ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিক্ষা

দীপু মনির ‘কাছের লোক’ অধ্যক্ষ রতন কুমারের যত কাণ্ড

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১২২ ঘণ্টা, আগস্ট ১৪, ২০২৪
দীপু মনির ‘কাছের লোক’ অধ্যক্ষ রতন কুমারের যত কাণ্ড ডা. দীপু মনির সঙ্গে রতন কুমার মজুমদার

চাঁদপুর: প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশ ছাড়ার পর আওয়ামী লীগের আর সব নেতা-কর্মীদের মতো আত্মগোপনে রয়েছেন চাঁদপুর শহরের পুরাণবাজার ডিগ্রি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ রতন কুমার মজুমদার।

সমাজকল্যাণমন্ত্রী ডা. দীপু মনির ছত্রছায়ায় থেকে নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ড করে ও সবশেষে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন এই অধ্যক্ষ।

 

যে কারণে জনতার রোষানল থেকে রক্ষা পেতে গা-ঢাকা দিয়েছেন তিনি। গত ৫ আগস্টে হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে তার খোঁজ মিলছে না। পালিয়ে গেলেও জনরোষ থেকে রক্ষা পায়নি চাঁদপুর শহরের আদালত পাড়ার তার বাড়িটি। সেখানে ভাঙচুর চালিয়েছে বিক্ষুব্ধ জনতা।

পেশায় শিক্ষক হলেও অধ্যক্ষ রতনের কর্মকাণ্ড ছিল উসকানিমূলক। ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও শিক্ষার বিষয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে উত্তেজনা তৈরি করতে ফেসবুকে পোস্ট দিতেন সব সময়।  

এমন উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও সাম্প্রদায়িক লেখালেখির জন্য মুচলেকাও দিতে হয়েছে তাকে। সবাই তাকে সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির অত্যন্ত কাছের লোক হিসেবে জানতেন। আর এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে শিক্ষকদের সবচাইতে বেশি হয়রানি করেছেন এই অধ্যক্ষ রতন কুমার।

বিগত ১৬ বছর দীপু মনি চাঁদপুরের সংসদ সদস্য, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী ও সর্বশেষ সমাজকল্যাণমন্ত্রী থাকাকালীন রতন কুমার নানা কৌশলে মন্ত্রীর আস্থাভাজন হন, দীপু মনির কাছের মানুষ হিসেবে পরিচিতি পান। এরপর থেকে হয়ে ওঠেন দীপু মনির উপদেষ্টা। দীপু মনি শিক্ষামন্ত্রী হওয়ার পর রতন কুমারের দৌরাত্ম্য চরম সীমা অতিক্রম করে।

চাঁদপুর পুরাণবাজার ডিগ্রি কলেজের দীর্ঘ মেয়াদে অধ্যক্ষ রতন কুমার মজুমদার। তার হয়রানির শিকার হয়েছেন স্থানীয় বহু শিক্ষক। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত কিছু না হয়েও অঘোষিতভাবে রতন কুমার মজুমদার সব বদলি, নিয়োগসহ মন্ত্রণালয়ের নানা কার্যক্রম পরিচালনা করতেন।  

ডা. দীপু মনি যখন শিক্ষামন্ত্রী তখন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধিকাংশ বিসিএস কর্মকর্তা এমনকি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান হতে শুরু করে অনেক কর্মকর্তা নিজেদের পদোন্নতি, সুবিধাজনক স্থানে বদলিসহ নানা কাজের তদবির তারা চাঁদপুর এসে রতনের দ্বারস্থ হতেন।

আর এসব অনৈতিক কাজের মাধ্যমে রতন কামিয়েছেন বিশাল অঙ্কের টাকা-এমনটি ভুক্তভোগী শিক্ষকদের কাছে শুনেছেন বলে জানালেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিটি বিভাগের অধ্যাপক ড. এম মেসবাহউদ্দিন সরকার।

তিনি আরও জানান, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপ মনির সময়ে রতন কুমার মজুমদার পুরো শিক্ষা বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ করতেন। রতন মজুমদারের ভয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধিকাংশ কর্মকর্তা তটস্থ থাকতেন।

তৃতীয় মেয়াদে আওয়ামী লীগের শাসনামলে ডা. দীপু মনি শিক্ষামন্ত্রী হওয়ার দুই মাসের মাথায় খোদ চাঁদপুরে হাসান আলী ও মাতৃপীঠ সরকারি হাইস্কুলের দশজন অভিজ্ঞ শিক্ষককে দেশের নানা দুর্গম এলাকায় তাৎক্ষণিক বদলি করেন। কোনো প্রকার অভিযোগ না থাকলেও জামায়াত-বিএনপি তকমা লাগিয়ে এদের স্ট্যান্ড রিলিজ করানো হয় তখন।

যার পেছনে কলকাঠি নাড়েন এই রতন কুমার মজুমদার - এমনটি জানালেন চাঁদপুর মাতৃপীঠ সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে খাগড়াছড়িতে স্ট্যান্ড রিলিজ হওয়া ইংরেজি শিক্ষক মো. মাসুদুর রহমান।

তিনি বলেন, ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বর্তমান কারিকুলামের বিরোধিতা করে বক্তব্য রাখায় আমাকে খাগড়াছড়ির দিঘীনালায় তাৎক্ষণিক বদলি করা হয়। যার ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা রাখেন এই রতন কুমার মজুমদার।

শুধু শিক্ষার ক্ষেত্রেই নয়, নানা ধর্মীয় উসকানিমূলক লেখা ফেসবুকে পোস্ট করতেন রতন। দেশের বড় বড় পদের লোকদের সঙ্গে তার সখ্য আছে এমন কথা জানান দিতেন সামাজিকযোগযোগ মাধ্যমে।  

তবে ২০২০ সালে হেফাজত ইসলাম নেতা বাবু নগরীকে নিয়ে ফেসবুকে আপত্তিকর স্ট্যাটাস দেওয়ার পর তার বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেন ওই দলের নেতাকর্মীরা। এক পর্যায়ে শহরের শপথ চত্বরে তার বিরুদ্ধে কর্মসূচি ঘোষণার হুমকি দেন নেতারা।

এমন পরিস্থিতিতে তার ওই পোস্ট ডিলিট দিতে এবং প্রকাশ্যে হেফাজত নেতাদের কাছে ক্ষমা চাওয়ার জন্য মধ্যস্থতার দায়িত্ব নেন দীপু মনির বড় ভাই ডা. জে আর ওয়াদুদ টিপু। পরে সদরের রাজরাজেশ্বর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও চেয়ারম্যান হজরত আলী ব্যাপারীর উদ্যোগে হেফজাত নেতাদের সঙ্গে নিয়ে দীপু মনির কদমতলাস্থ বাসায় বৈঠক হয়। সেখানে রতন কুমার মজুমদার মুচলেকা দেন এবং আর এই ধরনের উসকানিমূলক কথা লিখবেন বলে অঙ্গীকার করেন।

রতন কুমার মজুমদার এ মুচলেকা দিয়ে রেহাই পান

চলতি বছরের ২৬ জানুয়ারি ট্রান্সজেন্ডার বিষয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ইসলাম নিয়ে কটূক্তি করেন অধ্যক্ষ রতন মজুমদার। এর প্রতিবাদে তাকে প্রত্যাহারের দাবিতে মানববন্ধন করে পুরাণ বাজার কলেজের সাধারণ শিক্ষার্থীরা।

সর্বশেষ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালীন সময় গত ৩ আগস্ট রতন কুমার মজুমদার দীপু মনির হয়ে পেশাজীবী সংগঠনের ব্যানারে শহরের হাসান আলী সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় মাঠ সংলগ্ন মুক্তিযোদ্ধা সড়কে মানববন্ধন কর্মসূচির নেতৃত্ব দেন। সেখানে তার সাথে দীপু মনির সুবিধাভোগী অন্য পেশার লোকদেরকেও জড়ো করেন।  

এই কর্মসূচিও তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। কারণ ওই মানববন্ধনের ছবি ও ফুটেজ ধারণ করেন শিক্ষার্থীরা। পেশাজীবীদের সংগঠনের মানববন্ধনে উপস্থিত থাকায় শিক্ষার্থীদের তোপে মুখে চাঁদপুর প্রেসক্লাবও।

এদিকে রতন কুমার মজুমদার আত্মগোপনে যাওয়ার পর ৭ আগস্ট থেকে সেই কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন মো. শোয়ায়েব। তিনি ওই কলেজের ভূগোল বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ছিলেন।

বাংলাদেশ সময়: ২১০০ ঘণ্টা, আগস্ট ১৪, ২০২৪
এসএএইচ 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।