ঢাকা, শনিবার, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

ক্ষেতের ফসল পচে যাচ্ছে ক্ষেতেই!

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০১৬ ঘণ্টা, মে ৬, ২০২০
ক্ষেতের ফসল পচে যাচ্ছে ক্ষেতেই!

কুষ্টিয়া: গ্রীস্মকালীন সবজিতে অধিক লাভ হয় প্রতিবছরই। তবে এবছর গ্রীস্মকালীন বাঁধাকপি চাষ করে লোকসানের আশঙ্কা করছেন কৃষকরা। এমনকি এসব বাঁধাকপি বিক্রি করে শ্রমিকের খরচও উঠছে না। শ্রমিকের খরচ এবং পরিবহনের কথা চিন্তা করে কৃষকের বাঁধাকপি এখন ক্ষেতেই পঁচে যাচ্ছে। খরচের ভয়ে ক্ষেত থেকে তুলছেন না বাঁধাকপি। 

এদিকে স্থানীয় বাজারে যার দাম ২ থেকে ৫ টাকার মধ্যে। মাঠ থেকে যা আনতেই খরচ হয়ে যায় ৩ থেকে ৪ টাকা।

 

কৃষকরা দাবি করছেন, করোনা ভাইরাসের কারণে বাঁধাকপি জেলার বাইরে পাঠাতে পারছেন না। বাইরে থেকে পাইকারি ক্রেতারাও আসতে পারছেন না। তাই বাঁধাকপি না কাটার কারণে ক্ষেতেই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।  

কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার মালিহাদ এলাকার কৃষক সিহাব উদ্দিন। তিন বিঘা জমিতে গ্রীস্মকালীন বাঁধাকপির চাষ করেছেন। এখন পর্যন্ত একটা বাঁধা কপিও বাজারে বিক্রি করতে পারেননি। ক্ষেতেই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে তার বাঁধাকপি। গতবছর বেশ ভালো ফলন পেলেও বাঁধাকপিতে এবার পুরো লোকসানের আশঙ্কা করছেন তিনি।

সিহাব উদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, শীতকালে এই এলাকায় ব্যাপক হারে সবজির চাষ হয়। এর মধ্যে বাঁধাকপি অন্যতম। এই এলাকায় বাঁধাকপিটা অনেক ভালো হয়। তবে শীতকালের তুলনায় গ্রীস্মকালের বাঁধাকপির দাম তুলনামূলকভাবে বেশি পাওয়া যায়। বাজারে এসময় চহিদাও বেশ ভালো থাকে। বিগত কয়েক বছর ধরেই আমি গ্রীস্মকালীন বাঁধাকপি চাষ করে বেশ লাভবান হয়েছি। তাই এবারো আমি এবং আমার ভাই উসমান গণি মিলে তিন বিঘা জমিতে গ্রীস্মকালীন বাঁধাকপির চাষ করেছি।  

তিনি বলেন, নিজেদের জমি হওয়ায় উৎপাদন খরচটা তুলনামূলক কম। সেই সঙ্গে জৈব সার ব্যবহারের ফলে রাসায়নিক সারও কম লাগে। আর রোগবালাইও কম দেখা যায়। গত বছর আমি ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা বিঘাপ্রতি খরচ করেছিলাম। বাজারো বেশ ভালো ছিলো। বিঘাপ্রতি ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকার বাঁধাকপি বিক্রি করেছিলাম।
 
ক্ষেতেই পচে যাওয়া বাঁধাকপি।  ছবি: বাংলানিউজতিনি আরও বলেন, এ বছর বিঘাপ্রতি ৪ থেকে সাড়ে ৪ হাজার বাঁধাকপির চারা রোপণ করেছি। গাছ এবং কপিও বেশ ভালো হয়েছে। ক্ষেতে কোনো রোগ বলাই হয়নি। সেইসঙ্গে আবহাওয়াও বেশ অনুকূলে ছিলো। গত বছর প্রতি পিস বাঁধাকপি আমি জমি থেকেই পাইকারি ১৫ থেকে ২০ টাকা দরে বিক্রি করেছিলাম।  

এবছরও প্রায় ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকার মতো বা তারও বেশি হতো। তবে এই করোনা ভাইরাসের কারণে বাজারে ক্রেতার সংখ্যা কম। সেইসঙ্গে রাস্তায় গাড়ি চলাচল বন্ধ থাকায় বাইরের জেলার ক্রেতারা আসতে পারছেন না। যেই বাঁধাকপি জমি থেকেই পাইকারি দামে ক্রেতারা কিনে নিয়ে যায় সেখানে কোনো ক্রেতাই আসছে না।

সিহাব উদ্দিন বলেন, বাজারের যে অবস্থা প্রতি পিস বাঁধাকপি ৩ থেকে ৪ টাকা। স্থানীয় বাজারে কপি ২ থেকে ৩ টাকা করে। জমি থেকে তুলে বাজারে নিতে যা খরচ তার চেয়ে কপির দাম কম। এমন থাকলে কপি কাটা শ্রমিকের দাম উঠবে না।  

অপর কৃষক উসমান গণি বাংলানিউজকে জানান, জমির বাঁধাকপি বিক্রির উপযুক্ত হয়েছে বেশ কয়েকদিন আগেই। এই করোনার জন্য এবং দামের যে অবস্থা এজন্য বাঁধাকপি কাটিনি। এর উপরে আবার দুদিন বৃষ্টি হলো। এতে ক্ষেতের কপি এখন ক্ষেতেই নষ্ট হচ্ছে। বাইরের জেলার ক্রেতারা না আসলে তো এবার পুরোটাই লস হয়ে যাবে।
 
কৃষক হারুন বাংলানিউজকে জানান, প্রতিবছরই এই এলাকায় বাঁধাকপির দাম বেশ ভালো থাকে। এবার  করোনার কারণে একদম কম। আমরা ক্ষেত থেকে বাঁধাকপি তো তুলবো কিন্তু বেঁচবো কোথায়। ১ টাকা ২ টাকা দামে বিক্রি করতে হবে। এর চেয়ে জমিতে থাকায় ভালো। লেবার খবর, গাড়ি ভাড়া ঘর থেকে দিতে হবে এমন হলে।

আবুরী মাঠপাড়া এলাকার কৃষক আক্তার আলীও অধিক লাভের আশায় এক বিঘা জমিতে গ্রীস্মকালীন বাঁধাকপির চাষ করেছেন। তারও একই অবস্থা। বাজারে দাম ও চাহিদা না থাকায় তিনিও বিক্রি করতে পারছেন না বাঁধাকপি।

তিনি বাংলানিউজকে জানান, প্রতিবছর এ সময় বাঁধাকপির বেশ দাম ভালো পাওয়া যায়। তাই এবছর গ্রীস্মকালীন বাঁধাকপির চাষ করেছি। কিন্তু এবার করোনার কারণে বাজারে লোকও নেই, দাম ও নেই। এক টাকা, দুই টাকায় কপি বিক্রি করে কোন খরচই উঠবে না।

আবুরী এলাকার কৃষক তুজাম আলী বাংলানিউজকে জানান, এবছর গ্রীস্মকালীন বাঁধাকপি চাষ করে আমরা বিপাকে পড়েছি। দাম নেই বাজারে। বাঁধাকপি কাটা, বাজারে নিয়ে যাওয়া যে খরচ সেটাও ঘর থেকে দিতে হবে মনে হচ্ছে। প্রতিবছর ক্রেতারা জমিতে এসে বাঁধাকপি নিয়ে যেতো। করোনার কারণে বাইরে থেকে ক্রেতারা আসতে পারছেন না।  

এসব চাষিদের দাবি, স্থানীয় বাজারের চেয়ে প্রতিবছর জেলার বাইরে থেকে ক্রেতারা আসেন। তাদের মাধ্যমে বিক্রি করলে বেশ ভালো লাভ হয় তাদের। সরকারি কোনো উদ্যোগ ছাড়া এসব বাঁধাকপি ক্ষেতেই নষ্ট হয়ে যাবে বলে জানায় কৃষকরা।
 
ক্ষেতে হতাশ কৃষক।  ছবি: বাংলানিউজজেলার অন্যতম বৃহত্তর পাইকারি কাঁচা সবজির বাজার দৌলতপুর উপজেলার খলিসাকুন্ডি বাজার। করোনার কারণে সেখানেও নেই ক্রেতার তেমন উপস্থিতি। বাইরে থেকে ক্রেতারাও তেমন আসছে না।
 
খলিসাকুন্ডি কাঁচা বাজারের পাইকারি ব্যবসায়ী জহুরুল ইসলাম বাংলানিউজকে জানান, করোনার কারণে বাইরের ক্রেতারা ঠিকমতো আসছে না। আমরাই সবজি বাইরে পাঠাতে সমস্যায় পড়ছি। বাঁধাকপির ক্রেতা না থাকায় বাজারে দাম একদম কম। পাইকারি ৪ থেকে ৬ টাকা পিস হিসাবে বিক্রি হচ্ছে।
আমলা সবজি বাজারের খুরচা সবজি বিক্রেতা আশরাফুল আলম সেতু বাংলানিউজকে জানান, বাজারে অন্য সময়ের তুলনায় বাঁধাকপির দাম অনেকটাই কম। আমদানির উপরে এর দাম নির্ভর করে। খুরচা প্রতিটা বাঁধাকপি ৮ থেকে ১০ টাকায় বিক্রি করছি।  

কুষ্টিয়া শহরের রাজার হাটের পাইকারি বাজারের সবজি ব্যবসায়ী রিয়ন আলী বাংলানিউজকে জানান, কিছুদিন আগে বাঁধাকপি কেজির দামে বিক্রি করেছি। এখন সেটা পিস হিসাবে। দাম কমেছে প্রায় অর্ধেক। ১০ টাকা কেজিদরের বাঁধাকপি এখন একটাই ১০ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে।  
 
এদিকে রাজশাহীর সাহেব বাজার এবং পাবনার বড় বাজারের সবজির আৎতদারদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সেখানেও গ্রীস্মকালীন বাঁধাকপির দাম খুবই কম। ক্রেতার সংখ্যা কম থাকায় এমনটি হয়েছে বলে মনে করেন তারা।  

কৃষকরা যাতে তাদের উৎপাদিত কৃষি পণ্যের ন্যায্য মূল্য পায় এজন্য সরকার ২০১৫ সালে আবুরী এলাকায় কৃষিপণ্য সরবাহ ও বিপণন কেন্দ্র স্থাপন করে। সেখানে ওই এলাকার ২০ জন কৃষকের সমন্বয়ে একটি কমিটির মাধ্যমে উক্ত বিপণন কেন্দ্রটি পরিচালিত হওয়ার কথা। তারা কৃষকদের কাছ থেকে ন্যায্য দামে পুরো ইউনিয়নের সবজি কিনে জেলার বাইরে যেখানে চাহিদা ভালো সেসব বাজারে বিক্রি করে লভাংশের টাকা কমিটির অন্যান্য সদস্যের মধ্যে বন্টন করে।

তবে স্থানীয় কৃষকদের অভিযোগ ওই বিপণন কেন্দ্রের জমির মালিক জুমারত আলী নিজের ইচ্ছা মতো কেন্দ্রটি ভোগ দখল করে আসছে। তারা কৃষকদের কোনো পণ্য কিনতে চান না। আর সবজি চাষিদের বিভিন্ন হয়রানি করার কারণে তারাও সেখানে যেতে চান না।
 
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আবুরী কৃষিপণ্য বিপণন কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক জুমারত আলী বাংলানিউজকে জানান, কৃষিপণ্য বিপণন কেন্দ্রের কার্যক্রম বন্ধ রাখা হয়েছে।  

উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, মিরপুর উপজেলার ঝুটিয়াডাঙ্গা, আবুরী এলাকার বেশ কয়েকজন কৃষক প্রতিবছরই গ্রীস্মকালীন বাঁধাকপির চাষ করে। এবছরও প্রায় ১০ থেকে ১২ বিঘার মতো জমিতে তারা বাঁধাকপির চাষ করেছেন।  

মিরপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ রমেশ চন্দ্র ঘোষ বাংলানিউজকে জানান, গ্রীস্মকালীন বাঁধাকপি চাষটা বেশ লাভজনক হওয়ায় মিরপুরের বেশ কয়েকজন কৃষক এ বাঁধাকপির চাষ করে থাকেন। প্রতিবছর তারা বেশ ভালো দাম পেয়েছেন। বিঘাপ্রতি খরচ বাদ দিয়ে ৫৫ থেকে ৬০ হাজার টাকা করেও লাভ করেছেন। বিগত বছর দেখা গেছে পাইকারি ক্রেতারা এসে কৃষকদের জমি থেকেই ভালো দামে বাঁধাকপি কিনে নিয়ে গেছে। তবে এবার করোনা পরিস্থিতির কারণে একটু অসুবিধা হচ্ছে। দাম অনেকটাই কম। তবে কৃষকরা যাতে ন্যায্য দামে বাঁধাকপিসহ অন্যান্য সবজি বিক্রি করতে পারে সে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। ইতিমধ্যেই ঢাকার পাইকারি বাজারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে।  

তিনি আরো জানান, কৃষকরা যাতে তাদের উৎপাতি পণ্য সঠিকভাবে বাজারজাত করতে পারেস এ ব্যপারে কৃষি সম্প্রসরাণ অধিদপ্তর থেকেও আমাদের নিদের্শনা দেওয়া হয়েছে। সে মোতাবেক আমরা কাজ করছি।  

জেলার বাজার কর্মকর্তা রবিউল ইসলাম বাংলানিউজকে জানান, বাজারে বাঁধাকপির চাহিদা অনেকটাই কম। আর বাঁধাকপিটা শীতকালীন সবজি হওয়ায় সে সময় উৎপাদন বেশি হয়। কৃষকরা যাতে ন্যায্য মুল্যে বিক্রি করতে পারে এজন্য অন্যান্য জেলার বাজারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে। কৃষিপণ্য পরিবহণের ক্ষেত্রে কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করছে বলেও জানান তিনি।
 
বাংলাদেশ সময়: ০৯৫৫ ঘন্টা, মে ০৬, ২০২০
আরএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।