ঢাকা: ছয়টি জীবন বিমা কোম্পানির আর্থিক অবস্থা খতিয়ে দেখতে নিরীক্ষক নিয়োগ করেছে বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)।
এই কোম্পানিগুলো ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের খাতে আইনি সীমা লঙ্ঘন করে গ্রাহকের টাকা বেপরোয়া খরচ করেছে।
সরকারি জীবন বিমা প্রতিষ্ঠান জীবন বিমা করপোরেশনসহ এই তালিকায় রয়েছে পদ্মা ইসলামী লাইফ, ন্যাশনাল লাইফ, মেঘনা লাইফ, প্রগতী লাইফ ও সানফ্লাওয়ার লাইফ ইন্সুরেন্স কোম্পানি।
গত ২৬ আগস্ট কোম্পানিগুলোতে নিরীক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়। ব্যবস্থাপনা ব্যয় বাবদ অতিরিক্ত অর্থ খরচ করা অন্য কোম্পানিগুলোতেও পর্যায়ক্রমে নিরীক্ষক নিয়োগ করা হবে।
প্রাথমিকভাবে নিরীক্ষক নিয়োগ করা ছয়টি কোম্পানির মধ্যে জীবন বিমা করপোরেশনে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে একনাবিন চার্টার্ড অ্যাকাউন্টসকে। এছাড়া পদ্মায় হুদা ভাসী চৌধুরী অ্যান্ড কোম্পানি, ন্যাশনালে হাওলাদার ইউনিস অ্যান্ড কোম্পানি, মেঘনায় মসিহ মুহিত হক অ্যান্ড কোম্পানি, প্রগতীতে নূরুল ফারুক হাসান অ্যান্ড কোম্পানি এবং সানফ্লাওয়ার লাইফে এমজে আবেদিন অ্যান্ড কোম্পানির চার্টার্ড অ্যাকাউন্টসকে নিয়োগ করা হয়েছে।
নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্ট জীবন বিমা কোম্পানির তিন বছরের (২০১২ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত) আয়, ব্যয়, সম্পদ ইত্যাদি বিষয়ে নিরীক্ষা করবে। এ জন্য কোম্পানির বিনিয়োগ, ঋণ, অগ্রিম, পণ্য মূল্য নির্ধারণ ও ভ্যালুয়েশন, স্থায়ী সম্পদ ও অন্যান্য সম্পদ, গাড়ি, জমি ও বিল্ডিং, নগদ টাকা, ট্যাক্স ও ভ্যাট, চেয়ারম্যান ও পরিচালকরা কী পরিমাণ সম্মানী ও অন্যান্য সুবিধা নিয়েছেন তার পর্যালোচনা করবে নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান।
নিরীক্ষা কার্যক্রম সম্পন্ন করে ৩ মাসের মধ্যে আইডিআরএ’র কাছে প্রতিবেদন জমা দিতে হবে নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে। এরপর প্রতিবেদনের আলোকে প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিবে নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি।
আইডিআরএ সূত্র জানিয়েছে, নিরীক্ষক নিয়োগ দেওয়া জীবন বিমা কোম্পানিগুলো ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের খাতে আইনি সীমা লঙ্ঘন করে অতিরিক্ত অর্থ খরচ করেছে। এ জন্য কোম্পানিগুলোর সার্বিক আর্থিক অবস্থা খতিয়ে দেখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কারণ ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের খাতে যে অতিরিক্ত অর্থ খরচ করা হয়েছে তার ৯০ শতাংশই পলিসি গ্রাহকদের। বাকি ১০ শতাংশ শেয়ার হোল্ডারদের।
আইডিআরএ’র চেয়ারম্যান এম শেফাক আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, জীবন বিমা কোম্পানির টাকা গ্রাহকের টাকা। কোম্পানি অতিরিক্ত অর্থ খরচ করলে গ্রাহকরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই গ্রহকদের স্বার্থ সংরক্ষণে কোম্পানিগুলোতে নিরীক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের আড়ালে কোম্পানিগুলো অন্য কোনো অনিয়ম করেছে কি না তা খতিয়ে দেখা হবে।
মেঘনা লাইফ ইন্সুরেন্সের চেয়ারম্যান নিজাম উদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, আইডিআরএ’র উচিত ছিল আরও আগে নিরীক্ষা করা। নিরীক্ষা করলে ভুলত্রুটি কী আছে তা বেরিয়ে আসবে। আর নিরীক্ষা না করলে অনিয়ম হবে এটাই স্বাভাবিক। তবে আইডিআরএ’র উচিত হবে নিরীক্ষা কার্যক্রম শুধু ৬ কোম্পানির মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে সব কোম্পানিতে পরিচালনা করা।
জীবন বিমা করপোরেশন
২০১২ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত তিন বছরে এই প্রতিষ্ঠানটি ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের খাতে আইনি সীমার অতিরিক্ত খরচ করেছে ১৩৭ কোটি ১ লাখ টাকা। এর মধ্যে ২০১২ সালে অতিরিক্ত খরচ করা হয় ৪১ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। আর ২০১৩ সালে ৪৫ কোটি ৩৪ লাখ এবং ২০১৪ সালে ৫০ কোটি ১৯ লাখ টাকা অতিরিক্ত খরচ করা হয়।
পদ্মা ইসলামী লাইফ
২০১২ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত তিন বছরে অতিরিক্ত খরচ হয়েছে ৯১ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। এর মধ্যে ২০১২ সালে ৩২ কোটি ৮৮ লাখ, ২০১৩ সালে ৩১ কোটি ৪৪ লাখ এবং ২০১৪ সালে ২৭ কোটি ৭ লাখ টাকা।
ন্যাশনাল
২০১২ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত তিন বছরে অতিরিক্ত খরচ করেছে ৪৩ কোটি ১৭ লাখ টাকা। এর মধ্যে ২০১২ সালে ৩ কোটি ৭০ লাখ, ২০১৩ সালে ১৫ কোটি ৪২ লাখ এবং ২০১৪ সালে ২৪ কোটি ৫ লাখ টাকা।
মেঘনা
২০১২ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত তিন বছরে অতিরিক্ত খরচ করেছে ৪০ কোটি ৯১ লাখ টাকা। এর মধ্যে ২০১২ সালে ২৩ কোটি ৬৬ লাখ এবং ২০১৩ সালে ১৭ কোটি ২৫ লাখ টাকা। আর ২০১৪ সালে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা ব্যয় আইনি সীমার মধ্যেই ছিল।
প্রগতী
২০১২ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত তিন বছরে অতিরিক্ত খরচ করেছে ৬৮ কোটি ২৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে ২০১২ সালে ২৮ কোটি ১৪ লাখ, ২০১৩ সালে ২৩ কোটি ৬৮ লাখ এবং ২০১৪ সালে ১৬ কোটি ৪৬ লাখ টাকা।
সানফ্লাওয়ার
২০১২ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত অতিরিক্ত খরচ করেছে ৫৮ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। এর মধ্যে ২০১২ সালে ২৫ কোটি ৪০ লাখ, ২০১৩ সালে ১৭ কোটি ৫৫ লাখ এবং ২০১৪ সালে ১৫ কোটি ৭০ লাখ টাকা।
অন্য কোম্পানিগুলোর অবস্থা
বাংলানিউজের অনুসন্ধানে জানা যায়, দীর্ঘ দিন ধরেই জীবন বিমা কোম্পানিগুলো ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের খাতে বেপরোয়া খরচ করছে। ২০০৯ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত কোম্পানিগুলোর অতিরিক্ত ব্যয়ের তথ্য প্রতিবেদন পাওয়া যায়।
ওই প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্সুরেন্স ১৮৭ কোটি ৮৮ লাখ, গোল্ডেন ১২৪ কোটি ৫ লাখ, সন্ধানী ১৪৩ কোটি ১৫ লাখ, সান লাইফ ৮৮ কোটি ৭৫ লাখ, রূপালী ৫০ কোটি ২৩ লাখ, প্রগ্রেসিভ ২৮ কোটি ৬৯ লাখ, প্রাইম ইসলামী ৬৬ কোটি ৯২ লাখ, হোমল্যান্ড ৪২ কোটি ৩০ লাখ, ডেল্টা ৫৪ কোটি ৮৩ লাখ এবং বায়রা ৩২ কোটি ৫০ লাখ টাকা অতিরিক্ত খরচ করেছে।
এর আগে ২০১১ সালে গোল্ডেন, হোমল্যান্ড ও বায়রা লাইফে নিরীক্ষক নিয়োগ করা হয়। এর মধ্যে গোল্ডেন লাইফের নিরীক্ষা প্রতিবেদন এখনও পায়নি আইডিআরএ। আর হোলমল্যান্ড ও বায়রা লাইফের অনিয়মের বিরুদ্ধে আইডিআরএ এখন পর্যন্ত কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।
এই তিন কোম্পানির নিরীক্ষা প্রতিবেদনের বিষয়ে জানতে চাইলে আইডিআরএ সদস্য সুলতান-উল-আবেদীন মোল্লা বাংলানিউজকে বলেন, আমরা যোগদানের আগেই কোম্পানি তিনটিতে নিরীক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছিলো। তবে এ বিষয়ে আপডেট আমার জানা নেই।
বাংলাদেশ সময়: ১১১৬ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১, ২০১৫
এএসএস/টিআই