ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

অর্থনীতি-ব্যবসা

সুগন্ধি ব্যবসায় বাংলাদেশি মাহতাবুরের বিশ্বজয়

নিউজ ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৩১৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৯, ২০১৬
সুগন্ধি ব্যবসায় বাংলাদেশি মাহতাবুরের বিশ্বজয় বাংলাদেশি সুগন্ধি ব্যবসায়ী মাহতাবুর

মানুষের পছন্দের বিষয়টি মাথ‍ায় রেখে ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে সুগন্ধি তৈরি করে বিশ্ব জয় করেছে বাংলাদেশের সুগন্ধি ব্র্যান্ড আল হারামাইন। প্রতিষ্ঠানটি বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যসহ ইউরোপের বাজারে বেশ সুনামের সঙ্গে সুগন্ধি ও প্রসাধনী সামগ্রী বাজারজাত করছে।

ঢাকা: মানুষের পছন্দের বিষয়টি মাথ‍ায় রেখে ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে সুগন্ধি তৈরি করে বিশ্ব জয় করেছে বাংলাদেশের সুগন্ধি ব্র্যান্ড আল হারামাইন। প্রতিষ্ঠানটি বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যসহ ইউরোপের বাজারে বেশ সুনামের সঙ্গে সুগন্ধি ও প্রসাধনী সামগ্রী বাজারজাত করছে।

আর সেখানকার মানুষ ল‍ুফে নিয়েছেন এ সুগন্ধি।

ক্রেতাদের কথা মাথায় রেছে আতরের পাশাপাশি সুগন্ধিসহ নানা ধরনের প্রসাধনী প্রস্তুত করছে প্রতিষ্ঠানটি। বিশ্ব মাতিয়ে সম্প্রতি দেশের বাজারেও নজর দিয়েছেন আল্ হারামাইন কোম্পানির কর্ণধার মাহতাবুর রহমান।

এরই মধ্যে ঢাকায় তিনটি আউটলেট খুলেছে আল্ হারামাইন পারফিউমস্। মন মাতানো ঘ্রাণ ও বাহারি মোড়কে ক্রেতাদের হাতে তুলে দিচ্ছে মোহনীয় এ সুগন্ধি।

সুগন্ধি বিক্রি করে মোহাম্মদ মাহতাবুর রহমান আজ প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে অন্যতম ধনী ব্যক্তি। পরপর চারবার বাণিজ্যিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব বা সিআইপি হিসেবে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ভূষিত হয়েছেন তিনি। সবচেয়ে বেশি বিদেশি মুদ্রা দেশে এনে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক গত তিনবার রেমিট্যান্স অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন তিনি।

উন্নত ফর্মুলা ও সুদৃশ্য মোড়ক বা প্যাকেজিং এবং আধুনিক বিপণন ব্যবস্থা ও অভিনব সুগন্ধি প্রস্তুতের পাশাপাশি বর্তমানে গ্রুপটি দেশের স্বাস্থ্য খাত, চা বাগান, শিক্ষা ও ব্যাংকিং এবং পুঁজিব্যবস্থাপনা ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। প্রবাসী উদ্যোক্তাদের প্রতিষ্ঠিত এনআরবি ব্যাংকের চেয়ারম্যানও এখন মাহতাবুর রহমান।

কিভাবে এই ব্যবসায় এলেন জানতে চাইলে মোহাম্মদ মাহতাবুর রহমান বলেন, শুরুটা হয়েছিল আমার বাবার হাত ধরে। আমার বাবার নাম মওলানা কাজী আবদুল হক। আমাদের গ্রামের বাড়ি সিলেটের বিয়ানীবাজারের নাটেশ্বর গ্রামে। সিলেটের সুজানগরে আগর কাঠ হতো। ওই আগর কাঠ দিয়ে অনেক সুন্দর আতর হতো। কিন্তু বাংলাদেশে ওই আগর কাঠের বাজার ছিল না। ভারতসহ আশপাশের দেশগুলোতে আগর কাঠের বাজার ছিল। ১৯৫৬ সালে আমার বাবা যখন প্রথমবারের মতো সৌদি আরবে যান হজ করতে, তখন তিনি সঙ্গে করে বেশ কিছু আগর কাঠ নিয়ে গিয়েছিলেন। সৌদি আরবের বাংলাদেশিদের কাছে আগরের জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকায় আমার বাবা সেখানে সুগন্ধির ব্যবসা শুরুর পরিকল্পনা করেন। ১৯৭০ সালে তিনি পবিত্র মক্কা নগরী থেকে সুগন্ধির ব্যবসা শুরু করেন। আমি ১৯৭৫ সালে প্রথম বাবার সঙ্গে সৌদি আরবে যাই। তখন আমি কেবল উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে বিএ পরীক্ষা দিয়েছি।

এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি মাহতাবুর রহমানকে। খুবই অল্প সময়ে সুগন্ধির ব্যবসায় দক্ষতা অর্জন করেন তিনি। সংযুক্ত আরব আমিরাতে (দুবাই) তিনি প্রথম শোরুম খোলেন ১৯৮১ সালে। পরবর্তী সময় ব্যবসা পরিচালনার সুবিধার্থে দুবাইয়ে ১১ হাজার বর্গফুট জায়গার ওপর সুসজ্জিত প্রধান কার্যালয় স্থাপন করেন। ১৬ হাজার ২১৫ বর্গমিটারের জায়গার ওপর কারখানা স্থাপন করেন। কারখানাটিতে সর্বাধুনিক মানের সুগন্ধি প্রস্তুত করতে পূর্ণাঙ্গ ও সেমি অটোমেটিক অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করছেন। উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার করে নিত্যনতুন সুগন্ধি তৈরির জন্য গবেষণা ও উন্নয়ন বিভাগ খুলেছেন। পরবর্তী সময় মধ্যপ্রাচ্যের সবগুলো দেশে এই ব্যবসা প্রসার ঘটান তিনি।

আইএসও সনদপ্রাপ্ত এই সুগন্ধি বর্তমানে বিশ্বের ৬৫টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে।

মাহতাবুর রহমান বলেন, ‘গত বছর আমরা তিন হাজার ৬০০ কনটেইনার পণ্য রপ্তানি করেছি। এতো বড় ব্যবসা পরিচালনার জন্য আমরা কখনো দেশে-বিদেশের কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নেইনি এবং ভবিষ্যতে ঋণ নেওয়ার ইচ্ছা নেই।

তিনি বলেন, আমরা বর্তমানে ছয় ভাই এই ব্যবসা দেখাশোনা করছি। ভাইদের মধ্যে আমি দ্বিতীয়। এখন আমার ছেলে ও ভাতিজারা এই ব্যবসায় যুক্ত রয়েছে। এটা পুরোপুরি আমাদের পারিবারিক ব্যবসা।

বাংলাদেশের উদ্যোক্তাদের জন্য আলাদা অর্থনৈতিক অঞ্চলের একটি দাবি তিনি জানিয়েছিলেন গত রেমিট্যান্স অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠানে। সে বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে মাহতাবুর রহমান বলেন, রেমিট্যান্স অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠানে আমি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সাহেবের কাছে প্রবাসী উদ্যোক্তাদের পণ্য উত্পাদন ও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বাজারজাত করার সুবিধার্থে আলাদা একটি ইপিজেড তৈরির দাবি করেছিলাম। কেননা সরকার ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল গঠনের যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তার মধ্যে একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল থাকতে পারে প্রবাসী উদ্যোক্তাদের জন্য।

নিজ দেশের বাইরে ব্যবসা করে সফল এই উদ্যোক্তা বাংলাদেশের আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংকের পরিচালক ছিলেন। বর্তমানে প্রবাসী উদ্যোক্তাদের এনআরবি ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

তিনি বলেন, ‘সিলেটে আল্ হামিদিয়া টি গার্ডেন নামে আমাদের একটি চা বাগান আছে। আর একটি হাসপাতাল করছি অত্যন্ত আধুনিক হাসপাতাল, ২৫০ শয্যার। এর মেডিক্যাল ইকুইপমেন্টগুলোও আনা হচ্ছে বিদেশ থেকে। ইতিমধ্যে হাসপাতালের জন্য ভবন নির্মাণ প্রায় শেষ হয়েছে। শিগগিরই এই হাসপাতাল আমরা চালু করতে পারবো বলে আশা করছি।

তিনি বলেন, এতো কিছুর পরও একটি অনলাইন পত্রিকার বিভ্রান্তিকর সংবাদ আমাকে খুবই দুঃখিত ও ব্যথিত করেছে। তারা বলেছে, ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ (বিডি) লিমিটেডের ঋণ খেলাপির দায়ে আমার বাড়ি নাকি নিলামে উঠবে। কিন্তু ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের সঙ্গে আমি যুক্ত হই ২০০৯ সালে। ২০১৪ সালে আমি ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ থেকে বের হয়ে আসি। আমার পদত্যাগপত্র আইন ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি। ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের পর্ষদ সভায়ও আমার পদত্যাগের বিষয়টি অনুমোদিত হয়েছে ১৭ ডিসেম্বর ২০১৫। এ ছাড়া রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কম্পানিজ অ্যান্ড ফার্মসের (আরজেএসসি) তালিকা থেকেও আমাকে অবসর দেখিয়ে নাম বাদ দেওয়া হয়েছে। আরজেএসসি থেকে যখন একজনের নাম বাদ দেওয়া হয় তখন ওই কম্পানিতে ওই ব্যক্তির কোনো দায় থাকে না বিধায় সার্টিফিকেট ইস্যু করা হয়। এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র শুভঙ্কর সাহাও তার বক্তব্যে বলেছেন মাহতাবুর রহমানের নাম এখানে নেই। তবুও আমাকে নিয়ে এ ধরনের একটি বিভ্রান্তিকর সংবাদ পরিবেশন করায় আমি খুবই দুঃখ পেয়েছি। ’

বাংলাদেশের ব্যাংক ব্যবসায় যুক্ত হওয়ার বিষয়ে এই উদ্যোক্তা বলেন, প্রবাসীদের একটি ব্যাংক দেওয়ার জন্য দীর্ঘদিনের একটি দাবি ছিল। অবশেষে প্রবাসীদের ব্যাংক দিয়েছেন এ জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আমি ধন্যবাদ জানাই। কিন্তু প্রবাসীদের ব্যাংক দেওয়ার উদ্দেশ্য ছিল যে প্রবাসীদের রেমিট্যান্স আনা, প্রবাসীদের উৎসাহিত করা, সেই কাজগুলো এখনো পুরোপুরো হচ্ছে না। আমরা চেষ্টা করছি প্রবাসীদের বিনিয়োগ যাতে আরো বেশি করে আসে। তারা যেন আমাদের ব্যাংকের মাধ্যমে বেশি বেশি বিনিয়োগ করতে পারেন। আপনারা জানেন, বিদেশি ব্যাংকের সুদ অনেক কম। বাংলাদেশে তারা বিনিয়োগ করলে বেশি মুনাফা পাবে। তা ছাড়া বাংলাদেশ সরকারের ঘোষিত ১০০ ইপিজেডের মধ্যে একটি ইপিজেড প্রবাসীদের জন্য দেওয়া হলে তাদের বিনিয়োগ আরো বাড়বে। মধ্যপ্রাচ্যে বসবাসরত বাংলাদেশিদের কিন্তু সেখানে নাগরিকত্ব পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তাই দেখবেন সেখানে কর্মরত বাংলাদেশি শ্রমিকরাই সিংহভাগ রেমিট্যান্স পাঠায়। যাদের বয়স ৬৫ বছর হয়ে গেছে এবং ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে তারা বাংলাদেশে ফিরে আসবে। তারাই বেশি টাকা আনছে। কিন্তু ইউরোপ-আমেরিকার প্রবাসীরা তুলনামূলক কম টাকা পাঠায়। তারা ওই দেশেই বেশি বিনিয়োগ করে। আমাদের দেশের মতো দেশে বিদেশি বিনিয়োগ অত্যান্ত প্রয়োজন। সরকারকে মনে রাখতে হবে, বিদেশি কম্পানিগুলো বিনিয়োগ করতে এলে তারা কিন্তু তাদের বিনিয়োগ ও মুনাফা দুটোই ফেরত নিয়ে যায়। কিন্তু প্রবাসীরা দেশে বিনিয়োগ করলে বিনিয়োগ ও মুনাফা পুনরায় দেশেই বিনিয়োগ করে থাকে।

নতুন করে যেসব প্রবাসী বিদেশে বিনিয়োগ করতে চায় তাদের উদ্দেশ্যে মাহতাবুর রহমান বলেন, ‘আমি দুবাইতে বাংলাদেশ বিজনেস কাউন্সিল ও শেখ খলিফা বিন জায়েদ বাংলাদেশ ইসলামী স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। আমরা সব সময় বিদেশিদের আহ্বান জানাই আমাদের দেশে আসার জন্য। বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর সঙ্গে আমাদের একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করা রয়েছে। এর আওতায় আমরা যেসব বিদেশি বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী তাদের বিভিন্ন পরামর্শ দিয়ে থাকি। কিন্তু আমরা সরকারের কাছে বারবার আহ্বান করছি যাতে বিদেশিদের বাংলাদেশে বিনিয়োগ করার প্রক্রিয়াটি ওয়ানস্টপ সার্ভিস করা হয়। না হলে তাদের অনেক ভোগান্তি পোহাতে হয়। সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ ও বাংলাদেশ প্রতিদিন

আর বাংলাদেশের যেসব উদ্যোক্তা বিদেশে বিনিয়োগ করতে চায় তাদের উদ্দেশ্যে মাহতাবুর রহমান বলেন, এখন আফ্রিকান দেশগুলোতে বিনিয়োগের কিছু সুযোগ আছে। সেখানে কৃষি খাতে বিনিয়োগ করা যেতে পারে। সেখানকার কৃষিজমি অনেক উর্বর। ওই খানে বিনিয়োগ করলে লাভবান হওয়া যাবে বলে আমি মনে করি।

বাংলাদেশ সময়: ০৯০৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৯, ২০১৬
বিএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।