ঢাকা: শিক্ষার্থীদের সুযোগ হলো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে লেখা পাঠ পড়ার। স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানের ওই পাঠ পড়ে পরীক্ষাতেও উত্তর করতে হবে শিক্ষার্থীদের।
বঙ্গবন্ধু কারাগারে বসে যে আত্মজীবনী লেখার উদ্যোগ নেন, তা সংকলিত করে প্রকাশিত হয়েছে ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’। এই আত্মজীবনী’র কিছু অংশ পাঠ হিসেবে যুক্ত করা হয়েছে এবারের একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির পাঠ্যসূচিতে।
বঙ্গবন্ধুর লেখা ছাড়াও বাংলা ভাষায় রচিত সায়েন্স ফিকশন বা বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর একচ্ছত্র সম্রাট ড. জাফর ইকবালেরও একটি গদ্য পড়তে হবে শিক্ষার্থীদের।
ড. জাফর ইকবাল বঙ্গবন্ধুর ওই ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র প্রশংসা করে বলেন, সবারই এটা পড়া উচিত। ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসের এক লেখায় এ মন্তব্য ছিল তাঁর।
চলতি ২০১৪-২০১৫ শিক্ষাবর্ষে তিনটি পাঠ্যপুস্তক জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) নতুনভাবে ছাপায়। এর মধ্যে বাংলা ‘সাহিত্য পাঠ’ রয়েছে। এতে ৩০টি গদ্য ও ৩০টি পদ্যের মধ্যে অধিকাংশই নতুন।
এনসিটিবির সচিব ব্রজ গোপাল ভৌমিক স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, বাংলা প্রথমপত্র ‘সাহিত্য পাঠ’ পাঠ্যপুস্তকের সিলেবাসে ১২টি গদ্য ও ১২টি পদ্য অন্তর্ভুক্ত করা হলো।
গদ্যগুলো হলো- বিড়াল, অপরিচিতা, চাষার দুক্ষু, আহবান, আমার পথ, জীবন ও বৃক্ষ, মাসি-পিসি, বায়ান্নর দিনগুলো, জাদুঘরে কেন যাব, রেইনকোট, মহাজাগতিক কিউরেটর, নেকলেস।
আর পদ্য বা কবিতার মধ্যে রয়েছে- বিভীষণের প্রতি মেঘনাদ, ঐকতান, সাম্যবাদী, এই পৃথিবীতে এক স্থান আছে, তাহারেই পড়ে মনে, সেই অস্ত্র, আঠারো বছর বয়স, ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯, আমি কিংবদন্তির কথা বলছি, নূরুলদীনের কথা মনে পড়ে যায়, লোক-লোকান্তর, রক্তে আমার অনাদি অস্থি।
বইটির সূচিপত্রে ২০ নম্বর গদ্যটি শেখ মুজিবুর রহমানের লেখা ‘বায়ান্নর দিনগুলো’ শিরোনামে।
১৩১ নম্বর পৃষ্ঠায় লেখক-পরিচিতির অংশে বলা হয়েছে, ‘সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি ও জাতির জনক। ’
পারিবারিক পরিচয় ছাড়াও ভাষা আন্দোলনসহ বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামে অংশগ্রহণ ও কারাবরণ, ছয় দফা দাবি উত্থাপন করে বাঙালিকে ঐক্যবদ্ধ করা, তার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ১৯৭০ সালে তৎকালীন পাকিস্তানের জাতীয় ও প্রাদেশিক নির্বাচনে অংশ নিয়ে নিরঙ্কুশ জয়লাভ, অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেয়ার কথা বলা হয়েছে।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে ঐতিহাসিক ভাষণ, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’- এর কথা তুলে ধরা হয়েছে।
ওই বছরের ২৫ মার্চ রাতে কারাবরণ ও এর আগে স্বাধীনতার ঘোষণা, বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে তাকে রাষ্ট্রপতি করে গঠিত অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা, মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরে দেশ গড়ার মহান দায়িত্ব গ্রহণ, প্রথম বাঙালি হিসেবে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বাংলায় ভাষণ প্রদান, ১৯৭৩ সালে ‘জুলিও কুরি’ পদকে ভূষিত হওয়ার কথা বলা আছে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রে সামরিক বাহিনীর কতিপয় সদস্যের হাতে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হওয়ার বিষয়ও উপস্থাপন করা হয়েছে লেখক-পরিচিতিতে।
‘বায়ান্নর দিনগুলো’র পাঠ-পরিচিতিতে বলা হয়, বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী থেকে সংকলিত করা হয়েছে। বন্ধুবান্ধব, সহকর্মী ও সহধর্মিনীর অনুরোধে তিনি ১৯৬৭ সালের মাঝামাঝিতে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে রাজবন্দি থাকা অবস্থায় আত্মজীবনী লেখা শুরু করেন। পরের বছর ১৭ জানুয়ারি আগরতলা মামলায় ঢাকা সেনানিবাসে আটক থাকায় লেখা বন্ধ হয়ে যায়।
‘বায়ান্নর দিনগুলো’ রচনায় ১৯৫২ সালে বঙ্গবন্ধুর জেলজীবন ও জেল থেকে মুক্তিলাভের স্মৃতি রয়েছে। তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর অপশাসন ও বিনাবিচারে বছরের পর বছর রাজবন্দিদের কারাগারে আটক রাখার প্রতিবাদে ১৯৫২ সালে তিনি অনশন ধর্মঘট শুরু করেন।
শেখ মুজিবুর রহমানের ঢাকা কারাগার থেকে ফরিদপুর কারাগারে দেশের মানুষের অধিকার আদায়ে কারাগারে মহিউদ্দিনসহ বঙ্গবন্ধুর অনশনের বর্ণনা করা হয়েছে।
‘এদিকে জেলের ভেতরে আমরা দু’জনে প্রস্তুত হচ্ছিলাম অনশন ধর্মঘট করার জন্য। আমরা আলোচনা করে ঠিক করেছি, যাই কোক না কেন, আমরা অনশন ভাঙব না। যদি এই পথেই মৃত্যু এসে থাকে তবে তাই হবে...। ’
স্মৃতিচারণে বিশেষভাবে বর্ণিত হয়েছে ঢাকায় একুশে ফেব্রুয়ারি ছাত্রজনতার মিছিলে গুলির খবর।
‘একুশে ফেব্রুয়ারি আমরা উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা নিয়ে দিন কাটালাম, রাতে সিপাহিরা ডিউটিতে এসে খবর দিল ঢাকায় ভীষণ গোলমাল হয়েছে। কয়েকজন লোক গুলি খেয়ে মারা গেছে... রাতে যখন ঢাকার খবর পেলাম তখন ভীষণ চিন্তাযুক্ত হয়ে পড়লাম। ’
অনশন শুরুর পর বঙ্গবন্ধু অসুস্থ হয়ে পড়লে বাধ্য হয়ে মুক্তি দেয়া হয় বঙ্গবন্ধুকে। তবে সঙ্গী মহিউদ্দিনকে একদিন পর মুক্তি দেয়ায় তিনিও একদিন পর বের হন।
বঙ্গবন্ধুর অবস্থা এতটাই খারাপ ছিল যে, মুক্তির পর স্ট্রেচারে করে তাকে জেল থেকে বাইরে পাঠানো হয়।
‘পাঁচদিন পর বাড়ি পৌঁছুলাম। মাকে তো বোঝানো কষ্টকর। হাসু আমার গলা ধরে প্রথমেই বলল, আব্বা, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, রাজবন্দিদের মুক্তি চাই। একুশে ফেব্রুয়ারি ওরা ঢাকায় ছিল, যা শুনেছে তাই বলে চলেছে। ’
বইয়ের ১৯৯ পৃষ্ঠায় ড. জাফর ইকবালের ‘মহাজাগতিক কিউরেটর’ গল্পটি তার ‘সায়েন্স ফিকশন সমগ্র’ থেকে নেয়া হয়েছে। বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী হলেও এতে লেখকের জীবনদৃষ্টির প্রতিফলন ঘটেছে।
জাতীয় শিক্ষানীতির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির পাঠ্যক্রম পরিমার্জন করা হয়েছে জানিয়ে বইটির ভূমিকায় বলা হয়, শিক্ষার্থীদের নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধ থেকে শুরু করে ইতিহাস ও ঐতিহ্য চেতনা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, শিল্প-সাহিত্য-সাংস্কৃতিবোধ ইত্যাদি জাগ্রত করার চেষ্টা করা হয়েছে।
এছাড়া ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নে দক্ষ করে তোলার প্রয়াস রয়েছে।
২০১০ সাল থেকে বাংলা প্রথমপত্রে ১১টি গল্প-প্রবন্ধ, ১০টি কবিতা ছিলো।
কমলাকান্তের উইল, হৈমন্তী, বিলাসী, সাহিত্যে খেলা, একুশের গল্প, অর্ধাঙ্গী, একটি তুলসি গাছের আত্মকাহিনী, অপরাহ্নের গল্প, কলিমুদ্দি সফাদার, দুর্নীতি ও অন্তরায়, যৌবনের গান- ছিল গদ্য হিসেবে।
আর কবিতার মধ্যে ছিল- বঙ্গভাষা, সোনার তরী, জীবন বন্দনা, বাংলাদেশ, কবর, তাহারেই পড়ে মনে, পাঞ্জেরি, আমার পূর্ব বাংলা, আঠারো বছর বয়স, একটি ফটোগ্রাফ।
এনসিটিবির চেয়ারম্যান আবুল কাশেম বাংলানিউজকে বলেন, বঙ্গবন্ধুর লেখা পড়ে নতুন প্রজন্ম বাংলাদেশের সঠিক ইতিহাস জানা ছাড়াও বঙ্গবন্ধুর আদর্শ লালন করে সত্যিকারের দেশপ্রেমিক হওয়ার সুযোগ পাবে।
এছাড়া শিক্ষকদেরও বাংলাদেশের স্থপতির ইতিহাসের কিছু অংশ পড়ার সুযোগ হবে।
কোন মহল থেকে কোন ধরনের চাপে বঙ্গবন্ধুর লেখাটি সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি দাবি করে আবুল কাশেম বলেন, যারা কারিকুলামের সঙ্গে সম্পৃক্ত তারাই এটি অন্তর্ভুক্ত করেন।
এনসিটিবির বাংলা প্রথমপত্রের সারসংক্ষেপে বলা হয়েছে, ৩০টি গদ্য ও ৩০টি পদ্যের মধ্যে প্রতি ২/৩ বছর পর পর ৪টি করে পরিবর্তন ঘটবে।
বাংলাদেশ সময়: ১২৪৬ ঘণ্টা, আগস্ট ১৭, ২০১৪