ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

করোনা আক্রান্তের ঝুঁকি নিয়েই লঞ্চে ঢাকা ছাড়ছে নগরবাসী

গৌতম ঘোষ, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২০৭ ঘণ্টা, মার্চ ২২, ২০২০
করোনা আক্রান্তের ঝুঁকি নিয়েই লঞ্চে ঢাকা ছাড়ছে নগরবাসী লঞ্চে ঢাকা ছাড়ছে

ঢাকা: করোনা আতঙ্কে গত কয়েক দিন ধরে ঝুঁকি নিয়েই লঞ্চে ঢাকা ছাড়ছে নগরবাসীরা। ঢাকা থেকে প্রতিদিন দক্ষিণাঞ্চলের ৩৮টি নৌরুটে শতাধিক লঞ্চ অবাধেই যাতায়াত করছে। যথেষ্ট জীবাণুনাশক বা হ্যান্ড ওয়াশের অভাবে মানতে পারছে না বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) পক্ষ থেকে দেওয়া নির্দেশনা। ফলে হাজার হাজার যাত্রী প্রতিদিন করোনা আক্রান্তের ঝুঁকি নিয়েই ঢাকা ছেড়ে গ্রামের বাড়ি ছুটছেন।

রোববার (২২ মার্চ) সদর ঘাট লঞ্চ টার্মিনালে গিয়ে দেখা যায়, ঢাকা থেকে দক্ষিণাঞ্চলের অভ্যন্তরীণ ৩৮টি নৌরুটে শতাধিক লঞ্চ ছেড়ে যায়। এরমধ্যে সন্ধ্যা সাড়ে ৮টায় পর্যন্ত ৩৪টি লঞ্চ ছেড়ে গেছে।

রাত সাড়ে ১২টার মধ্যে আরো ২৯ টি লঞ্চ ছেড়ে যাবে। এসব লঞ্চগুলোর মধ্যে বেশিরভাগ লঞ্চে মানা হচ্ছে না বিআইডব্লিউটিএর নির্দেশন। ছোট লঞ্চগুলোতে টয়লেটগুলোতে নেই পর্যপ্ত সাবান বা হ্যান্ডওয়াশ৷ অনেক লঞ্চে ওঠার সময় যাত্রীদের হাতে জীবাণুনাশক স্প্রে করতে দেখা যায়নি। যাত্রীরা যেভাবে খুশি লঞ্চে উঠে যাচ্ছে। যাত্রীদের মধ্যে বেশিরভাগই মাস্ক ছাড়া দেখা গেছে। লঞ্চের ডেকে বসে মালামাল নিয়ে যাত্রীরা গাদাগাদি করে যাচ্ছে। এতে কর্তৃপক্ষের কোনো নির্দেশনাই মানা হচ্ছে না।

এছাড়া প্রবাসী যাত্রীদের যাচাইয়েরও কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি। নির্দেশানুযায়ী লঞ্চে প্রবাসীদের অন্যান্য যাত্রীদের কাছ থেকে আলাদা আলাদা জায়গার ব্যবস্থা করার কথা থাকলেও এমন কোনো নির্দিষ্ট ব্যবস্থাও লক্ষ্য করা যায়নি কোনো লঞ্চেই। অন্যদিকে বিলাশবহুল লঞ্চগুলোতে প্রবেশের ক্ষেত্রে হ্যান্ড স্যানিটাইজার, স্যাভলন কিংবা হেক্সাসল দিয়ে হাত ধুয়ে যাত্রীদের ভেতরে প্রবেশ করানো হচ্ছে। তবে সেখানেও প্রবাসী যাত্রীদের শনাক্তকরনের জন্য বা আলাদা রাখার কোনো ব্যবস্থা দেখা যায়নি।

 

বরিশাল, ভোলা ও পটুয়াখালী লাইনের ছোট লঞ্চগুলোর স্টাফদের নিরাপত্তার বিষয়ে জানতে চাইলে তারা জানান, আমরা বিআইডব্লিউটিএর নির্দেশনা পেলেও নিরাপত্তার জন্য কোনো পণ্য পাইনি। কারণ বাজারে হ্যান্ড স্যানিটাইজার, হেক্সাসল পাওয়া যাচ্ছে না, তার ওপর স্যাভলনেরও সংকট রয়েছে। তাই সরবরাহ করতে না পারায় বিআইডব্লিউটিএর নির্দেশনা মানতে পারছি না। একইসঙ্গে প্রবাসী যাত্রীরা যদি নিজে থেকে পরিচয় না দেয় তাহলে কিভাবে তাদের চিনবো। আমরা শুধু যাত্রীদের জন্য ওয়াশরুমে সাবানের ব্যবস্থা করতে পেরেছি। আর একটু পর পর যাত্রীদের সতর্কতার জন্য মাইকিং করছি। অতিরিক্ত যাত্রী হলে তো নেবো।

 

এমভি ধূলীয়া-১ লঞ্চের সুপারভাইজার নুরনবী রায়হান বাংলানিউজকে বলেন, মানুষ করোনা আতঙ্কে দেশের বাড়ি যাচ্ছে। এজন্য আমরা লঞ্চ মালিকদের পক্ষ থেকে যাত্রীদের নিরাপত্তার জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছি। আমরা বিআইডব্লিউটিএর পাঠানো সব নির্দেশনা সঠিকভাবে পালন করছি। যাত্রীদের এ ভাইরাস থেকে নিরাপদ রাখার জন্য লঞ্চ আসার সঙ্গে সঙ্গে  জীবাণুনাশক দিয়ে লঞ্চটিকে পরিষ্কার করা হচ্ছে। প্রতিটা যাত্রীদের হাতে জীবাণুনাশক স্প্রে করা হচ্ছে। যাত্রীদের মাইকিং করে সতর্কবাণী দেওয়া হচ্ছে। এত যাত্রীদের মধ্যে নিরাপত্তা দেওয়া যাচ্ছে না। যাত্রীদের অনেকেই নিয়ম মানছে না।

 

বিদেশফেরত যাত্রীদের জন্য আলাদা কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, দিনে দিনে যাত্রীর সংখ্যা কমছে। আর কেউ যদি বিদেশ থেকে আসার বিষয়টি নিজ থেকে না জানান, তাহলে লঞ্চ কর্তৃপক্ষের সেটি জানার কোনো সুযোগ নেই। আর যারা জীবাণুনাশক সরবরাহ করতে পেরেছেন তারা বিআইডব্লিউটিএর নির্দেশ মানছে। তবে জীবাণুনাশক সংকটে অনেকেই সরবারহ করতে পারেনি। তারা এভাবেই যাত্রীদের আনা নেওয়া করছে।

 

লঞ্চের যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সব লঞ্চে জীবাণুনাশক দিয়ে সবার হাত পরিষ্কার করা হচ্ছে না। যারা যাত্রীদের জীবাণুনাশক দিচ্ছেন তা পরিমানে খুবই কম হওয়ায় হাত ভালোভাবে পরিষ্কার করা যায় না৷ তবে কিছু লঞ্চে শরীরের তাপমাত্রা মাপার যন্ত্র ব্যবহার করতেও দেখা গেছে, এটা ভালো উদ্যোগ।

 

বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করা পটুয়াখালীগামী লঞ্চের যাত্রী সোহরাব হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, করোনা আতঙ্কে অফিস থেকে ছুটি নিয়েছি। পরিবারকে নিরাপদে গ্রামের বাড়িতে রেখে আসতে যাচ্ছি। এখানে তেমন কোনো নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেয়নি কর্তৃপক্ষ। কি করবো রিকশা নিয়েই বাড়ি যাচ্ছি। কিছু হয়ে গেলে কিছু করার নেই। সব খানেইতো ভয়।

 

আরেক যাত্রী ফয়সাল বলেন, ছোট একটা কোম্পানিতে চাকরি করি। লোকজন বেশি বলে গতকাল না করে দিয়েছে। ঢাকায় বেকার বসে থেকে কি করবো। বাসা থেকেও বের হওয়া যায় না। তাই বাড়ি যাচ্ছি। কিছু করেতো খেতে হবে। কারণ প্রতিমাসে আমাকে ১০ হাজার টাকার কিস্তি দিতে হয়। ভাত খাইবা না খাই কিস্তি দিতেই হয়।

 

এ বিষয়ে লঞ্চমালিক সমিতির প্রধান উপদেষ্টার পিএইচ টিপু বাংলানিউজকে বলেন, আমরা নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করে যাচ্ছি। বাজারে স্যানিটাইজারের সংকটের জন্য সবাইকে হ্যান্ডওয়াশ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তাছাড়া একসঙ্গে লঞ্চে অনেক যাত্রী প্রবেশ করে এতে দুই একজন বাদ পড়তেই পারে। তবে আমরা আমাদের স্টাফদের হ্যান্ড গ্লাভসসহ টয়লেটে সাবানসহ দেওয়া হচ্ছে। এর বাইরে আমাদের আর কিছু করার নেই।

 

বিআইডব্লিউটিএর নৌ-নিরাপত্তা ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা বিভাগের যুগ্ম-পরিচালক আলমগীর কবির বাংলানিউজকে বলেন, ইতোমধ্যে বিআইডব্লিউটি থেকে লঞ্চ মালিকদের নির্দেশনা সম্বলিত চিঠি পাঠানো হয়েছে। এছাড়া যাত্রীদের করোনা ভাইরাস থেকে নিরাপদ রাখার জন্য লঞ্চ আসার সঙ্গে সঙ্গে জীবাণুনাশক দিয়ে লঞ্চটিকে পরিষ্কার করা হচ্ছে। এরপর অনেক লঞ্চের প্রবেশদ্বারে উন্নত তাপমাত্রাযন্ত্র দিয়ে প্রত্যেককে যাত্রীদের শরীরে তাপমাত্রা মাপা হচ্ছে। সঙ্গে যাত্রীদের হাতে জীবাণুনাশক স্প্রে করা হচ্ছে। যারা নির্দেশনা না মানবে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

 

তিনি বলেন, লঞ্চে যদি কোনো প্রবাসী যাত্রী আসে তাদের আলাদা জায়গায় রাখার ব্যবস্থা করতে বলা হয়েছে। লঞ্চে মাইকিং করে সতর্ক করা হচ্ছে এবং তাদের লঞ্চে উঠার ওপর হাত মুখ ধুয়তে বলাসহ মাস্ক ব্যবহার করতে বলা হচ্ছে। আমরা প্রতিনিয়ত মনিটরিং করছি। প্রতিটা লঞ্চে গিয়ে নির্দেশনা ঠিক মতো মানছে কিনা চেক করা হচ্ছে।

 

তিনি বলেন, আমরা লঞ্চ মালিকদের সঙ্গে সভা করেছি। তারা আমাদের কথা দিয়েছে বিআইডব্লিউটিএর সব নির্দেশনা মানবে। লঞ্চ বন্ধ করা হবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ সিদ্ধান্ত নেবে কর্তৃপক্ষ। তবে গত দুই দিনের তুলনায় যাত্রী কমে গেছে। পরিস্থিতি অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ অবশ্যই ব্যবস্থা নেবে।

 

নভেল করোনা ভাইরাসে এ পর্যন্ত বাংলাদেশেও আক্রান্ত হয়েছে ২৭ জন৷ মারা গেছেন দুইজন। প্রতিরোধের সতর্কতা হিসেবে নিজ ঘরে সঙ্গনিরোধে আছেন ১৪ হাজার মানুষ। এর মধ্যে বিদেশ ফেরতই অধিকাংশ।

 

বাংলাদেশ সময়: ২১৩৮ ঘণ্টা, মার্চ ২২, ২০২০

জিসিজি/এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।