ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৪ ভাদ্র ১৪৩১, ২৯ আগস্ট ২০২৪, ২৩ সফর ১৪৪৬

শিক্ষা

‘কেমন শিক্ষাব্যবস্থা চাই’ আলোচনা অনুষ্ঠিত

বুনিয়াদি শিক্ষায় সর্বাধিক গুরুত্বসহ ১৭ সুপারিশ

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯২০ ঘণ্টা, আগস্ট ২৮, ২০২৪
বুনিয়াদি শিক্ষায় সর্বাধিক গুরুত্বসহ ১৭ সুপারিশ

ঢাকা: বঞ্চিত শিশুদের মানসম্মত মানবিক শিক্ষার বিদ্যালয় আমাদের পাঠশালার উদ্যোগে ‘কেমন শিক্ষাব্যবস্থা চাই’ শিরোনামে এক আলোচনা ও মতবিনিময় অনুষ্ঠিত হয়েছে।

বুধবার (২৮ আগস্ট) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রমেশচন্দ্র মজুমদার মিলনায়তনে এই আলোচনা ও মতবিনিময়ে অংশ নেন ছাত্র-শিক্ষক, শিক্ষাবিদ, লেখক, গবেষক, শিল্পী ও ছাত্রনেতারা।

আমাদের পাঠশালার পরিচালক আবুল হাসান রুবেলের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মতবিনিময়ে বক্তব্য রাখেন অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান; লেখক ও শিক্ষক সফিক ইসলাম; শিক্ষক গবেষক সামিনা লুৎফা; লেখক, গবেষক ও শিল্পী অরূপ রাহী; সংগঠক ও শিল্পী অমল আকাশ; শিক্ষক ও শিল্পী বিথী ঘোষ; ছাত্রনেতা মশিউর রহমান রিচার্ড; রাগীব নাঈম প্রমুখ।

আলোচনা সভায় বক্তারা বলেন, শিক্ষা বিষয়ে তড়িঘড়ি করে কোনো সিদ্ধান্ত না নিয়ে বরং একটা শিক্ষা কমিশন গঠন করার মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমে এগোনো দরকার। যেসব বিষয়ে সংস্কার জরুরি হয়ে পড়েছে যেমন পাঠ্যপুস্তক থেকে ফ্যাসিবাদী এক ব্যক্তি কেন্দ্রিক ইতিহাসের বয়ান বাতিল করা, শিক্ষকদের আলাদা বেতন স্কেল চালু, শিক্ষকসহ শিক্ষা সম্পর্কিত মানুষদের নিয়ে শিক্ষা ব্যবস্থা পরিচালনার উদ্যোগ গ্রহণ, শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নের ক্ষেত্রে বহুমাত্রিক ব্যবস্থা চালু ইত্যাদি বিষয়ে প্রাথমিকভাবে কাজে হাত দেওয়া যেতে পারে।



আলোচনা সভার শুরুতে আমাদের পাঠশালার পক্ষ থেকে নিম্নোক্ত প্রস্তাব উত্থাপিত হয়:
১. শিক্ষা খাতে বরাদ্দ পর্যায়ক্রমে বাড়িয়ে জিডিপির ছয় ভাগে নিয়ে আসতে হবে। বুনিয়াদি শিক্ষায় সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে সকল শিশুকে শিক্ষার আওতায় নিয়ে আসার ব্যবস্থা করতে হবে। সকলের জন্য গণিত, ভাষা, ইতিহাস, বিজ্ঞানের একটি সাধারণ পাঠ্যক্রম থাকবে, যা সব ধরনের প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রযোজ্য হবে। এক্ষেত্রে বিদ্যমান সকল প্রতিষ্ঠানকে একটা পরিকল্পনার অধীনে কার্যকরভাবে ব্যবহার করার জন্য প্রাথমিক গণশিক্ষা ও মাধ্যমিক শিক্ষাকে পরিচালনার উপযোগী করে থানা শিক্ষা অফিস থেকে শুরু করে জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত এর সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে ও আমলাতান্ত্রিকতা থেকে মুক্ত করতে হবে।

২. বাংলাদেশের প্রতিটি শিশুর জন্য মাতৃভাষায় শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। এই লক্ষ্যে একটি জাতীয় অনুবাদ সংস্থা গঠন করতে হবে, যা দেশ-বিদেশের নানা ধরনের পাঠ্যপুস্তককে ও ধ্রুপদী সাহিত্যকে দেশীয় ভাষায় রূপান্তর করবে। এই অনুবাদের কাজকে ত্বরান্বিত করার জন্য বই অনুবাদকে গবেষণা প্রবন্ধ ছাপার সমতুল্য কাজ হিসেবে ভবিষ্যৎ পদোন্নতির ক্ষেত্রে বিবেচনা করতে হবে।

৩. বাংলাদেশের শিক্ষা ক্ষেত্রে একটা বড় সমস্যা উপযুক্ত ও মেধাবী শিক্ষকের অভাব। এক্ষেত্রে শিক্ষকদের বেতন কাঠামো ও সুবিধাদির অনুপস্থিতি এবং তাদের ভবিষ্যৎ পেশাগত উন্নতির পথ রুদ্ধ করা একটা বড় বাধা আকারে কাজ করে। কাজেই শিক্ষকদের জন্য একটা পৃথক বেতন স্কেল ও তাদের সমাজ রাষ্ট্রে অধিকতর দায়িত্ব গ্রহণের পথ সুগম করতে হবে।

৪. শিক্ষাক্ষেত্রের পরিচালনার দায় দায়িত্ব নেওয়ার জন্য প্রশাসন কিংবা অন্যান্য ক্যাডার থেকে কাউকে নিয়োগ না করে বরং শিক্ষকদের মধ্য থেকেই যাতে শিক্ষাব্যবস্থা পরিচালনার উপযুক্ত ব্যক্তিরা তৈরি হতে পারেন, তার ব্যবস্থা করতে হবে। এই লক্ষ্যে একটি শিক্ষণ বিষয়ক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হতে পারে একটা অগ্রাধিকার, যেখানে সমস্ত পর্যায়ের শিক্ষকরা মেধার ভিত্তিতে সুযোগ পাবেন। তাদের মর্যাদা হবে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের অনুরূপ এবং তাদের ভেতর থেকে শিক্ষাব্যবস্থা পরিচালনার প্রয়োজনীয় লোকবল সৃষ্টি করতে হবে।

৫. পাঠ্যপুস্তক সংস্কার। পাঠ্যপুস্তকে যেসব ঔপনিবেশিক, ফ্যাসিবাদের মতাদর্শ উৎপাদনকারী এবং ধর্ম, জাতি ও লিঙ্গ বৈষম্য উৎপাদনকারী উপাদান আছে, তা বাদ দিয়ে জনগণের সক্রিয়তা ও ভূমিকাকে মুখ্য উপাদান করে দলমত নির্বিশেষে সকলের ঐতিহাসিক ভূমিকার স্বীকৃতি দিতে হবে। পাঠ্যপুস্তককে এমনভাবে ঢেলে সাজানো দরকার যাতে করে শিক্ষার্থীদের ভেতর চিন্তার সক্রিয়তা ও সৃজনশীলতা বিকশিত হতে পারে। বিজ্ঞান ও গণিত বইয়ের আবশ্যিক সংস্কার এক্ষেত্রে জরুরি।

৬. বিগত সরকারের সর্বশেষ পাঠ্যক্রমে যেভাবে বিজ্ঞান শিক্ষার গুরুত্ব কমিয়ে দেওয়া হয়েছে তার বদল দরকার। পক্ষান্তরে জীবন জীবিকা ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা সহ যেসব বিষয়ে প্রয়োজনের চাইতে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে সেগুলোকে কমিয়ে প্রয়োজন অনুপাতিক করা।

৭. শিক্ষাকে মনন ও সৃজনশীলতা বিকাশের উপযোগী করার ক্ষেত্রে শিক্ষাক্ষেত্রে শিক্ষক গবেষকের পাশাপাশি সৃজনশীল ব্যক্তিদের (লেখক, কবি, শিল্পী) প্রয়োজনের থানা ভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া।

৮. প্রতিটি বিদ্যালয়ে সক্রিয় লাইব্রেরি থাকতে হবে, প্রয়োজনীয় উপকরণ ও যন্ত্রপাতি সহ ল্যাবরেটরি, খেলার মাঠ, নিয়মিত সাংস্কৃতিক কার্যক্রম, বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের উপযোগী কার্যক্রম চালু করতে হবে। শিক্ষার্থীদের ভেতরে প্রতিযোগিতার চাইতে সহযোগিতার মনোভাব বৃদ্ধির উপযোগী ব্যবস্থা গ্রহণ।

৯. ছাত্র শিক্ষক সম্পর্ককে হতে হবে পারস্পরিক শ্রদ্ধা সম্মান ও ভালোবাসার। এর ভেতর দিয়ে একটা মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে শিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। শিক্ষার্থীদের কোন নিষ্ক্রিয় গ্রহণকারী হিসেবে বিবেচনা না করে বরং পাঠ প্রক্রিয়ায় তার সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষার্থীকে প্রশ্ন করতে উৎসাহিত করতে হবে এবং তাৎক্ষণিক জবাব এর চাইতে অনুসন্ধানের প্রক্রিয়ায় তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।

১০. কর্মমুখী শিক্ষায় বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে এবং দেশব্যাপী নানা ধরনের কর্মমুখী শিক্ষার প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে সেখানে সত্যিকার অর্থে কর্মের মাধ্যমে শিক্ষার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এই শিক্ষা শেষে দেশে ও বিদেশে তারা যাতে উপযুক্ত কাজে নিয়োজিত হতে পারে সেজন্য রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ থাকতে হবে।

১১. শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নের ক্ষেত্রে শ্রেণিকক্ষ মূল্যায়ন ও বার্ষিক মূল্যায়নের সমন্বয় করতে হবে। শ্রেণিকক্ষ মূল্যায়ন সার্বিক ও কার্যকর করতে প্রয়োজনে শিক্ষক সহায়ক নিয়োগের বিষয়ে বিবেচনা করতে হবে। শিক্ষার স্তর শেষে একটি সম্মিলিত মূল্যায়ন জাতীয় ভিত্তিতে করার ব্যবস্থা করতে হবে।

১২. বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে করতে হবে নিবিড় জ্ঞান অনুশীলন ও গবেষণার ক্ষেত্র। জাতীয় অর্থনীতির বিকাশের উপযোগী, যে কোনো সংকট কিংবা দুর্যোগ মোকাবেলার উপযোগী গবেষণায় রাষ্ট্র ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে পারস্পরিক আদান-প্রদানের সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার মান ও গবেষণায় বরাদ্দ বৃদ্ধিতে জোর দিতে হবে।

১৩. বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র শিক্ষক কর্মচারী সমন্বয়ে বিদ্যালয় পরিচালনার জন্য গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান তৈরি করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার যে ধারা তার বদল ঘটাতে হবে। ছাত্রদের শিক্ষা আবাসন কিংবা শিক্ষকদের নিয়োগ, পদোন্নতি ইত্যাদি ক্ষেত্রে মেধা ও যোগ্যতাই যাতে একমাত্র মাপকাঠি হয়, কারো রাজনৈতিক পক্ষপাত যাতে করে বিবেচনার বিষয় না হতে পারে সেজন্য প্রয়োজনীয় কাঠামো ও সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে।

১৫. শিক্ষা খাতের সাথে তথ্যপ্রযুক্তি খাতকে একীভূত করার চলবে না। এবং এই দুই খাতের বাজেট আলাদাভাবে প্রণয়ন করতে হবে।

১৬. শিক্ষা খাতের পুনর্গঠনে একটি কমিশন গঠন করতে হবে এবং সেখানে যোগ্য, দক্ষ, অভিজ্ঞ শিক্ষক, চিন্তক ও এ বিষয়ে সক্রিয় নাগরিকদের যুক্ত করতে হবে। এই পুনর্গঠনের জন্য সময় প্রয়োজন এবং তার সাথে সম্পর্কিতভাবে সমস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষকদের প্রস্তুত করতে হবে। তড়িঘড়ি করে কোনো কিছু শিক্ষার্থীদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া যাবে না। বিদ্যমান শিক্ষাক্রমে যেসব পরিবর্তন প্রত্যাবশ্যক সেগুলিকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সংস্কার করে শিক্ষা কার্যক্রমের গতি সচল রাখতে হবে।

১৭. শিক্ষকদের উচ্চতর শিক্ষা ও শিক্ষক প্রশিক্ষণে বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে, প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও প্রশিক্ষণের সময়কাল প্রয়োজন অনুযায়ী বাড়াতে হবে। উচ্চতর শিক্ষায় শিক্ষকদের অগ্রাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং প্রশিক্ষিত শিক্ষকদের জন্য সঠিকভাবে কাজে লাগাতে হবে।

বাংলাদেশ সময়: ১৯১৫ ঘণ্টা, আগস্ট ২৮, ২০২৪
এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।