ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১১ পৌষ ১৪৩১, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিক্ষা

খুবির ভিসিদের মধ্যে তিনি দৃষ্টান্ত….

মাহবুবুর রহমান মুন্না, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭১৪ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৯, ২০১৭
খুবির ভিসিদের মধ্যে তিনি দৃষ্টান্ত….

খুলনা: আমি যেন কিছুই বুঝে উঠতে পারলাম না। ৭ জানুয়ারি যখন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের (খুবি) জনসংযোগ ও প্রকাশনা বিভাগের পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) এস এম আতিয়ার রহমান জানালেন, ভিসি প্রফেসর ড. মোহাম্মদ ফায়েক উজ্জামানের কার্যকালের মেয়াদ ৯ জানুয়ারি শেষ হচ্ছে।

এ উপলক্ষে ৮ জানুয়ারি ভিসির বিদায়ী সৌজন্য সাক্ষাতের জন্য আপনাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন স্যার।

খুবির ভিসির কার্যকালের চার বছরের মেয়াদ যে শেষ হয়ে গেছে তা আমার মনেই ছিলো না।

যার কারণে আমি অনেকটা হতভম্ব হয়ে পড়ি। মুহূর্তে আনমনা হয়ে যাই। এরই মাঝে শেষ হয়ে গেলো চার বছর। মনের মাঝে তার শূন্যতা অনুভব করতে থাকি। তার চেয়ারের স্থান পূরণ হয়ে যাবে। কিন্তু তার মতো কি কেউ আসবেন? তার মতো জ্ঞান-গরিমা, মনন-মেধা, প্রজ্ঞা-পাণ্ডিত্য দিয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করতে পারবেন? তবে একটি কথা না বললেই নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্মের পর থেকে ১০জন ভিসি নানা কারণে নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষ করতে পারেন নি। কিন্তু ফায়েক উজ্জামান ১১তম ভিসি হিসেবে তার দায়িত্বকাল শেষ করেছেন সুনামের সাথে।  

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে সফলভাবে কার্যকালের মেয়াদ পূর্তিতে রোববার (৮ জানুয়ারি) তাকে প্রথম সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছে। বিধি অনুযাযী সোমবার (৯ জানুয়ারি) রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ফেরার কথা মোহাম্মদ ফায়েক উজ্জামানের।

নতুন ভিসি নিয়োগ না হওয়া পর্যন্ত দৈনন্দিন রুটিন ওয়ার্ক পালনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে খুবির ট্রেজারার খান আতিয়ার রহমানকে।  

২০১২ সালে ভারপ্রাপ্ত ভিসি হিসেবে যখন ফায়েক উজ্জামান দায়িত্ব নিয়েছিলেন তখন খুবির জমির সীমা প্রাচীর নিয়ে নানা জটিলতাসহ বেশ কিছু সমস্যা বিদ্যমান ছিলো। ছিলো নানা আলোচনা-সমালোচনা। কিন্তু মাত্র দুই মাস পর ২০১৩ সালে পূর্ণাঙ্গ ভিসির দায়িত্ব পাওয়ার পর অনেকটা সমাধান হতে শুরু করে সেইসব জটিলতার। তাই তো বলতে হয়, রাতের ঘোর অন্ধকারের বিপরীতে; প্রত্যুষে সূর্য্যের আগমনের ন্যায় প্রফেসর ড. মোহাম্মদ ফায়েক উজ্জামান খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হয়ে এসেছিলেন।

উপাচার্য তার দায়িত্বকালীন নতুন ৮টি ডিসিপ্লিন ও ১টি ইনস্টিটিউট চালু, ১০০ জন শিক্ষকের পদ আনা ও নিয়োগ, ৬৫ জন কর্মকর্তার আপগ্রেডেশন, ১২ জন কর্মকতার নতুন পদে নিয়োগ ও ৮৩ জন কর্মচারী নিয়োগ দেন। এসব নিয়োগ স্বচ্ছতার সাথে সম্পূর্ণ হয়েছে, কোনো অনিয়ম দুর্নীতি প্রশ্রয় পায়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ও প্রশাসনিক সকল ক্ষেত্রের বিকাশে তিনি আন্তরিকভাবে কাজ করে বিশ্ববিদালয়কে সামনে এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেছেন। ১৮৮ কোটি টাকার যে নতুন প্রকল্প অনুমোদিত হয়েছে তার বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। আগামী ৫ বছরের মধ্যে কাজ শেষে হলে আগামী ১৫ বছরের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত স্বল্পতা থাকবে না।  

এক কথায় বলা যায় উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নের ক্ষেত্রে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় অগ্রবর্তী অবস্থানে আসার পেছনে তার অবদান সবচেয়ে বেশি। । কে কোন রাজনৈতিক মতাদর্শের তা না দেখে যোগ্যতার মাপকাঠিতে তিনি শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দিয়েছেন। তিনি যেকোনো পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারতেন। একজন আদর্শ শিক্ষক হিসেবে ছাত্রছাত্রীদের যেকোনো সমস্যার সমাধানে তিনি এগিয়ে এসেছেন। যে কারণে তার মেয়াদকালীন সময়ে কখনই তার বিরুদ্ধে কোন শ্লোগান উঠেনি শিক্ষার্থী কিংবা শিক্ষকদের মুখ থেকে।  

তিনি একজন আদর্শ শিক্ষক। মিষ্টভাষী ও সদালাপী, কথায় ও কাজে, পোশাক ও রুচিতে, পেশায় ও কর্তব্য পালনে তিনি আদর্শবান,  সত্যপ্রিয় অনুকরণীয় ও অনুসরণীয়। সর্বোপরি তিনি ছিলেন সাংবাদিক বান্ধব মানুষ। তিনি প্রযুক্তি ও অনলাইন পত্রিকাকে গুরুত্বের সাথে দেখতেন। তার সময় খুবিতে সাংবাদিকতা বিষয়ে অনার্স চালু হয়।  

প্রফেসর ড. মোহাম্মদ ফায়েক উজ্জামান ২০১০ সালের ২৮ নভেম্বর খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের   প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর হিসেবে যোগদান করেন। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের আগে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন।

প্রফেসর ড. মোহাম্মদ ফায়েক উজ্জামানের জন্ম ১৯৬৬ সালের ১ জানুয়ারি গোপালগঞ্জ জেলার মুকসুদপুর উপজেলার শ্রীনিবাসকাঠী গ্রামে। তিনি বিশিষ্ট শিক্ষানুরাগী জয়নাল আবেদীন (মরহুম) এবং বেগম রোকেয়া আবেদীনের দ্বিতীয় সন্তান। তিনি খুলনার দৌলতপুরের সরকারি ব্রজলাল (বিএল) কলেজ থেকে ইসলামের ইতিহাস ও সংষ্কৃতি বিভাগ হতে  অনার্স এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একই বিভাগ থেকে মাস্টার্স, এম ফিল ও পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৯৪ সালে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনায় যোগ দেন ও ২০০৭ সালে প্রফেসর পদ লাভ করেন। তার বেশ কিছু গবেষণা প্রবন্ধ গুরুত্বপূর্ণ জার্ণালে প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়াও তার ‘ইরান-ইরাক বিরোধ ও সাম্প্রতিক যুদ্ধ’ ও ‘মুজিব নগর সরকার ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ’ শীর্ষক বই দু’টি বাংলা একাডেমি প্রকাশ করেছে। এছাড়া তিনি ‘History Society Culture: A.B.M. Husain Festschrift’ শীর্ষক সম্মাননা গ্রন্থটি যৌথভাবে সম্পাদনা করেন। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট, শিক্ষা পরিষদ ও ফ্যাকাল্টি সদস্য, আবাসিক শিক্ষক, শিক্ষক সমিতির যুগ্ম-সম্পাদক ও কার্যকরি পরিষদ সদস্যসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা পরিষদ সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। তিনি দেশে ও বিদেশে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সেমিনারে যোগদান করেছেন। তিনি দেশের বিভিন্ন জাতীয় সংবাদপত্রে লেখালেখি করেন। প্রফেসর ড. মোহাম্মদ ফায়েক উজ্জামান এর সহধর্মিনী প্রফেসর ড. মোবররা সিদ্দিকা বর্তমানে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোকলর বিভাগের চেয়ারম্যান। তারা দু’সন্তানের জনক-জননী। তাদের মেয়ের নাম পূর্বাশা পৃথ্বী এবং ছেলের নাম প্রাজ্ঞ পাবন।  

একজন বলিষ্ঠ দেশপ্রেমিক এবং আদর্শবান শিক্ষক হিসেবে আশা করি তিনি সারা জীবন সম্মান পাবেন। বিদায় বেলায় একবুক দীর্ঘশ্বাস আর অবারিত অশ্রুবিন্দু নিয়ে প্রার্থনা করি, আপনার জন্য ভালো থাকবেন, স্যার।  

বাংলাদেশ সময়:  ১৩১৩ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৯, ২০১৬
এমআরএম/জেডএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।