ঢাকা: শিশুদের মুখস্থবিদ্যার উপর নির্ভরতা কমাতে ও চিন্তার বিকাশে সৃজনশীল শিক্ষাপদ্ধতি চালু করা হয়েছে। এর অন্যতম উদ্দেশ্যও ছিল গাইডবই নির্ভরতা কমানো।
গত মঙ্গলবার (০৪ আগস্ট) রাজধানীর নীলক্ষেত এলাকার বাবুপুরা মার্কেটে গিয়ে দেখা যায়, বইয়ের বিভিন্ন দোকানে অবাধে বিভিন্ন প্রকাশনীর নামে ছাপা নোট ও গাইডবই বিক্রি হচ্ছে।
একাধিক বিক্রেতা জানান, সরকার বিনামূল্যে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের বই বিতরণ করায় বছরের শুরু থেকেই শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা নোট-গাইডবই কিনতে আসেন। অভিভাবকদের গাইডবইয়ের প্রতি আকর্ষণ বেশি। তাছাড়া গাইড বই তারা যেহেতু প্রস্তুত করেন না সেহেতু তাদের দাবি, তারা নির্দোষ।
যদিও দেশের আইনে গাইডবই বিক্রিও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। পাঠ্যপুস্তকের নোটবই মুদ্রণ, প্রকাশনা, আমদানি, বিতরণ ও বিক্রি নিষিদ্ধকরণে ১৯৮০ সালে প্রথম শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত নোট বই নিষিদ্ধকরণ আইন প্রণীত হয়। এ আইনের ৩ ধারায় বলা আছে, ‘কোনো ব্যক্তি নোটবই মুদ্রণ, প্রকাশনা, আমদানি, বিক্রয়, বিতরণ অথবা কোনো প্রকারে উহার প্রচার করিতে বা মুদ্রণ, প্রকাশনা, বিক্রয়, বিতরণ কিংবা প্রচারের উদ্দেশ্যে রাখিতে পারিবেন না। ’ এ আইন অমান্য করলে সর্বোচ্চ সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ড অথবা ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান রাখা হয়েছে। পরে ২০১৩ সালে একটি রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে নোটবই নিষিদ্ধকরণ আইনের আওতায় নোট বইয়ের সঙ্গে গাইডবইও বাজারজাত ও বিক্রি নিষিদ্ধ করেন হাইকোর্ট।
ক্রেতার বেশে ‘মোহাম্মাদীয়া বুক হাউস’ নামের একটি বইয়ের দোকানে গিয়ে তৃতীয় শ্রেণির পাঞ্জেরী গাইড আছে কি না জানতে চাইলে দোকানি ‘একের ভেতর ১১’ নামে একটা অনুশীলনমূলক বই দেন। যেখানে মূল বইয়ের প্রশ্নোত্তরসহ অতিরিক্ত প্রশ্ন ও উত্তর দেয়া আছে। গাইডের মূল্য চান ৪০০ টাকা, দরকষাকষি করলে ৩৪০ টাকায় দিতে রাজি হন। কয়েকটি দোকান পার হয়ে ‘আপন বইঘর’ নামের আরেকটি দোকানে গিয়ে জানা যায়, একই ধরনের গাইড বইয়ের দাম আরও কম। পাঞ্জেরী প্রকাশনী দ্বিতীয় শ্রেণির গাইড বই বিক্রি করা হচ্ছে ‘একের ভিতর সব’ নামে। তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির গাইডবইয়ের নাম ‘একের ভেতর ১১’। এছাড়া ‘প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী সহায়িকা’ নামে রয়েছে পঞ্চম শ্রেণির গাইডবই।
বাজার ঘুরে দেখা গেছে, পাঞ্জেরী, লেকচার, জুপিটার, অনুপম, নিউটন, পুথি নিলয়সহ বিভিন্ন নামে নোট-গাইডবই বিক্রি হচ্ছে। বাজারে এরকম ছয়-সাতটি প্রতিষ্ঠানের নোট-গাইডবই বেশি। এসবের মধ্যে পাঞ্জেরী প্রকাশনী যুদ্ধাপরাধের দায়ে বিচারের সম্মুখীন দল জামায়াতে ইসলামীর অনুসারীর প্রতিষ্ঠান বলে প্রচার রয়েছে।
উদয়ন স্কুলের তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী জয়শ্রী দেবনাথ। তার অভিভাবকও গাইডবই কিনে দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘সবাই গাইডবই পড়ে আর শিক্ষকরাও গাইডবই থেকেই প্রশ্ন করে থাকেন। তবে গাইডবই বন্ধ হলে শিশুদের পড়াশোনা ভালো হবে। তারা নিজেরাই উত্তর করা শিখবে গাইড বই নির্ভশীল হবে না। ’
গাইডবই বিক্রিতে শীর্ষ স্থানীয় ও জামায়াতের প্রকাশনী হিসেবে পরিচিত পাঞ্জেরীর সহকারী ব্যবস্থাপক আবদুল্লাহ বাংলানিউজের কাছে দাবী করেন, তারা গাইডবই নয় অনুশীলনমূলক বই বিক্রি করে থাকেন। গাইড ও অনুশীলনমূলক বই –এই দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য জানতে চাইলে ‘পার্থক্য আছে’ বললেও নির্দিষ্ট করে কিছু বলতে পারেননি আবদুল্লাহ। এরপর ব্যস্ততার কথা বলে ফোন রেখে দেন। পরে কথা বলার জন্য ফোনকল করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট’র পরিচালক অধ্যাপক আব্দুল আউয়াল গাইডবই প্রসঙ্গে বাংলানিউজকে বলেন, ‘কোনোটার নাম সহায়ক বই, কোনোটার নাম অনুশীলনমূলক বই। শুধু নতুন মোড়কে পুরনো আবর্জনা। শিক্ষার্থীদের চিন্তাশক্তি বিকলাঙ্গ করার গাইড। ’
‘পাঠ্যবইয়ের সাথে কোনো কিছুর তুলনা হতে পারে না’ উল্লেখ করে অধ্যাপক আউয়াল বলেন, ‘গাইডবই শিশুদের মেধার পূর্ণাঙ্গ বিকাশে বাধার সৃষ্টি করে। এগুলোতে প্রশ্নের উত্তর দেয়া থাকে যা শিশুর চিন্তা করার ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। পাঠ্যবই পড়ে উত্তর করা শিখলেই কেবল শিক্ষার্থীদের মেধা বিকশিত হবে। ’
অন্যদিকে ‘গাইডবই বন্ধ হলে অভিভাবকদের ব্যয়সাশ্রয় হবে’ বলেও মত দেন এই অধ্যাপক। তবে কেউ কেউ গাইড বইয়ের পক্ষেও মত দেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিশেষত যেসব শিক্ষক বিদ্যালয়ে অনিয়মিত এবং পাঠদানে উদাসীন ও অক্ষম তারাই এসবের সমর্থক।
বাংলাদেশ সময়ঃ ০৭১৭ ঘণ্টা, আগস্ট ৯, ২০১৫
সম্পাদনা: জেএম