ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

ঘাটতি নেই, তিন কারণে বাড়ছে চালের দাম

গৌতম ঘোষ, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭১২ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৯, ২০২২
ঘাটতি নেই, তিন কারণে বাড়ছে চালের দাম

ঢাকা: দেশের মিলগেট, পাইকারি ও খুচরা বাজারসহ কোথাও চালের ঘাটতি নেই। সরবরাহ স্বাভাবিক আছে, দুর্ভিক্ষ হওয়ারও কোনো আশঙ্কা নেই—এরপরও বিভিন্ন অজুহাতে বাড়ছে চালের দাম।

ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলা জানা গেছে, সংকটের খবরে হঠাৎ প্রয়োজনের অতিরিক্ত চাল ক্রয়, কর্পোরেট কোম্পানিগুলোর বাজার থেকে চাল ক্রয় এবং উৎপাদন খরচ বেশি—এই তিন অজুহাতে প্রতিনিয়তই বাড়ছে এই নিত্যপণ্যের দাম। ফলে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠছে। সপ্তাহের ব্যবধানে খুচরা বাজারে চালের দাম কেজিতে বেড়েছে ৪ থেকে ৫ টাকা। আর পাইকারি বাজারে ২ থেকে ৩ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। এজন্য বাজার মনিটরিং আরও বাড়ানো প্রয়োজন বলে মনে করছেন ভোক্তা ও ব্যবসায়ীরা।

শনিবার (১৯ নভেম্বর) রাজধানীর কয়েকটি খুচরা ও পাইকারি বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, খুচরা বাজারে জাত ও মানভেদে প্রতি কেজি মিনিকেট চাল বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ৭৬ টাকা। নাজিরশাইল চাল ৭০ থেকে ৮৫ টাকা, মাঝারি মানের বিআর আটাশ চাল ৬০ থেকে ৬৪ টাকা এবং মোটা স্বর্ণা বিক্রি হচ্ছে ৫৬ টাকা ও হাইব্রিড মোটা ৫০ টাকা।

এক সপ্তাহ আগেও খুচরা বাজারে জাত ও মানভেদে প্রতি কেজি মিনিকেট চাল ৬৫ থেকে ৭২ টাকা, নাজিরশাইল চাল ৬৫ থেকে ৭৮ টাকা, মাঝারি মানের বিআর আটাশ চাল ৫২ থেকে ৫৬ টাকা, মোটা চাল স্বর্ণা ৪৬ টাকা এবং হাইব্রিড মোটা ৪৬ টাকা দরে বিক্রি হয়েছিল।

পাইকারি বাজারে চিকন চাল প্রতি কেজি মিনিকেট মানভেদে বিক্রি হচ্ছে ৬৮ থেকে ৭০ টাকা। ৫০ কেজির বস্তা ৩৪০০ থেকে ৩৫৫০ টাকা, যা এক সপ্তাহ আগে মানভেদে বিক্রি হয়েছিল ৬২ থেকে ৬৯ টাকা আর বস্তা ৩০০০ থেকে ৩৪০০ টাকা। নাজিরশাইল চাল বিক্রি হচ্ছে ৬৩ থেকে ৭৫ টাকা আর ৫০ কেজির বস্তা ৩২৫০ থেকে ৩৭৫০ টাকা, যা গত সপ্তাহে বিক্রি হয়েছিল ৬০ থেকে ৭২ টাকা, বস্তা ৩০০০ থেকে ৩১০০ টাকা। মাঝারি মানের প্রতিকেজি বিআর ২৮ নম্বর প্রতিকেজি চাল ৫৫ থেকে ৫৭ টাকা আর বস্তা ২৭৫০ থেকে ২৮৫০ টাকা, যা গত সপ্তাহে ছিল ৫৫ থেকে ৫৫ টাকা, বস্তা ২৭০০ থেকে ২৭৫০ টাকা। মোটা চাল প্রতি কেজি স্বর্ণা মানভেদে ৫০ থেকে ৫২ টাকা আর বস্তা ২৫০০ থেকে ২৬০০ টাকা, যা গত সপ্তাহে ছিল ৪৭ থেকে ৪৮ টাকা, বস্তা ২৩৫০ থেকে ২৪০০ টাকা। হাইব্রিড ধানের চাল বা সবচেয়ে মোটা চালের দাম কেজিতে ৪৬ টাকা আর বস্তা ২৩০০ টাকা, যা আগে ছিল ৪১ টাকা কেজি, বস্তা ২০৫০ টাকায় বিক্রি হতো।

সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশের বাজারে বর্তমানে যেসব চাল সরবরাহ রয়েছে, তা বোরো মৌসুমের। বোরোর শেষ পর্যায় ও আমনও উঠতে শুরু করেছে। ইতোমধ্যে বাজারে নতুন চাল আসছে। তারপরও দাম বাড়ছে হুজুগে। আগামী বছর সংকট হতে পারে সেই খবরে মানুষ প্রয়োজনের অতিরিক্ত চাল কিনছে। আমনে উৎপাদন খরচ বেড়েছে। ফলে ধানের দাম বেশি। এছাড়া কর্পোরেট কোম্পানিগুলো বাজার থেকে চাল কিনে নিচ্ছে এবং সরকারও এ বছর ধান ও চালের দাম বেশি নির্ধারণ করে দিয়েছে। যা মানা হচ্ছে না কোথাও। কৃষকদের কাছ থেকে কম দামে ধান কিনে মজুদ করছেন মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। তারা পরে বেশি দামে মিলমালিকদের কাছে বিক্রি করছেন। এজন্য মৌসুমি ব্যবসায়ী কমানো, কর্পোরেট কোম্পানিগুলোর সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ধান কেনা, সংকটের খবর নিয়ে সবাইকে আরও সচেতন করতে প্রচার বাড়ানো এবং সরকারের মনিটরিং বাড়ানোর পরামর্শ ব্যবসায়ীদের।

বাবুবাজার চালের আড়তে চাল কিনতে এসেছেন কামরুল হাসান। তিনি বলেন, সীমিত আয়ের মানুষ ভাই, ৫ জনের সংসার। জিনিসপত্রের দাম যেভাবে বাড়ছে তাতে সংসার চালানো অনেক কষ্ট। সামনে সংকট হবে শোনা যাচ্ছে, তাই দাম আরও বাড়ার আগেই তিন বস্তা কিনেছি। এতে আমার চার-পাঁচ মাস চলে যাবে। কী করবো, কোনো উপায় নেই! দাম বেড়ে গেলে তো সরকার আর ফ্রিতে চাল দেবে না বা আমার বেতন বাড়িয়ে দেবে না।

একটি বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি করেন ইমন সারোয়ার। বাংলানিউজকে তিনি বলেন, চালের দাম দিন দিন বাড়ছে। দেখার কেউ নাই। আমরা যারা সীমিত আয়ের মানুষ তাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। সরকার শুধু বলে সংকট নেই। আবার চাল আমদানির অনুমোদনও দেয়। আসলে মূল বিষয়টা সবাইকে পরিষ্কার করতে হবে। অসাধু ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণ করলে চালের বাজারও কিছুটা নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। একই সঙ্গে সরকারকে আরও নজরদারি বাড়াতে হবে।

পুরান ঢাকার বাবুবাজারের পাইকারি চাল ব্যবসায়ী মেসার্স রশিদ রাইস এজেন্সির স্বত্বাধিকারী আবদুর রশিদ বাংলানিউজকে জানান, বাজারে চালের কোনো সংকট নেই। বিক্রিও অনেক বেড়েছে। এরপরও সব ধরনের চালের দাম পাইকারিতে কেজিপ্রতি দুই থেকে তিন টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। মোকামে দাম বাড়ায় তারাও বাধ্য হয়ে বাড়তি দামে বিক্রি করছেন।

তিনি বলেন, বাজারে নতুন চাল আমন আসতে শুরু করেছে। কিন্তু দাম বেশি। কারণ এ বছর আমন ধানের দাম বেশি। সরকার এ বছর ধানের দাম বাড়িয়েছে ফলে সাধারণ কৃষক তো বেশি দামে ধান বিক্রি করছে। যদিও তাদেরও উৎপাদন খরচ বেড়েছে। এছাড়া বড় বড় কর্পোরেট কোম্পানিগুলো বেশি চাল কিনে নিচ্ছে। তারপর তারা আরও বেশি দামে প্যাকেটজাত করে বাজারে ছাড়ে। একই সঙ্গে সরকারের পক্ষ থেকে আগামী বছর সংকট হতে পারে বলে সতর্ক করা হয়েছে। ফলে মানুষ হুজুগে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে, হঠাৎ চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় দাম বেড়েছে। এজন্য কর্পোরেট কোম্পানিগুলোকে সরাসরি কৃষকদের থেকে ধান নিতে হবে, সরকারের মনিটরিং বাড়াতে হবে।

বাবুবাজারের হাজী রাইস এজেন্সির মালিক জিয়াউল হক বাংলানিউজকে বলেন, গত সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রিপরিষদ বৈঠকে আগামী বছর সংকট হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করে সবাইকে সতর্ক হতে বলেছেন। এরপর থেকেই হঠাৎ করে সাধারণ মানুষের মধ্যে চাল কেনার প্রবণতা বেড়ে গেছে। হঠাৎ চাহিদা বাড়ায় দাম একটু বেড়েছে। মোটা ও চিকন সব ধরনের চালের দাম ৫০ কেজির বস্তায় ১০০ থেকে ১৫০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। তবে মোটা চালের দাম একটু বেশি বেড়েছে।

তিনি বলেন, বর্তমানে চালের ব্যবসা করে কোনো লাভ নেই! এজন্য ৩০০ চালের ঘর থেকে এখন মাত্র ১১৫টা ঘর রয়েছে। কুষ্টিয়ার মিলগেট থেকে এক ট্রাকে ২৬০ বস্তা চাল আনতে খরচ পড়ে ১৭ হাজার টাকা। এরসাথে লেবার খরচসহ অন্যান্য খরচ মিলিয়ে প্রতি বস্তায় খরচ হয় ৭৫ টাকা। এখন আমরা ৩৪০০ টাকায় চালের বস্তা কিনে এর সঙ্গে ৭৫ টাকা যোগ করে বিক্রি করছি হচ্ছে ৩৫০০ টাকা। তাহলে বস্তায় লাভ হচ্ছে ২৫ টাকা। আর কেজিতে হচ্ছে ৫০ পয়সা। এত কম লাভে বিক্রি করার পরও শুনতে হয় পাইকারি ব্যবসায়ীরা দাম বাড়িয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে ব্যবসা বন্ধ করে দিতে হবে।

বাদামতলি ঘাটের চাল বিক্রেতা ও শিল্পী রাইস এজেন্সির মালিক মো. কাউসার বলেন, আমদানির অনুমোদন দিলেও ডলার-সংকটে আমদানি হচ্ছে না। দেশের কিছু জেলায় আগাম জাতীয় আমন ধান কাটা শুরু হয়েছে। আমন ধানের দাম বেশি ফলে চালেরও দাম বেশি। আগামী বছর বিশ্বে এবং দেশে খাদ্যসংকটের আশঙ্কা থেকে অনেকেই বেশি পরিমাণে চাল কিনে রাখছেন বলে জানা গেছে। মানুষের মধ্যে যে ভয় কাজ করছে, সেটা দূর করতে প্রচার বাড়াতে হবে, নতুন ধান যখন ওঠে তখন কিছু মৌসুমি ব্যবসায়ী বা অসাধু ব্যবসায়ী দেখা যায়, তাদের কমাতে হবে এবং সরকারের আরও নজরদারি বাড়াতে হবে। তাহলে বাজার কিছুটা নিয়ন্ত্রণে থাকবে।

দেশের উত্তরাঞ্চলের মোকামমালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেশে চালের কোনো সংকট বা ঘাটতি নেই। বাজারে বর্তমানে বিক্রি হওয়া চাল প্রায় ছয়-সাত মাস আগের। মজুদও প্রায় শেষ পর্যায়ে। তবে আমন চালও বাজারে চলে আসছে। সরবরাহ আরও বাড়লেও দাম খুব একটা কমবে বলে মনে করছেন না মোকামমালিকেরা।

নওগাঁ জেলা ধান-চাল আড়তদার সমিতির সভাপতি নিরদ বরণ সাহা বলেন, আগামী বোরো মৌসুমে উৎপাদন ভালো হলে দেশে ধান-চালের সংকট হবে না। বর্তমানে আমন ধানের দাম বেশি। উৎপাদন খরচও বেড়েছে, সব মিলিয়ে দাম বেশি।

রায়সাহেব বাজারের খুচরা চাল বিক্রেতা রাজু আহমেদ বলেন, চালের দাম গত ৮ থেকে ১০ দিনের ব্যবধানে পাইকারি বাজারে চালের দাম কেজিতে ২ থেকে ৩ টাকা বেড়েছে। ফলে আমরাও চালের দাম বাড়িয়েছি। আমরা পাইকারি বাজার থেকে ৪/৫ টাকা বেশি নিচ্ছি। এর সাথে লেবার ও পরিবহন খরচ ধরে আমরা দাম নির্ধারণ করি। তবে এবার চিকন চালের থেকে মোটা চালের দাম বেশি বেড়েছে। ফলে মানভেদে খুচরায় চিকন চাল ২ থেকে ৩ টাকা এবং মোটা চাল ৪ থেকে ৫ টাকা বেড়েছে।

সুত্রাপুর বাজারের আদনান রাইস এজেন্সির ম্যানেজার বাংলানিউজকে বলেন, সরকার ধান ও চালের দাম বাড়িয়েছে। এখন আমনের মৌসুম। ধানের দাম অনেক বেশি। আবার আমদানিও হচ্ছে কম। এলসি খোলার পরও ব্যবসায়ীরা ডলারের সংকট ও দাম বেশির জন্য আমদানি করছে না। একই সাথে আগামী বছর সংকট হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, এমন ঘোষণার পর মানুষ অতিরিক্ত চাল কিনছে। ফলে দাম একটু বেড়েছে।

এ বিষয়ে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেছেন, চালের সংকট নেই। দেশেও আমন কাটার মৌসুম শুরু হয়েছে। নতুন ধান উঠছে, বাজারে নতুন চাল আসছে। তবে চালের সংকট না থাকলেও অসৎ ব্যবসায়ীর সংকট নেই। নাই নাই শব্দের কারণে দাম বাড়ছে। অনেকেই চাহিদার চেয়ে বেশি চাল কিনছে।

দুর্ভিক্ষ আসছে—এই আতঙ্কে ৩-৪ গুণ খাদ্য কিনে মজুদ না করার অনুরোধ জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলছি—বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ আসবে না, আসবে না, আসবে না। দেশে ধান-চালের কোনো সংকট হবে না।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, দেশে সারা বছরে মোট চালের চাহিদা ৩ কোটি ৬০ লাখ টন। ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে চাল উৎপাদন হয় ৩ কোটি ৭৬ লাখ টন। আর ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশে মোট চাল আমদানি হয় ১০ লাখ ৬৭ হাজার টন।

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ৮ নভেম্বর পর্যন্ত সরকারি গুদামে চাল মজুদ রয়েছে ১৩ লাখ ৬৫ হাজার ৬৮৮ টন এবং ধান ১১ হাজার ৬৩২ টন।

রাষ্ট্রায়ত্ত বিপণন সংস্থা কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে মোটা চালের দাম বেড়েছে কেজিতে ৩ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ, মাঝারি মানের ৫ দশমিক ২৬ শতাংশ এবং সরু চালে দশমিক ৬৯ শতাংশ।

বাংলাদেশ সময়: ১৭০৮ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৯, ২০২২
জিসিজি/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।