ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

বন্ডেড পণ্য কালোবাজারে, অসাধু চক্রকে রুখবে কে?

গৌতম ঘোষ, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৩৩ ঘণ্টা, মার্চ ১৩, ২০১৯
বন্ডেড পণ্য কালোবাজারে, অসাধু চক্রকে রুখবে কে?

দ্রুত ও সহজে পোশাক রপ্তানির জন্য রপ্তানিমুখী শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে বন্ড সুবিধা দিয়ে থাকে সরকার। কিন্তু এ সুবিধার অপব্যহার করছে একটি অসাধু চক্র। রপ্তানিমুখী শিল্পের কথা বলে ট্রাকে ট্রাকে আনা শুল্কফাঁকির পণ্য যাচ্ছে কালোবাজারে। এতে যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশীয় শিল্পখাত, তেমনি সরকার বঞ্চিত হচ্ছে বিপুল অংকের রাজস্ব থেকে। এই কালোবাজারি নিয়ে বাংলানিউজের অনুসন্ধানের ওপর তিনটি প্রতিবেদনের আজ পড়ুন প্রথম প্রতিবেদন

বন্ড সুবিধার পণ্য কালোবাজারে বিক্রি এবং চোরাকারবারি ঠেকাতে গত দেড় মাসে ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট ২৬টি ঝটিকা অভিযান চালিয়েছে। এতে ৪০টি প্রতিষ্ঠানের ৩০ কোটি টাকার অনিয়ম উদঘাটন করা হয়েছে।

তবু ঠেকানো যাচ্ছে না অসাধু চক্রকে। শুল্কমুক্ত সুবিধায় আনা পণ্যে তারা সয়লাব করছে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার বাজার। পুরান ঢাকার ইসলামপুর, নয়াবাজার, চকবাজার মোড়েও খোলাবাজারে বিক্রি হচ্ছে বন্ড সুবিধায় আমদানি করা পণ্য। আর বন্ডেড পণ্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে ক্ষতির মুখে পড়ছে দেশীয় শিল্পপ্রতিষ্ঠান। এ কারণে প্রত্যাশিত রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হওয়ায় বাধাগ্রস্ত হচ্ছে দেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রাও।

দেশি শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশের কাগজ এখন বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। মানও ভালো। পাশাপাশি চাহিদার চেয়েও বেশি উৎপাদন ক্ষমতা রয়েছে দেশি কাগজ কলগুলোর। তারপরও বন্ড সুবিধার আওতায় বিপুল পরিমাণ কাগজ আসছে বিদেশ থেকে। তাদের অভিযোগ, দেশে উৎপাদিত কাগজের মান-পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করা হলেও আমদানি করা কাগজের মান যাচাই করা হচ্ছে না। ফলে মিথ্যা ঘোষণা আর শুল্কফাঁকি দিয়ে আনা নিম্নমানের বিদেশি কাগজ কম দামে বিক্রি করা সম্ভব হচ্ছে।  

অসাধু চক্রের এমন অপতৎপরতা মোকাবিলায় দীর্ঘদিন ধরে দেশীয় শিল্প কারখানার মালিকরা বন্ড সুবিধার অপব্যবহার রোধে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছিলেন। ব্যবসায়ীদের দাবি আমলে নিয়েই জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বন্ড সুবিধার অপব্যবহার রোধে মাঠে নেমেছে। এনবিআরের এমন পদক্ষেপে দেশীয় শিল্পকারখানার মালিকরা সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন।

এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, রফতানিমুখী শিল্পকারখানাগুলো পুনঃরফতানির শর্তে শুল্কমুক্ত বন্ড সুবিধায় পণ্য আমদানির সুযোগ পায়। এসব কাঁচামাল বা পণ্য সরকার-নির্ধারিত গুদামে (বন্ডেড ওয়্যারহাউস) রক্ষিত থাকে। কিন্তু এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী দেশে শুল্কমুক্ত পণ্য এনে অবৈধভাবে অপসারণের মাধ্যমে তা খোলাবাজারে বিক্রি করে দিচ্ছেন। বন্ড সুবিধায় আনা কাপড়, প্লাস্টিক দ্রব্য, কাগজপণ্য, ডুপ্লেক্স বোর্ড, আর্ট কার্ড, কার্ড বোর্ড, বৈদ্যুতিক পাখা ইত্যাদি দ্রব্য ও পণ্য উৎপাদনের কাঁচামাল খোলাবাজারে বিক্রি করা হচ্ছে।

নয়াবাজারে ব্যস্ততা।  ছবি: ডিএইচ বাদলইপিজেড ও কাস্টমস সূত্রে জানা যায়, সম্প্রতি বন্ড সুবিধায় শুল্কমুক্ত কাগজ জাতীয় পণ্য আমদানি করে একটি বড় চালান কালোবাজারে বিক্রি করেছে বন্ড লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠান মুন স্টার। নয়াবাজারে কয়েক দফায় এই চালান বিক্রি করেছে তারা। এর আগেও প্রতিষ্ঠানটির ব্যাপক অনিয়ম ধরা পড়ে। কিন্তু কোনো দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ায় পুনরায় চোরাকারবারে জড়িয়ে পড়ে প্রতিষ্ঠানটি।

এ ব্যাপারে মুন স্টার ও খুলনা প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং লিমিটেডের চেয়ারম্যান আমজাদ হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বাংলানিউজকে বলেন, মুন স্টার বা খুলনা প্রিন্টার্সের কোনো অনিয়ম ধরা পড়েনি। নয়াবাজারে কাগজ বিক্রির জন্য কোনো জরিমানা বা শাস্তি দেওয়া হয়নি। আমরা কোনো কাগজ আমদানি করি না। মুন স্টার একটি গ্রুপ অব কোম্পানি। যারা কাগজ আমদানি করে তাদের শাস্তি হয়ে থাকতে পারে। আমার তা জানা নেই।

কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. মো. সহিদুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, বন্ড ব্যবস্থার অপব্যবহারের বিষয়ে আমরা সচেষ্ট আছি। এক্ষেত্রে অনেক কার্যক্রম চলছে। জিরো টলারেন্স নীতিতে কাজ করছি। যারা বন্ড সুবিধার অপব্যবহার করেছে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে আমরা কাজ শুরু করে দিয়েছি।

তিনি বলেন, এ লক্ষ্যে এনবিআরের চারটি প্রতিষ্ঠান মাঠে কাজ করছে। যেমন, কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট, ভ্যাট কমিশন, কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। দেশীয় শিল্প রক্ষার স্বার্থে আমাদের যা করণীয় করবো। ইতোমধ্যে আমরা মুন স্টার, সৈয়দপুর ইপিজেডের ফারদিন এক্সেসরিজ ও কোয়েস্ট এবং ঢাকার কেরানীগঞ্জের ওয়েবকোয়াটের বিরুদ্ধে কাগজপত্র তৈরি করেছি। পাশাপাশি শিগগির পুরান ঢাকার গুদামগুলোতে অভিযান পরিচালনা করা হবে।

জানা গেছে, মোংলা ইপিজেডের প্রতিষ্ঠান মুন স্টারের মালিক অত্যন্ত প্রভাবশালী। তার একাধিক প্রতিষ্ঠানের রয়েছে বন্ড লাইসেন্স। আগেও কাগজ জাতীয় পণ্য খোলাবাজারে বিক্রির অপরাধে ওই ব্যক্তির অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের নামে কয়েকটি মামলা করে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। তবু থামেনি চোরাচালান।

এনবিআরের কর্মকর্তারা বলছেন, কখনো চালান না দিয়ে, কখনো ভুয়া চালান দিয়ে বা কখনো একই চালান একাধিকবার ব্যবহার করে এবং বন্ডের আওতায় অবৈধভাবে পণ্য খালাস করে অসাধু ব্যবসায়ীরা ভ্যাট ফাঁকি দিচ্ছেন। শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের তৎপরতায় এখন বন্ডের অপব্যবহার কিছুটা কমে এসেছে। যারা বন্ড সুবিধার অপব্যবহার করছে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে কাজ করছে এনবিআর। নয়াবাজারে ব্যস্ততা।  ছবি: ডিএইচ বাদলঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের সহকারী কমিশনার আক্তার হোসাইন বাংলানিউজকে বলেন, দীর্ঘদিন ধরেই এক শ্রেণীর আমদানি বন্ডের আওতায় পণ্য বা কাঁচামাল আমদানি করে পাচার বা খোলাবাজারে বিক্রি করে দিচ্ছে। ওই অবৈধ কাজ প্রতিহত করার লক্ষ্যে ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের কমিশনারের নেতৃত্বে সাতটি প্রিভেনটিভ টিম মাঠে নেমেছে।  

গত দেড় মাসে ২৬ ঝটিকা অভিযান চালিয়েছে ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট। সংস্থাটির তথ্য মতে, এসব অভিযানে ৪০টি প্রতিষ্ঠানের ৩০ কোটি টাকার অনিয়ম উদঘাটন করা হয়েছে। সামনের শনিবার (১৬ মার্চ) থেকে ওয়্যারহাউজগুলোতে অডিটে যাচ্ছে।

আক্তার হোসাইন বলেন, বন্ডের আওতায় ফেব্রিকস, পিপিদানা (প্লাস্টিক তৈরির কাঁচামাল), এসিডিটিক এসিড, ডুপ্লেক্স বোর্ড, আর্ট কার্ড, পেডিং (ব্লেজার বা জ্যাকেট তৈরির কাঁচামাল) আমদানি করা হয়। বাণিজ্যিকভাবে আমদানি করা এসব পণ্য ওয়্যারহাউজে যাওয়ার আগেই কাগজ পত্র তৈরি করে ফেলে। সেখান থেকে বিভিন্নভাবে তারা খোলাবাজারে নিয়ে যায়। এজন্য আমরা রাতে অভিযান পরিচালনা করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পণ্য জব্দ করি। পরে ওইসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ‘দ্য কাস্টমস অ্যাক্ট ১৯৬৯, বন্ডেড ওয়্যার হাউস বিধিমালা ২০০৮’ এর আওতায় বিভাগীয় মামলা হয়। একইসঙ্গে তাদের বন্ডিং কার্যক্রম ও আমদানি-রপ্তানির তথ্য খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

বন্ড লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠান মুন স্টার প্রসঙ্গে  তিনি বলেন, বন্ড সুবিধার অপব্যবহার ও চোরাচালানের দায়ে অনেক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা চলমান রয়েছে। আশা করছি, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা যাবে। কালোবাজারে পণ্য বিক্রি করে কেউ পার পাবে না।

সরেজমিনে কাগজের সবচেয়ে বড় খোলাবাজার নয়াবাজারের একাধিক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শুল্ক সুবিধায় আনা কাগজ প্রায় প্রতিটি দোকানেই বিক্রি হচ্ছে। সবচেয়ে বেশি বিক্রি হচ্ছে ডুপ্লেক্স বোর্ড, আর্ট কার্ড, পেডিং পেপার। কিছু কিছু ব্যবসায়ী এলসির মাধ্যমে আমদানি করলেও বন্ডের মাধ্যমে শুল্ক সুবিধায় আমদানি করা কাগজের কারণে লোকসান গুনতে হয়। কারণ আমদানি করা এক রিম আর্ট কার্ড বিক্রি হয় ২৫০০ টাকা আর বিশেষ সুবিধায় আমদানি করা পণ্য বিক্রি হয় ১৮০০ টাকায়। ফলে ক্রেতারা কম দামের পণ্য নেয়।  

এজন্য নিজেরা খোলাবাজার থেকে পণ্য নিয়ে থাকেন জানালেও কে বা কারা ওই পণ্য আনে তা বলতে রাজি হননি ব্যবসায়ীরা। তারা বলেন, খোলাবাজারে পণ্য বিক্রি বন্ধ হলে আমরা যারা সৎ ব্যবসায়ী আছি তারা শান্তিতে ব্যবসা করতে পারবো।

তারা আরও বলেন, সাধারণত রাত ১১টার পর থেকে বন্ডের মাধ্যমে আনা পণ্য লোড-আনলোড হয়ে থাকে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ পেপার মার্চেন্ডস অ্যাসোসিয়েশনের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আবুল হোসেন বলতে পারবেন। তিনিই এ ব্যবসার মূল হোতা। পুরো নয়াবাজারের পেপার মার্কেট তার নিয়ন্ত্রণে চলে। তার কথায় সবাই ওঠে-বসে। তিনিই (আবুল হোসেন) বলতে পারবেন কে কে এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত।  

এ বিষয়ে বাংলাদেশ পেপার মার্চেন্ডস অ্যাসোসিয়েশনের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আবুল হোসেনের অফিসে কয়েক দফা গেলে অফিসের কর্মকর্তারা তার সঙ্গে দেখা বা যোগাযোগ করতে দেননি। তারা জানান, আবুল হোসেন অফিসে নেই। তার সেল নম্বর চাইলে বলেন, আমাদের নম্বর দেওয়ার কোনো এখতিয়ার নেই। কয়েকদিন পর এসে তার থেকে নেবেন। পরপর দুই দিন তার অফিসে গিয়েও কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।

দেশে বর্তমানে ৬ হাজার ৫৬৫টি প্রতিষ্ঠানের নামে বন্ড লাইসেন্স থাকলেও অনিয়মের কারণে ১ হাজার ৭৫৭ প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স স্থগিত করেছে কাস্টমস। আবার কারখানা বন্ধ থাকার পরও বন্ড লাইসেন্স আছে ২৪৩৮টি পোশাক ও প্যাকেজিং কারখানার।

বাংলাদেশ সময়: ১৩৩২ ঘণ্টা, মার্চ ১৩, ২০১৯
জিসিজি/এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।