কঠোর পরিশ্রম আর অভিজ্ঞতার ফলে যে কোনো কাজে যে কেউ স্বাবলম্বী হতে পারেন বলে প্রমাণ করেছেন মানিক মিয়া।
উপজেলার মধ্যে তিনি এখন সফল হাঁস খামারি হিসেবে পরিচিত।
মানিক মিয়া আগামীতে তার খামারটা আরও বড় করার জন্য কিছু জমি কেনার চেষ্টা করছেন। নকলাসহ জেলার অন্যান্য উপজেলার অনেক দরিদ্র পরিবার হাঁস পালনের মধ্য দিয়ে ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়েছেন, তাদের হয়েছে দিন বদল।
কিছুদিন আগেও মানিক মিয়ার পরিবারে অভাব অনটন ছিল নিত্যসঙ্গী। আর এ অভাবের তাড়নায় পেটের দায়ে মানিক গাজীপুর জেলার মির্জাপুর এলাকায় হাঁস-মুরগির একটি খামারে দীর্ঘদিন চাকরি করেছেন। সেখানকার অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে ২০১৮ সালে নিজ এলাকায় হাঁসের খামার করার পরিকল্পনা করেন।
পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০১৯ সালের শুরুতে হাঁসের খামার করার জন্য বানেশ্বরদী কান্দাপাড়া এলাকায় ৭০ শতাংশ নিচু জমি ৫ বছরের জন্য ২ লাখ ৪০ হাজার টাকায় বন্দক নেন। এ জমির একপাশে ১৫ শতাংশ জমিতে ৩ ফুট গভীর পুকুর কেটে সেখানে দেশীয় জাতের বিভিন্ন মাছ চাষ শুরু করেন। পুকুরের পাশেই অপেক্ষাকৃত উঁচু আরও ১০ শতাংশ জমি বছরে ৬ মণ ধান দেওয়ার শর্তে বন্দক নিয়ে টিনশেড একটি ঘর তৈরি করেছেন। ওই ঘরেই হাঁস ও মানিক মিয়া নিজে রাত যাপন করেন।
মানিক মিয়ার সঙ্গে কথা হলে তিনি বাংলানিউজকে জানান, দেশে বিভিন্ন জাতের হাঁস থাকলেও বা পালন করা হলেও অধিক ডিম উৎপাদনকারী খাকী ক্যাম্বল জাতের হাঁস পালন করে তিনি অধিক লাভবান হচ্ছেন।
তিনি জানান, ময়মনসিংহের নান্দাইল চৌরাস্তা এলাকা থেকে একদিনের প্রতিটি বাচ্চা ৩৫ টাকা করে কিনে আনেন। পরিবহনসহ প্রতিটি বাচ্চার পেছনে প্রথম দিনেই খরচ হয় ৩৮ টাকা করে। এতে করে ৭০০টি একদিনের বাচ্চা বাবদ ২৬ হাজার ৬০০ টাকা, ৭০ শতাংশ জমি বন্দক বাবদ ২ লাখ ৪০ হাজার টাকা ও ৬ মণ ধান, বিদ্যুৎ লাইন, সংযোগ ও বৈদ্যুতিক মটর বাবদ ২২ হাজার টাকা, হাঁস ও নিজে থাকার জন্য ঘর নির্মাণ বাবদ ২০ হাজার টাকা, পুকুর খনন, পাড় বাঁধা ও ৭০ শতাংশ জমিতে জাল দিয়ে হাঁসের জন্য ঘেরা দেওয়া বাবদ ৪০ হাজার টাকা ও অন্যান্য খরচসহ সর্বসাকুল্যে ব্যয় হয় প্রায় সাড়ে ৩ লাখ টাকা। এতে ২ লাখ টাকা নিজের আয়ের পুঁজি এবং বাকি টাকা ঋণের।
মানিক মিয়া জানান, বাচ্চা আনার দেড় মাসের মধ্যে উপজেলার আড়িকান্দা এলাকার জাফর আলী মহুরীসহ কয়েকজনের কাছে ৩০০টি হাঁস প্রতিটি ২৯০ টাকা করে বিক্রি করেছেন। বর্তমানে তার খামারে ৪০০টি বড় হাঁস আছে। এর মধ্যে ৩৭০টি মাদী এবং ৩০টি হাঁস মর্দা।
৩৭০টি মাদী হাঁসের মধ্যে দেড় মাস আগে থেকে ২৫টি হাঁস ডিম দেওয়া শুরু করে। বর্তমানে তা বেড়ে প্রতিদিন ১৪০ থেকে ১৫০টি হাঁস নিয়মিত ডিম দিচ্ছে। খুচরা হিসেবে প্রতি হালি হাঁসের ডিম ৪০ টাকা করে এবং পাইকারি শতকরা হিসেবে ১০০ ডিম বিক্রি হচ্ছে ৯০০ টাকা থেকে ৯৫০ টাকা করে।
মানিক মিয়া আশা প্রকাশ করে বলেন, অল্প কিছুদিনের মধ্যে শতকরা ৮৫ ভাগ মাদী হাঁস ডিম দেওয়া শুরু করবে। এতে করে প্রতিদিন ৩১০টি হাঁস ডিম দেবে। তবে প্রতিদিন অন্তত ১০০টি ডিম বিক্রির টাকা হাঁসের খাবার ও অন্যান্য ব্যয় বাবদ খরচ হবে। ব্যয় ছাড়াও দৈনিক এক হাজার ৮৯০ টাকা থেকে এক হাজার ৯৯০ টাকা তার আয় থাকবে। এ হিসেব মতে প্রতি মাসে ৫৭ হাজার টাকা থেকে ৬০ হাজার টাকা তার লাভ হবে।
ফলে বছরে তার লাভ দাঁড়াবে ৬ লাখ ৮৪ হাজার থেকে ৭ লাখ ২০ হাজার টাকা।
মানিক মিয়া বলেন, আগামী ভাদ্র মাস পর্যন্ত আমার খামারের মাদী হাঁসগুলো ডিম দেবে। খাকী ক্যাম্বেল জাতের হাঁস ২৪ মাস বয়স পর্যন্ত নিয়মিত ডিম দেয়। পরে আস্তে আস্তে কমতে থাকে। তাই ২৫ মাস বয়সের পরে আমার খামারের হাঁসগুলো বিক্রি করে দেব। তখন এসব হাঁস প্রতিটি কমপক্ষে ৩০০ টাকা করে বিক্রি করা সম্ভব হবে বলে আশা করছি।
প্রাণিসম্পদ চিকিৎসকরা জানান, হাঁসের রোগ বালাই সাধারণত কম হয়। তবে কিছু মৌসুমে ডাক প্লেগ ও ডাক কলেরা রোগের সম্ভাবনা থাকে। তাই বাচ্চার বয়স ২১ দিন থেকে ২৫ দিনের মধ্যে ডাক প্লেগের ভ্যাকসিন এবং ৭৫ দিনের মধ্যে ডাক কলেরার ভ্যাকসিন দিয়ে নিলে এসব মহামারী রোগে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা অনেকাংশে কমে যায়।
কান্দাপাড়া এলাকার মহিউদ্দিন কমলসহ অনেক গ্রামবাসী জানান, কিছুদিন অগেও মানিক মিয়ার সংসারে অভাব-অনটন ছিল, কিন্তু হাঁসের খামার করার পর তার অভাব দূর হয়েছে। সংসারে স্বচ্ছলতা ও জীবনে সফলতা এসেছে।
তারা বলেন, হাঁসের খামার করে মানিকের মতো যে কেউ সংসারের অভাব দূর করতে পারেন, হতে পারেন স্বাবলম্বী। এরই মধ্যে নকলাসহ বিভিন্ন জেলা উপজেলার অনেকে হাঁস পালনের মধ্য দিয়ে ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়েছেন, তাদের দিন বদল হয়েছে।
উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. আবুল খায়ের মুহাম্মদ আনিসুর রহমান বাংলানিউজকে জানান, বানেশ্বরদীর মানিক মিয়াসহ উপজেলায় চন্দ্রকোনা, অষ্টধর, পাঠাকাটা, টালকী, উরফা ইউনিয়নসহ বেশ কয়েকটি ইউনিয়নের অনেক দরিদ্র পরিবার ক্ষুদ্র আকারে হাঁসের খামার করে লাভবান হয়েছেন। তবে উপজেলার বানেশ্বরদী ইউনিয়নের বানেশ্বরদী কান্দাপাড়া এলাকার মানিক মিয়া অল্প শিক্ষিত হয়েও পূর্ব অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে ও কঠোর পরিশ্রম করে উপজেলার মধ্যে সফল হাঁস খামারি হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন। হাঁস পালন একটি লাভজনক ব্যবসা। যে কোনো বেকার নারী-পুরুষ হাঁস পালনে এগিয়ে এলে সরকার প্রয়োজনীয় সব ধরনের সহায়তা করবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন। এতে করে কমবে বেকারত্ব, বাড়বে কর্মসংস্থান।
তিনি আরও বলেন, উপজেলা প্রাণিসম্পদ বিভাগ থেকে হাঁস খামারি ও বাড়িতে পালনকারীদের নিয়মিত পরামর্শ সেবা দেওয়া হচ্ছে।
বাংলাদেশ সময়: ১০১০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৮, ২০১৯
আরএ