। নৌ কল্যাণ ফাউন্ডেশনের দুটি কন্টেইনার ভেসেল বাংলাদেশে নির্মীয়মান ক্লাসভুক্ত সমুদ্র উপকূলে চলাচলের জন্য প্রথম কোস্টাল কন্টেইনার ভেসেল। ভবিষ্যৎ উন্নয়ন ও ক্রমবিকাশের কথা বিবেচনা করে মংলার জয়মনি গোলে ফরওয়ার্ড ইয়ার্ড নির্মাণের জন্য আমরা ৪২.৮০ একর জমি অধিগ্রহণ করেছি। বর্তমান ইয়ার্ডের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি এবং মংলায় অধিগ্রহণকৃত জমিতে আধুনিক ইয়ার্ড নির্মাণের প্রয়াসে আমরা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন জাহাজ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করছি।
খুলনা শিপইয়ার্ড লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, ISO 9001 : 2008 সনদ প্রাপ্ত এ ইয়ার্ড বর্তমানে আন্তর্জাতিক Classification Society যেমন Lloyds Register, Class NK, Chinese Classification Society (CCS), Germanischer Lloyd, RINA I Bureau Veritas এর তত্ত্বাবধানে জাহাজ নির্মাণ করছে। গত ৫৭ বছরে এ ইয়ার্ড ৬৯৬টি জাহাজ তৈরি করেছে। মেরামত করেছে ২,১৬৮টি। বাংলাদেশ নৌবাহিনী দায়িত্ব গ্রহণের পর পন্টুন ও বার্জসহ নতুন জলযান নির্মাণ করেছে ১১৫টি ও মেরামত করেছে ৫১৮টি।
বাংলাদেশ সময়: ১৯২০ ঘণ্টা, আগস্ট ২৭, ২০১৫
এমআরএম/জেডএম