প্ল্যান্টটিতে লিকুফায়েড পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি), ডিজেল, পেট্রল, ফার্নেস অয়েল ও এভিয়েশন ফুয়েল (জেট এ-১) উৎপাদন করা হবে।
স্থানীয় প্রতিনিধিদের সহযোগিতায় সীতাকুণ্ডে সমুদ্র উপকূল সংলগ্ন ২২০ একর নিজস্ব জমির ওপর এই প্ল্যান্ট স্থাপন করবে বসুন্ধরা অয়েল অ্যান্ড গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড।
বেসরকারি খাতের এই প্রকল্পে ১০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের প্রয়োজন হবে এবং এই প্রকল্পে ৭০০ কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে বলে জানিয়েছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।
এই প্রকল্পে বিনিয়োগের ৬৪ শতাংশ অর্থাৎ ছয় হাজার ৪০০ কোটি টাকা আসবে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ হিসেবে। বিনিয়োগের বাকি অংশ বসুন্ধরা গ্রুপ পুঁজি হিসেবে জোগান দেবে বলে প্রকল্প প্রস্তাব থেকে জানা গেছে।
এই প্রকল্পে সিন্ডিকেশন বা যৌথ অর্থায়নের উদ্দেশ্যে ব্যাংক এশিয়ার নেতৃত্বে সরকারি-বেসরকারি ২৪টি ব্যাংক তহবিল সংস্থানের কাজ করছে বলেও জানা গেছে। ঋণটি শোধ করতে ১১ বছর সময় পাবে গ্রুপটি। এর আগে দেশে এত বড় সিন্ডিকেশন ঋণের নজির নেই বলে জানান ব্যাংক এশিয়ার প্রেসিডেন্ট ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আরফান আলী।
দেশে এর আগে সবচেয়ে বড় সিন্ডিকেশন ঋণ পেয়েছিল বাংলালিংক। এই প্রতিষ্ঠানের সিন্ডিকেশন ঋণ ছিল প্রায় দুই হাজার ১০০ কোটি টাকা। জিপিএইচ ইস্পাত লিমিটেডের সিন্ডিকেশন ঋণ ছিল এক হাজার ২৮০ কোটি টাকা। বাংলাদেশ বিমানের সিন্ডিকেশন ঋণ ছিল প্রায় ৯৫০ কোটি টাকার।
ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, সর্ববৃহৎ এই তেল শোধনাগার প্ল্যান্টে অর্থায়নের জন্য এরই মধ্যে ৯টি ব্যাংক তিন হাজার ৩০০ কোটি টাকার ঋণ অনুমোদন দিয়েছে। ব্যাংক এশিয়া অনুমোদন করেছে ৫০০ কোটি টাকা।
গত কয়েক মাসে সাতটি বেসরকারি ব্যাংক এই প্রকল্পে অর্থায়নের নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং অন্য আটটি সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত বিবেচনাধীন আছে বলে জানা গেছে। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন অগ্রণী, সোনালী ও জনতা ব্যাংক এই প্রকল্পে এক হাজার ৫০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে বলে আশা করা যাচ্ছে। দেশের সর্ববৃহৎ বেসরকারি ব্যাংক ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড এই প্রকল্পের অনুকূলে এক হাজার ৫০০ কোটি টাকা অর্থায়ন করছে বলে প্রকল্পসংক্রান্ত নথিপত্র থেকে জানা গেছে।
এই প্রকল্পে অর্থায়নের ক্ষেত্রে কোনো কোনো ব্যাংকের একক গ্রাহক ঋণসীমা (সিঙ্গেল পার্টি এক্সপোজার লিমিট) অতিক্রম করায় এ বিষয়ে অনুমোদন চেয়ে তারা বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে আবেদন করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকও বিষয়টি ইতিবাচকভাবে দেখছে বলে ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে জানিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে ঋণের প্রধান আয়োজক ব্যাংক এশিয়াকে প্রস্তাবগুলো আলাদাভাবে না পাঠিয়ে একসঙ্গে পাঠাতে বলেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ শামস-উল ইসলাম বলেন, ‘এই প্রকল্পে অর্থায়নের ক্ষেত্রে একটি জায়গায় অনেক বেশি ঋণ কেন্দ্রীভূত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে সরকার যদি এই প্রকল্পের বড় একজন ক্রেতা হয় তবে ঝুঁকিটা আর থাকে না। এটি আমাদের দেশের জন্য গর্বের একটি প্রকল্প হবে। আমরা চাই এটা সফল হোক। ’
ঋণ প্রস্তাবে বসুন্ধরা লিখেছে, রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) এবং অন্য স্থানীয় ক্রেতারা এই তেল শোধনাগার প্রকল্পের বড় ক্রেতা প্রতিষ্ঠান হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
প্রকল্পের সক্ষমতা যাচাইপূর্বক এক প্রতিবেদনে ব্যাংক এশিয়া বলেছে, কার্যক্রম শুরু হলে এই প্রকল্পে প্রতিদিন এক লাখ ব্যারেল অপরিশোধিত তেল পরিশোধন করা সম্ভব হবে, যেখানে দেশের একমাত্র রাষ্ট্রায়ত্ত তেল শোধনাগার প্রতিষ্ঠান ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড করছে ৩৩ হাজার ব্যারেল।
বসুন্ধরার এই প্রকল্প থেকে বছরে ৪৭ লাখ টন পেট্রোলিয়ামজাত পণ্য উৎপাদন করা সম্ভব হবে, যেখানে বার্ষিক চাহিদা রয়েছে ৫৮ লাখ ৯০ হাজার টন। এই পরিমাণ চাহিদার মাত্র ১২ লাখ থেকে ১৩ লাখ টন তেল স্থানীয়ভাবে উৎপাদন করা হচ্ছে, বাকিটা বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করে বিদেশ থেকে আনতে হচ্ছে।
২০৪১ সাল নাগাদ বাংলাদেশের পরিশোধিত তেলের চাহিদা ছয় গুণ বৃদ্ধি পেয়ে তিন কোটি টনে পৌঁছাবে বলে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি ২০১৬ সালে এক পূর্বানুমান উপস্থাপন করেছিল।
বসুন্ধরা গ্রুপের জ্যেষ্ঠ উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন বলেন, ‘দুই বছর ধরে এই প্রকল্প স্থাপনের পরিকল্পনা করা হচ্ছে এবং বিনিয়োগের অর্থ জোগাড়ের জন্য চার মাস ধরে বিভিন্ন ব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগ করে যাচ্ছেন প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা। ’
অর্থায়নের ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো ইতিবাচকভাবে সাড়া দেওয়ায় প্রকল্প নির্মাণের কাজ যথাসময়েই শুরু করা সম্ভব হবে বলে মনে করছেন গ্রুপটির ঊর্ধ্বতন এই কর্মকর্তা।
প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, এই প্রকল্পের প্রকৌশল, ক্রয় ও নির্মাণকাজ পরিচালনার জন্য বসুন্ধরা গ্রুপ সম্প্রতি চেক রিপাবলিকের প্রোকোপ ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সঙ্গে চুক্তি করেছে। ১৯৯০ সালে প্রতিষ্ঠিত বিদেশি এই কম্পানি শিল্প প্রকল্প নির্মাণে অত্যন্ত দক্ষ, বিশেষ করে অপরিশোধিত তেল ও তেলজাত পণ্য এবং গ্যাস প্রক্রিয়াজাতকরণে নিয়োজিত প্রকল্প নির্মাণে।
দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে ভারতই শুধু তাদের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানোর পর অতিরিক্ত পরিশোধিত তেল রপ্তানি করতে পারছে। ২০১৬ সালে পাকিস্তান তাদের চাহিদার ৪০ শতাংশ এবং শ্রীলঙ্কা ৩০ শতাংশ পরিশোধিত তেল উৎপাদন করতে সক্ষম হয় বলে বসুন্ধরা গ্রুপের ঋণ প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয়।
ওই বছর বাংলাদেশ তাদের চাহিদার মাত্র ২০ শতাংশ পরিশোধিত তেল উৎপাদন করতে সক্ষম হয় এবং চাহিদার বাকি অংশ আমদানি করে মেটানো হয় বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশ সময়: ১০০০ ঘণ্টা, মার্চ ১৮, ২০১৮