ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

বাণিজ্যে বহুমুখী প্রভাব, ঝুঁকিতে পোশাক শিল্প

গৌতম ঘোষ, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৫৯ ঘণ্টা, মার্চ ২৯, ২০২০
বাণিজ্যে বহুমুখী প্রভাব, ঝুঁকিতে পোশাক শিল্প

ঢাকা: প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাসের প্রভাবে দেশের অর্থনীতি, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য, আমদানি-রপ্তানি খাতে বহুমুখী প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে পড়েছে পোশাক খাত।

চীন, ইউরোপ ও আমেরিকানির্ভর আমদানি রপ্তানি কমেছে। চীন থেকে এক মাসের ব্যবধানেই পণ্য আমদানি কমেছে প্রায় সাড়ে ২৬ শতাংশ।

বন্ধের পথে চীন, ইউরোপ ও আমেরিকায় চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, পোশাকসহ বিভিন্ন পণ্যের রপ্তানি।

করোনার প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় এরইমধ্যে পোশাক খাতে সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকার বেশি রপ্তানি অর্ডার বাতিল হয়েছে।

এদিকে দেশে করোনাভাইরাসের প্রভাব মোকাবিলায় সরকার সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। বিষয়টি স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মনিটরিং করছেন। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দফতরের মন্ত্রী ও কর্মকর্তাদের নিয়ে বৈঠক করে একটি ন্যাশনাল কমিটি গঠন করে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। করোনার কারণে রপ্তানি যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেদিকে দৃষ্টি রাখা হচ্ছে। শিল্প রক্ষায় সব ধরনের নীতিগত সহায়তা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত রয়েছে সরকার। তাছাড়া বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট দফতরগুলো এরইমধ্যেই তৎপর রয়েছে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দেশের অর্থনীতিতে এরইমধ্যে করোনা মহামারির প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। এ সংকট যত দীর্ঘায়িত হবে, বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশের অর্থনীতি এর প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই অর্থনীতিতে এর প্রভাব মোকাবিলায় সরকারকে প্রয়োজনীয় পূর্ব প্রস্তুতিসহ জনসচেতনতা বাড়ানো হবে। একই সঙ্গে জরুরি অবস্থায় জরুরি সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সুতরাং বিষয়টি সরকার কীভাবে নিচ্ছে এবং মোকাবিলা করার সক্ষমতার ওপরই অর্থনীতির ধাক্কা সামলোর বিষয়টি নির্ভর করছে।

জানা গেছে, বাংলাদেশে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত দুইজন রোগীর মৃত্যুর পর থেকে সবার মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে। ফলে অর্থনীতির প্রধান দুই খাত রেমিট্যান্স এবং রপ্তানি রয়েছে চ্যালেঞ্জের মুখে। ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্য থেকে দলে দলে মানুষের ফিরে আসা ও প্রবাসীদের বেশিরভাগ কাজে যোগ দিতে না পারায় শিগগিরই রেমিট্যান্স আহরণে বড় ধরনের ঝুঁকি আসন্ন। অন্যদিকে রপ্তানি অর্ডারও বাতিল করছে ক্রেতা দেশগুলো। বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হয় ইউরোপের ২৮টি দেশে। এ রকম একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ হচ্ছে ইতালি। দেশটির সঙ্গে বলতে গেলে এখন বাণিজ্য পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে।

অন্যদিকে একক দেশ হিসেবে সবচেয়ে বেশি পণ্য রপ্তানি হয় যুক্তরাষ্ট্রে। সর্বশেষ দেশটির সব অঙ্গরাজ্যে করোনা ছড়িয়ে পড়েছে। লকডাউন করা হয়েছে বেশ কয়েকটি অঙ্গরাজ্যে। এ অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেও বাণিজ্য প্রায় বন্ধ হওয়ার পথে। পোশাকের পাশাপাশি ইউরোপের দেশগুলোতে চামড়া, হিমায়িত মাছ, প্লাস্টিক পণ্য, পাট ও পাটজাত পণ্য এবং শাক-সবজি রপ্তানি বন্ধ হওয়ার পথে। এসব খাত থেকে বাংলাদেশ প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে থাকে।

এদিকে চামড়া শিল্পের উদ্যোক্তারা এরইমধ্যে তাদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। প্লাস্টিক পণ্যের উদ্যোক্তারা ক্ষয়ক্ষতি কমাতে আগামী বাজেটে বিশেষ কর ছাড় ও প্রণোদনা দাবি করেছেন। এছাড়া শাক-সবজি রপ্তানিকারকরা ইউরোপে বিশেষ কার্গো বিমান চাচ্ছেন। করোনা ভাইরাসের প্রভাবে এসব খাতে দীর্ঘমেয়াদে সঙ্কটের কথা বলছেন উদ্যোক্তারা। এছাড়া পোশাকের নতুন বাজার খ্যাত লাতিন আমেরিকা, জাপান ও প্রতিবেশী ভারতের বাজারেও সুখবর নেই। ফলে এ অবস্থায় দেশের রপ্তানি খাত বড় ধরনের ঝুঁকির মুখে রয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

এ বিষয়ে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, ‘প্রাণঘাতী করোনা বৈশ্বিক অর্থনীতিসহ বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এরইমধ্যে প্রভাব ফেলেছে। আমি এটাকে বলবো থ্রি টি। বিশেষ করে ব্যবসা বাণিজ্য, রেমিট্যান্স, আমদানি ও রপ্তানি ক্ষেত্রে, ট্রান্সপোর্ট খাত ও ট্যুরিজম খাতে প্রভাব পড়েছে। এ কারণেই করোনা আমাদের অর্থনীতির জন্য হতাশার ইঙ্গিত দিচ্ছে। নিত্যপণ্যের বাজার চড়া। সরকার এক্ষেত্রে সরবরাহ বাড়িয়ে বাজার ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। পাশাপাশি সার্বিক অর্থনীতিতে করোনার প্রভাব মোকাবিলায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে সরকার ঋণ সহায়তা দিতে পারে। ’

তিনি বলেন, ‘আমাদের সামগ্রিক আমদানির প্রায় ২৬ ভাগ আসে চীন থেকে। আমাদের রপ্তানি আয়ের অন্যতম উৎস তৈরি পোশাক শিল্পের জন্য কাপড়, সুতা তথা কাঁচামালের শতকরা ৬৬ ভাগ আসে চীন থেকে। তার মানে, এখানেও আমদানি মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। এতে রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এছাড়া যেসব দেশে আমরা তৈরি পোশাক রপ্তানি করি সেসব দেশও করোনায় আক্রান্ত। ইতালি, ফ্রান্স, জার্মানি, ইংল্যান্ড ও ইউরোপের উল্লেখযোগ্য দেশ যেখানে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের বড় বাজার রয়েছে। বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্রও। এ পরিস্থিতিতে কোনোভাবেই রপ্তানির হার স্বাভাবিক থাকবে না। এজন্য সরকারকে পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের জন্য সহায়তা ঘোষণা করতে হবে। ’

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ তৈরি পোশাক রফতানিকারকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি রুবানা হক বাংলানিউজকে বলেন, ‘করোনার প্রভাব দীর্ঘমেয়াদী হলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে তৈরি পোশাক খাত। এরইমধ্যে এ শিল্পের রপ্তানি অর্ডার বাতিল ও স্থগিত করা শুরু করেছেন ক্রেতারা। ’

তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের পোশাকের সবচেয়ে বড় বাজার হচ্ছে ইউরোপ ও আমেরিকা। দুঃখজনক, সবচেয়ে বেশি করোনা সংক্রমিত হয়েছে এসব জায়গায়। এ কারণে তৈরি পোশাক খাতের রপ্তানি কমে যাবে, এটাই সত্য। এখন পরিস্থিতি মোকাবিলায় দ্রুত করণীয় নির্ধারণ করা সম্ভব না হলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে বাধ্য। ’

তিনি বলেন, ‘একটি কারখানার চাকাও যাতে বন্ধ না হয়ে যায় উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে সেই উদ্যোগ রয়েছে। এখন সরকারকে এ ব্যাপারে নীতিগত সহায়তা দিতে হবে। বিজিএমইএ থেকে শিগগিরই এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করা হবে। ’

শুক্রবার (২৭ মার্চ) সকাল ১০টা পর্যন্ত ৯৬৬টি কারখানায় দুই দশমিক ৬৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের (প্রায় সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকা) অর্ডার বাতিল হয়েছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ পোশাক উৎপাদন ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ)।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) তথ্য মতে, চলতি অর্থবছরের ৮ মাসে বড় ধরনের হোঁচট খেল পণ্য রপ্তানি আয়। গত ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) ২ হাজার ৬২৪ কোটি ১৮ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। এই আয় গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৪ দশমিক ৭৯ শতাংশ কম। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কমেছে ১২ দশমিক ৭২ শতাংশ। আর ফেব্রুয়ারি মাসে প্রবৃদ্ধি ও লক্ষ্যমাত্রা কোনোটাই স্পর্শ করতে পারেনি দেশের তৈরি পোশাক খাত। চলতি অর্থবছরের ৮ মাসে ২ হাজার ১৮৪ কোটি ৭৫ লাখ ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে। এই আয় গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৫ দশমিক ৫৩ শতাংশ কম। একইসঙ্গে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় আয় কমেছে ১৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ। একক মাস হিসেবে ফেব্রুয়ারিতে রপ্তানি আয় অর্জিত হয়েছে ৩৩২ কোটি ২৩ লাখ টাকা। লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩৭২ কোটি ২০ লাখ ডলার।

দেশে করোনা ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা সব মিলিয়ে দাঁড়িয়েছে ৪৮ জনে। এরমধ্যে ৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। সারাদেশে প্রায় ৩০ হাজার মানুষ রয়েছেন হোম কোয়ারান্টিনে। করোনা প্রতিরোধে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে সভা-সমাবেশ ও জনজমায়েতের ক্ষেত্রেও। ২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। এ সময় সবাইকে বাসায় থাকতে অনুরোধ করা হয়েছে।

গত বছরের ডিসেম্বরে চীনের উহানে প্রথম করোনা ভাইরাস শনাক্ত হয়। এরপর তা বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় করোনা ভাইরাস এখন বৈশ্বিক মহামারি। বিশ্বজুড়ে এখন পর্যন্ত ৬ লাখ ৭৭ হাজার মানুষ করোনায় আক্রান্ত। মারা গেছেন ৩১ হাজার ৭৩৭ জন।

ভাইরাসটির কারণে ইতালি, স্পেন, ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্রে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে। জার্মানিও ধুঁকছে। দেশগুলোতে নিত্যপণ্য ছাড়া অন্যান্য দোকানপাট ও প্রতিষ্ঠান বন্ধ। অতি জরুরি প্রয়োজন ছাড়া লোকজন বাইরে বের হচ্ছে না। অনেক পোশাকের ব্র্যান্ড তাদের শত শত বিক্রয় কেন্দ্র ঘোষণা দিয়ে বন্ধ রেখেছে।

বাংলাদেশ সময়: ১৬৫৯ ঘণ্টা, মার্চ ২৯, ২০২০
জিসিজি/এজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।