ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিক্ষা

এসএসসিতে সৃজনশীল গণিতের ধাক্কা স্পস্ট

ইসমাইল হোসেন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০৩৯ ঘণ্টা, মে ১২, ২০১৬
এসএসসিতে সৃজনশীল গণিতের ধাক্কা স্পস্ট ছবি: বাংলানিউজটোেয়েন্টিফোর.কম

ঢাকা: প্রথমবার সৃজনশীল পদ্ধতিতে গণিত বিষয়ের পরীক্ষা হওয়ায় সাফল্যের ধারায় হোঁচট খেয়েছে মাধ্যমিক স্তরের (এসএসসি) পরীক্ষার্থীরা। গণিতের খারাপ ফল সার্বিক ফলাফলেও নেতিবাচক প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।


 
তবে সার্বিক ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, গতবারের তুলনায় পাসের হার বেড়েছে, যদিও জিপিএ-৫ প্রাপ্তির সংখ্যাটা কমে এসেছে।
 
শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদসহ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিক্ষার্থীরা সৃজনশীল পদ্ধতি আয়ত্ব করতে পারছে। তবে প্রথমবার গণিতে সৃজনশীলের কিছুটা প্রভাব পড়েছে।
 
আর মান নিয়ে কিছুটা প্রশ্ন তুলে শিক্ষাবিদদের মত, কোচিং নির্ভরতা কমিয়ে ক্লাসের উপর জোর দিতে হবে। এজন্য মেধাবীদের শিক্ষকতা পেশায় নিতে তাদের আগ্রহটাও বিবেচনা করা উচিত।
 
বুধবার (১১ মে) প্রকাশিত ফলাফলে দেখা যায়, পরীক্ষায় গড় পাসের হার ৮৮.২৯ শতাংশ। আর মোট জিপিএ-৫ পেয়েছে ১ লাখ ৯ হাজার ৭৬১ জন। গত বছরের তুলনায় পাসের হার বাড়লেও কমেছে জিপিএ-৫ প্রাপ্তির সংখ্যা।
 
‘জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১’র আলোকে সৃজনশীল পদ্ধতিতে নেওয়া হচ্ছে পরীক্ষা। আর প্রথমবার গণিতে এই পদ্ধতির প্রয়োগ হওয়ায় তার প্রভাব পড়েছে নেতিবাচক।
 
এ প্রসঙ্গে শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির সদস্য সচিব অধ্যাপক শেখ ইকরামুল কবির বাংলানিউজকে বলেন, নতুন পদ্ধতি শিক্ষকরাও হয়তো ভালভাবে  বোঝেন না, ক্লাসে পড়ানো এবং প্রশ্ন প্রণয়নের ক্ষেত্রে সমস্যাটা তৈরি হয়েছে। প্রশিক্ষণ দিয়ে গ্যাপটা পূরণ করতে হবে।
 
সার্বিক হিসেবে ফল ভালই হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, জিপিএ-৫ কমে যাওয়াটা ভাল লক্ষণ, এদিক থেকে বলা যায় শিক্ষকদের ঢালাও নাম্বারিংয়ের প্রবণতাটা কমে গেছে। তবে মধ্যস্তরের প্রতিষ্ঠানগুলো ভাল ফল করেছে।
 
পাসের হার বাড়লেও সার্বিক ফলাফলে কিছুটা দ্বিমত প্রকাশ করেন অ্যামেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী।
 
তার মতে, পাসের হার বাড়াটা স্বাভাবিক, কারণ যোগ্যতা অর্জন করেই শিক্ষার্থীরা পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে। দেখা দরকার মান কতটা বাড়ছে। কোচিং বা গাইড বইয়ের দিকে দৌঁড়ানোটা ক্লাসরুমে ভাল মান মনে হচ্ছে না।
 
সৃজনশীল পরীক্ষার উপর কেন জোর দেওয়া হচ্ছে- প্রশ্ন রেখে এই শিক্ষাবিদ বাংলানিউজকে বলেন, ক্লাসের উপরই বেশি জোর দিতে হবে। কোচিং নির্ভরতা বন্ধ করা দরকার।
 
এক্ষেত্রে যোগ্য শিক্ষক প্রয়োজন জানিয়ে তিনি বলেন, মেধাবী এবং আগ্রহীদের শিক্ষকতায় পেশায় আনতে হবে। সে জন্য তাদের আর্থিক এবং সামাজিক মর্যাদা বাড়ানো জরুরি।
 
জাতীয় শিক্ষানীতিতে প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ৩৬ ঘণ্টা ক্লাসে শিক্ষকের উপস্থিতি থাকার কথা। এরমধ্যে ১৮ ঘণ্টা পাঠদান, ৬ ঘণ্টা ক্লাস পরিচালনা ও সংশোধন, ৬ ঘণ্টা নিজের অনুশীল এবং বাকী ৪ ঘণ্টা অন্যান্য রুটিন কাজ।
 
আর ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ পর্যন্ত ৪০ ঘণ্টার মধ্যে ২৪ ঘণ্টা পাঠদান, ৬ ঘণ্টা পরিচালনা ও সংশোধনী, ৬ ঘণ্টা অনুশীলন এবং বাকী ৪ ঘণ্টা শিক্ষক অন্যান্য কাজ করবেন।
 
শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির সদস্য সচিব অধ্যাপক শেখ ইকরামুল কবির ক্লাসের পাঠদান নিয়ে বলেন, এই নিয়ম অনুসরণ করলে শিক্ষার গুণ ও মান নিশ্চিত হবে। সে জন্য জোরালো মনিটরিং দরকার।
 
ফলাফলে দেখা যায়, প্রায় সব বোর্ডে ইংরেজির চেয়ে গণিত বিষয়ে খারাপ করেছে শিক্ষার্থীরা।
 
গণিতে ঢাকা বোর্ডে সব চেয়ে কম ৯৩.১০ শতাংশ, রাজশাহীতে ৯৭.০১ শতাংশ, কুমিল্লায় ৯২.১৯ শতাংশ, যশোরে ৯৫.৪১ শতাংশ, বরিশালে ৮৬.৯৮ শতাংশ, সিলেটে ৮৮.৩১ শতাংশ, দিনাজপুরে ৯৫.২৬ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করেছে।
 
চট্টগ্রামে সর্বনিম্ন ইংরেজিতে ৯৬.৫৮ শতাংশ পাস করলেও গণিতে ৯৬.৮১ শতাংশ, মাদ্রাসা বোর্ডে রসায়নে ৯৫.৭৩ শতাংশ ও পদার্থে ৯৭.৫৬ শতাংশের থেকে কিছুটা বেশি গণিতে পাস করেছে ৯৭.৯৯ শতাংশ। আর কারিগরি বোর্ডে গণিতে ৯১.৭৫ শতাংশ হলেও পদার্থে সর্বনিম্ন ৭৫.৭৪ শতাংশ ও রসায়নে পাসের হার ৯৫,৩৫ শতাংশ।  
 
এই তথ্যে গণিতের প্রভাবটা সার্বিক ফলাফলে স্পস্ট।
 
চলতি বছর ২৩টি বিষয়ে সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতিতে পরীক্ষা হয়েছে, যেখানে গণিত, উচ্চতর গণিত এবং শারীরিক শিক্ষা, স্বাস্থ্যবিজ্ঞান ও খেলাধুলা বিষয়ে সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতিতে নেওয়া হয়।
 
পূর্ণাঙ্গ ফল প্রকাশ উপলক্ষে শিক্ষামন্ত্রী সচিবালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে জানান, শিক্ষাবিদসহ সবার সাথে পরামর্শ করেই গণিতসহ অন্যান্য বিষয়ে সৃজনশীল পদ্ধতি চালু করা হয়েছে। সব কিছুর ক্ষেত্রেই প্রথমটা কষ্টকর।
 
তিনি বলেন, ইংরেজি ও গণিতের জন্য আলাদা করে আট হাজার স্কুলে অতিরিক্ত ক্লাস নেওয়া হচ্ছে। এযাবৎ ১১ লাখ অতিরিক্ত ক্লাস নেওয়া হয়েছে। এই প্রক্রিয়া চলতে থাকবে। ঘাটতি পূরণের যে প্রচেষ্টা নেওয়া হয়েছে তার ফলও পাচ্ছি। ফল বিশ্লেষণ করে মূল্যায়ন করে ব্যবস্থা নেব।
 
৯৫.৭০ শতাংশ পাসের হার নিয়ে এসএসসিতে দেশের সেরা রাজশাহী বোর্ড। এই বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ বলেন, শিক্ষার্থীদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা, শিক্ষক ও অভিভাবকদের নিরলস পরিশ্রম আর বোর্ডের সুনির্দিষ্ট নিদের্শনা ও নিবিড় পর্যবেক্ষণে এ সাফল্য।
 
অন্যদিকে মাদ্রাসা বোর্ডের দাখিল পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীর সাথে কমেছে পাস ও জিপিএ-৫ প্রাপ্তি। এই বোর্ডে পাসের হার ৮৮.২২ শতাংশ, জিপিএ-৫ পেয়েছে ৫ হাজার ৮৯৫ জন। গতবার পাসের হার ছিল ৯০.২০ শতাংশ, জিপিএ-৫ ছিল ছিল ১১ হাজার ৩৩৮ জন।
 
মাদ্রাসা বোর্ডে জিপিএ-৫ প্রাপ্তির সংখ্যা কমা প্রসঙ্গে বোর্ড চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কে এম ছায়েফ উল্ল্যাহ বাংলানিউজকে বলেন, ‘সমাজ বিজ্ঞান, ইসলামের ইতিহাস ও বাংলায় সৃজনশীল বিষয়ে খারাপ ফল হয়েছে। এতে সার্বিক ফলাফলে প্রভাব পড়েছে। প্রশ্ন কঠিন এবং মাঠ পর্যায়ে শিক্ষকদের কিছু সমস্যার কারণে জিপিএ-৫  কমেছে’।
 
তবে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সমাধানের চেষ্টা করা হবে বলে জানান মাদ্রাসা বোর্ড চেয়ারম্যান।
 
রাজধানীর মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ অধ্যক্ষ অধ্যক্ষ ড. শাহান আরা বেগম ফল মূল্যায়ন নিয়ে বাংলানিউজকে বলেন, ‘সামগ্রিকভাবে তাদের ভাল ফল হলেও মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগে এ প্লাসের সংখ্যা কম। প্রথমবার সৃজনশীল পদ্ধতিতে গণিত পরীক্ষার একটা প্রভাব এসেছে’।
 
নিজেদের ফলাফলে সন্তুষ্টির কথা জানিয়ে তিনি বলেন, শিক্ষক-অভিভাবক ও ছাত্র- এই সমন্বিত প্রচেষ্টার কারণেই সাফল্য।
 
সারা দেশের শিক্ষার্থীদের ভাল ফলের জন্য তিনি বেশি বেশি পাঠ্যবই পড়ার ওপর দিয়ে বলেন, পাঠ্যবই পুরোটা পড়ার বিকল্প নেই।
 
‘আইডিয়াল স্কুলে নবম শ্রেণিতেই পুরো বই পাঠ শেষ করা হয়। এজন্য দশম শ্রেণিতে আমাদের শিক্ষার্থীরা প্রচুর সময় পায়’।
 
বাংলাদেশ সময়: ০০১৫ ঘণ্টা, মে ১২, ২০১৬
এমআইএইচ/বিএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।