ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

প্রাণিরোগ ঠেকাতে অনীহা, ৭৭ কোটি টাকার ব্যর্থতা

মফিজুল সাদিক, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০০৩ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১, ২০২০
প্রাণিরোগ ঠেকাতে অনীহা, ৭৭ কোটি টাকার ব্যর্থতা

ঢাকা: আমদানি করা গরু-ছাগলসহ বিভিন্ন প্রাণি, প্রাণিখাদ্য ও এ সংশ্লিষ্ট যে কোনো পণ্যের মাধ্যমে দেশে যাতে প্রাণিরোগ ছড়িয়ে পড়তে না পারে তা নিশ্চিত করার জন্য যে প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছিল, তা বিফলে গেছে।  এরইমধ্যে সে প্রকল্পে খরচ হয়ে গেছে সাড়ে ৭৭ কোটি টাকা।

প্রকল্পে সমম্বয়হীনতা ও সঠিক পরিকল্পনার অভাবে কাজের কাজ কিছুই হয়নি। উচ্চমূলে কেনা বিভিন্ন সরঞ্জাম পড়ে থেকে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

প্রকল্পের আওতায় দেশের ১৭টি জেলার ২৪টি প্রবেশ পথে ২৪টি কোয়ারেন্টিন স্টেশন স্থাপন করা হয়। কিন্তু লোকবল শূন্যতা আর সমম্বয়হীনতার কারণে ২২টি স্টেশন চালুই হয়নি। বাকি দুটি স্টেশনেও চলছে দায়সারা কাজ।

সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় দেশের বাইরে থেকে আসা প্রাণিরোগ ঠেকাতে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের এমন অনীহার চিত্রই ফুটে উঠেছে সরকারের প্রকল্প বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) এক প্রতিবেদনে।

আইএমইডি সে প্রতিবেদন প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরে পাঠানো হয়েছে।

কোয়ারেন্টিন স্টেশন স্থাপনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল প্রাণিরোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ। অর্থাৎ বিদেশ থেকে আমদানি করা যে কোনো প্রাণি, প্রাণিজাত পণ্য, প্রাণিখাদ্য, টিকা, সিমেন এসব স্টেশনে নিয়ে পরীক্ষা করে রোগমুক্ত প্রমাণিত হলেই কেবল দেশে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া।

কর্মসংস্থান ও আমিষের চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে দেশে স্থানীয়ভাবে গবাদি প্রাণি প্রতিপালন ও বাণিজ্যিকভাবে গবাদি প্রাণির খামার বাড়ছে। ফলে ক্রয়-বিক্রয় দিন দিন বাড়ছে। এছাড়া গবাদি পশুর খাদ্য, প্রাণির উৎপাদন উপকরণ দেশে প্রবেশ করছে। মাংস, ডিম, বাটার, দই, পনির আমদানি করা হচ্ছে। এ সব উপকরণ ও খাদ্য পণ্যের মাধ্যমেও সংক্রামক রোগ ব্যধি এবং জুনোটিক রোগ দেশে প্রবেশ করতে পারে। এসব কথা বিবেচনা করেই প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হয়।

২০১২ সালের জুলাই থেকে ২০১৭ সালের জুন মেয়াদে ‘প্রাণিরোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ (২য় সংশোধিত)‘ প্রকল্পটির কাজে ইতি টানে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর।

আইএমইডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রকল্পটি বাস্তবায়ন না হওয়ায় ক্ষুরারোগ, বার্ডফ্লু ইত্যাদি রোগ সীমান্ত এলাকা দিয়ে দেশে প্রবেশ করে সংক্রমণ ঘটানোর ব্যাপক আশঙ্কা আছে, যা মানব স্বাস্থ্যের জন্যও ক্ষতিকর।

প্রতিবেদনে আরও উঠে এসেছে, বিদেশি রোগ থেকে দেশের প্রাণিসম্পদকে বাঁচাতে বিশাল অঙ্কের টাকা ব্যয় করে ২৪টি কোয়ারেন্টিন স্টেশন নির্মাণের কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছিল। কিন্তু নানা জটিলতায় ২২টি স্টেশনই এখনও চালু করা সম্ভব হয়নি। কোয়ারেন্টিন স্টেশনগুলোর জন্য বিভিন্ন পদে রাজস্ব খাতে মোট ৩২৪টি পদ সৃষ্টির প্রস্তাব করা হলেও চূড়ান্তভাবে মাত্র ১৫৫টি পদে নিয়োগের অনুমতি পাওয়া যায়। কিন্তু নানা জটিলতায় এই জনবলও নিয়োগ হয়নি, ফলে ২২টি কোয়ারেন্টিন স্টেশন চালু করা যায়নি।

হযরত শাহজালালর আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর ও চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর স্টেশনে প্রেষণে নিয়োজিত স্বল্প সংখ্যাক জনবল দিয়ে সীমিতভাবে কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। ফলে সরকারের সাড়ে ৭৭ কোটি টাকাই অপচয় হচ্ছে বলে দাবি করেছে সরকারের একমাত্র প্রকল্প তদারকি সংস্থা আইএমইডি।

আইএমইডির দাবির সঙ্গে একমত পোষণ করে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) ডা. শেখ আজিজুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, নানা জটিলতার কারণে ২৪টির মধ্যে ২২টি কোয়ারেন্টিন স্টেশন চালু করতে পারিনি। বিদেশ থেকে রোগাক্রান্ত প্রাণী প্রবেশ করলেও কিছু করা যাচ্ছে না। প্রকল্পের আওতায় কেনা দামি দামি যন্ত্রপাতি নষ্টও হচ্ছে। তবে আমরা জনবল নিয়োগের কাজ শুরু করেছি। করোনা ভাইরাস না এলে এতোদিনে সবগুলো স্টেশন চালু করতে পারতাম। আশা করছি আগামী তিন মাসের মধ্যেই জনবল নিয়োগ দিয়ে কোয়ারেন্টিন স্টেশনগুলো চালু করতে পারবো। ’

আইএমইডি প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, প্রকল্পের সংশোধিত কার্যক্রমে বলা হয়েছে, ২০১৭ সালের জুনে প্রকল্প সমাপ্তির পর রাজস্ব খাতের জনবল দিয়ে প্রকল্পের সেবা কার্যক্রম অব্যাহত রাখা হবে। কিন্তু জনবল নিয়োগ করা সম্ভব না হওয়ায় কোয়ারেন্টিন স্টেশনগুলোর মধ্যে ২২টি কেন্দ্র চালু করা সম্ভব হয়নি। টাকা খরচ হলেও পরিকল্পনা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হয়নি। ফলে যন্ত্রপাতি ও উপকরণের ব্যবহার এবং রক্ষণাবেক্ষণ নিশ্চিত করা যায়নি। প্রভাব মূল্যায়নের জন্য প্রকল্প এলাকা সরেজমিন পরিদর্শন করা হয়। ২৪টির মধ্যে ১৭টি কেন্দ্রকে সমীক্ষা করা হয়। সেবা চালু রয়েছে এমন কোয়ারেন্টিন স্টেশনের সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ী, সরাসরি সুবিধাভোগী ও স্টেকহোল্ডারদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হয়। অর্থাৎ চালুকৃত স্টেশন হতে ৩০ জনের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হয়।

সবাই মতামত প্রকাশ করে যে, নিরাপদ ও রোগমুক্ত প্রাণিসম্পদ, প্রাণি খাদ্য ও প্রাণিজাত পণ্যের আমদানি রফতানি নিশ্চিত করা গেলে দেশে প্রাণি সম্পদের উৎপাদনে বিকাশ ঘটবে, মানব ও পশু স্বাস্থ্য অধিকতর নিরাপদ হবে। সকল স্টেশন পূর্ণাঙ্গরূপে চালু করা হলে এখাতে অনেক কর্মসংস্থান হবে, আমদানি রফতানি বৃদ্ধিসহ রাজস্ব আয় বৃদ্ধি পাবে।

সমীক্ষা প্রতিবেদনে আরও উঠে এসেছে, জনবল নিয়োগ না করায় কোয়ারেন্টিন স্টেশনগুলো চালু করা যায়নি। প্রকল্পের অর্থে কেনা ল্যাব যন্ত্রপাতি, অফিস যন্ত্রপাতি, কেমিক্যাল ও ক্রোকারিজ সামগ্রী দীর্ঘদিন বাক্সবন্দী অবস্থায় পড়ে থাকায় এগুলো নষ্ট হচ্ছে। অধিকাংশ কোয়ারেন্টিন স্টেশন স্থলবন্দর থেকে অনেক দূরে নির্মাণ করা হয়েছে। ফলে আমদানিকরা প্রক্রিয়া এড়ানোর সুযোগ পাবে, যা দেশের মানুষ ও গবাদি পশুর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।

প্রকল্প বাস্তবায়নে দুর্বল দিক চিহ্নিত করে আইএমইডি জানায়, অনেকগুলো কোয়ারেন্টিন স্টেশনের আইসোলেশন শেডের ত্রুটি রয়েছে। বাইরের ড্রেন নির্মাণ কাজ নিম্নমানের হয়েছে। গবাদি পশু রাখার স্থান, পানি ও খাবার রাখার স্থান নিম্নমানের। দেশের অভ্যন্তরে বৈধভাবে নিরাপদ ও রোগমুক্ত প্রাণি প্রবেশের জন্য কোনো সমন্বয় নেই। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর কোয়ারেন্টিন স্টেশনের মাধ্যমে আগত প্রাণি স্টেশনের ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষার সুযোগ না থাকায় রোগাক্রান্ত প্রাণী পরীক্ষার কাজ চূড়ান্ত হওয়ার আগেই আমদানিকারকের তত্ত্বাবধানে চলে যায়। এছাড়া পরীক্ষার জন্য তিন থেকে চার দিন সময় লাগে। ফলে সার্বিক অর্থে প্রকল্পের উদ্দেশ্য এখনো অর্জিত হয়নি। স্টেশনগুলোতে প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ না করায় প্রকল্পের উদ্দেশ্য পুরোপুরি অর্জিত হয়নি।

প্রকল্পের আওতায় সাড়ে ৭৭ কোটি টাকা খরচ করে ভূমি অধিগ্রহণ, ২০টি কেন্দ্রের ভূমি উন্নয়ন, ২০টি আইসোলেশন শেড, ২৪টি কেন্দ্রের জন্য ল্যাব যন্ত্রপাতি, উপকরণ, আসবাবপত্র, একটি জিপ, সাতটি পিকআপ, ১৭টি মোটরসাইকেল, কম্পিউটার ও ৬৪টি ল্যাপটপ কেনা হয়েছে।

বাংলাদেশ সময়: ১০০৩ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০১, ২০২০
এমআইএস/এজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।