ঢাকা, শনিবার, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

ব্যাংকের বিজ্ঞাপন বন্ধের খবরে ক্ষুব্ধ গণমাধ্যম সংশ্লিষ্টরা

শাহেদ ইরশাদ, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯৫৯ ঘণ্টা, জুন ২৪, ২০২০
ব্যাংকের বিজ্ঞাপন বন্ধের খবরে ক্ষুব্ধ গণমাধ্যম সংশ্লিষ্টরা

ঢাকা: করোনা ভাইরাসের কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক অবস্থা মোকাবেলায় বেসরকারি ব্যাংকের ব্যয় সংকোচনে পত্রিকা (অনলাইন-প্রিন্ট) ও টেলিভিশনে বিজ্ঞাপন প্রচার বন্ধ করাসহ ১৩টি সুপারিশ করেছে বেসরকারি ব্যাংক মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস-বিএবি। 

সংবাদপত্রের মূল আয়ের উৎস বিজ্ঞাপন। বর্তমানে বেসরকারি ব্যাংকগুলো এই বিজ্ঞাপনের প্রায় ৫০ শতাংশ সরবরাহ করে থাকে।

এমন পরিস্থিতিতে ব্যাংকগুলো বিজ্ঞাপন প্রচার বন্ধ করে দিলে গণমাধ্যমের টিকে থাকা অসম্ভব হয়ে যাবে।  

এমনিতেই গত তিনমাস ধরে বিজ্ঞাপন কমে গেছে। দেখা দিয়েছে অর্থনৈতিক বির্পযয়। অযাচিতভাবে ব্যাংকের বিজ্ঞাপন বন্ধের এই সিদ্ধান্তে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন গণমাধ্যম মালিক, সম্পাদক ও সাংবাদিক নেতারা।

প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংক-বিএবির বিজ্ঞাপন বন্ধের সমালোচনা করে সম্পাদক পরিষদের সভাপতি ও ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম বলেন, যে সংগঠনটি এ ধরনের বিবৃতি দিয়েছে, তাদের এ বক্তব্য শুনে আমি স্তম্ভিত। প্রতিটি ব্যাংক তার নিজস্ব প্রয়োজনে বিজ্ঞাপন দেবে কি দেবে না, তা তারা নিজেই নির্ধারণ করবে। সেখানে এ সংগঠনের বাধা দেওয়ার কোনো এখতিয়ার নেই। আমরা মনে করি, এ ধরনের সিদ্ধান্ত মিডিয়াকে হেনস্তা করবে। মিডিয়ার স্বার্থ ক্ষুণ্ন করবে। মিডিয়ার সঙ্গে ব্যাংকের যে সম্পর্ক রয়েছে, তা নষ্ট হবে। মনে রাখতে হবে, মিডিয়ার যেমন ব্যাংকের প্রয়োজন, তেমন ব্যাংকেরও মিডিয়া প্রয়োজন। অবশ্যই বিএবির এ সিদ্ধান্ত নেতিবাচক। এতে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও অর্থনৈতিকভাবে টিকে থাকতে বাধাগ্রস্ত হবে। আমরা খুব জোরালো দাবি করব, বিএবি কালক্ষেপণ না করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে এ সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করবে।  

ডেইলি স্টার সম্পাদক বলেন, সরকার যখন সব সেক্টরকে প্রণোদনার মাধ্যমে বেঁচে থাকতে সাহায্য করছে, সেখানে আমরা সংবাদপত্রশিল্প কিছুই পাইনি। এমনকি আমাদের ন্যায্য পাওনা, বহু বছর ধরে বকেয়া বিল জমা পড়ে আছে। তারা যদি এ মুহূর্তে সে বিল পরিশোধ করত, তাহলে আমাদের অনেক সাহায্য হতো। এ নিয়ে আমরা তথ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছি। তিনি আমাদের আশ্বস্তও করেছিলেন। কিন্তু আজ অবধি কোনো ফল পাইনি। সরকার যখন অন্যান্য শিল্পকে প্রণোদনা দিচ্ছে, সেখানে আমরাও তো প্রণোদনার যোগ্য, জনসেবামূলক খাত হিসেবে। এ ক্ষেত্রে প্রণোদনা তো পাচ্ছিই না, আমাদের ন্যায্য পাওনা যদি সরকার আমাদের দিত, তাহলে এ শিল্পে অনেক সহায়তা হতো। দুর্দিনে বেঁচে থাকার সহায়তা হতো।  

নিউজ পেপার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-নোয়াব সভাপতি ও সমকালের প্রকাশক এ কে আজাদ বলেন, দেশের পত্রিকা ও টেলিভিশনগুলো ভোগান্তিতে পড়েছে। মহামারি করোনা ভাইরাসের প্রভাবে বিজ্ঞাপন নেই বললেই চলে। সরকারি বিজ্ঞাপন যেটুকু হয়, তাও অত্যন্ত কম। সময়মতো সরকারি বিজ্ঞাপন বিলও পাওয়া যাচ্ছে না। যেখানে পত্রিকাগুলো সরকারের কাছে ১৫০ থেকে প্রায় ২০০ কোটি টাকা বকেয়া পাওনা রয়েছে, সেখানে চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদফতরকে মাত্র ১০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।  

বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সমকাল প্রকাশক এবং হা-মীম গ্রুপের এই কর্ণধার আরও বলেন, দেশের টেলিভিশন ও পত্রিকাগুলো এখন রুগ্ন শিল্পে পরিণত হয়েছে। অনেকে চাকরি হারিয়েছেন। অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়েছে। এরপর করোনা মহামারি চলাকালে ব্যাংক মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস-বিএবি বিজ্ঞাপন বন্ধে যে বিবৃতি দিয়েছে, তা মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। কোনো ব্যাংকের বিজ্ঞাপন প্রদানের ক্ষেত্রে বিএবি হস্তক্ষেপ করতে পারে না। এটা তারা সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়নি। কারণ বিএবির কিছু নিয়ম-কানুন মেনেই চলা উচিত। আশা করছি বিএবি সংশোধন করে দ্রুত একটি বিজ্ঞাপন দেবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এবং গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেছেন, মহামারি ও দুর্যোগকালীন পরিস্থিতিতে সবচেয়ে জরুরি সঠিক তথ্যপ্রবাহ। তাই সমাজের স্বার্থে, গণমানুষের স্বার্থেই গণমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। স্বাধীন গণমাধ্যম ও সংবেদনশীল সরকার থাকলে মহামারি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। এ সময়ে বিজ্ঞাপন বন্ধ করে গণমাধ্যমকে অস্তিত্ব সংকটে ফেলা কোনোভাবেই উচিত নয়। সংবাদকর্মীরা প্রথম সারির যোদ্ধা। অন্যদের নানারকম প্রণোদনা, সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। অথচ এ খাতকে বিজ্ঞাপন বন্ধ করে ঝুঁকির মুখে ফেলা হচ্ছে। গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অসংখ্য সংবাদকর্মীর জীবন-জীবিকা জড়িয়ে রয়েছে। নোবেল বিজয়ী জোসেফ স্টিগলিৎজ বলেছেন, স্বাধীন গণমাধ্যম ও সংবেদনশীল সরকার থাকলে মহামারি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। এ কথার সঙ্গে আমি পুরোপুরি একমত।  

সাংবাদিক হয়রানির বিষয়ে তিনি বলেন, দেশে আইন থাকে অন্যায় রোধ করার জন্য। গণমাধ্যমের কণ্ঠ রোধের জন্য নয়। কোনো স্বাধীনতাই নিরঙ্কুশ নয়। কিন্তু নিয়ন্ত্রণের নামে সাংবাদিক হয়রানি করলে স্বাধীন গণমাধ্যমের পথে বাধার সৃষ্টি হয়। এজন্য ভুক্তভোগী দেশের জনগণই হবে।

এডিটরস গিল্ডের সভাপতি, অ্যাসোসিয়েশন অব টেলিভিশন চ্যানেল ওনার্স (অ্যাটকো)-এর সিনিয়র সহসভাপতি এবং একাত্তর টেলিভিশনের প্রধান সম্পাদক মোজাম্মেল বাবু বলেছেন, গণমাধ্যম ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান হাতে হাত রেখে এগোচ্ছে। ব্যাংকার ও গণমাধ্যমকর্মী এ দুটি গ্রুপই করোনা মহামারির সম্মুখ যোদ্ধা। বিজ্ঞাপন কম থাকলে কম দেবে তা অনুমেয়। কিন্তু এ দুর্যোগে ঘোষণা দিয়ে বিজ্ঞাপন বন্ধ করা এ দুই প্রতিষ্ঠানের সম্পর্কের মধ্যে বৈরিতা সৃষ্টি করবে।  

তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি) বিজ্ঞপ্তি দিয়ে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপন বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ব্যাংক খোলা থেকে সেবা দিতে হয়, গণমাধ্যমকর্মীদেরও নিয়মিত তথ্যসেবা দিতে হয়। ব্যাংকগুলো তাদের ব্র্যান্ডিং কিংবা নতুন সেবা আনলে সে সম্পর্কিত বিজ্ঞাপন দিয়ে থাকে। তাদের প্রোডাক্ট কম থাকলে বিজ্ঞাপন কম দিত বা না দিত। সেটা নিয়ে তো কোনো মন্তব্য থাকতে পারে না। কিন্তু যখন ঘোষণা দিয়ে জানানো হয় তখন দুটি প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতার সম্পর্কে ফাটল ধরে।

বাংলাদেশ সময়: ১৯৪১ ঘণ্টা, জুন ২৪, ২০২০
এসই/এজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।