ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিক্ষা

শিক্ষার শরীরে ভ্যাটের কামড়

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৩০৪ ঘণ্টা, জুন ৬, ২০১৭
শিক্ষার শরীরে ভ্যাটের কামড় শিক্ষার্থীদের ভ্যাটবিরোধী আন্দোলনের ফাইল ফটো

ঢাকা: কাগজের ওপর বাড়তি ভ্যাট আরোপের প্রস্তাব শিক্ষাখাতে সীমাহীন উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। এর ফলে তৈরি হয়েছে কাগজ, খাতা ও বইয়ের দাম বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা। অভিভাবকদের কপালে তাই ভাঁজ পড়তে শুরু করেছে এখনই। আর দেশি কাগজ শিল্প পড়েছে বিপর্যয়ের হুমকিতে।

প্রতিবছর বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি আর বিনা মূল্যে পাঠ্য বই সরবরাহের বিপরীতে আসন্ন ২০১৭-১৮ অর্থ বছরের বাজেটে এই প্রস্তাবিত ভ্যাট শিক্ষা সংশ্লিষ্টদের ভেতর নানামুখী সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। এর ফলে সরকারের সর্বস্তরে স্বল্পমূল্যে শিক্ষা উপকরণ পৌছে দেওয়ার উদ্যোগও ব্যাহত হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।



কেননা গরিব অভিভাবকরা যাতে সন্তানকে স্কুলের বদলে কাজে না পাঠান, সে জন্য উপবৃত্তিতে সরকার বিপুল অর্থ ঢালছে। গত ১ জুন ঘোষিত আগামী অর্থবছরের বাজেটেও পাঠ্য বই থেকে ভ্যাট প্রত্যাহার করা হয়েছে। ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল ছাড়া সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থাকে ভ্যাটমুক্ত ঘোষণা করা হয়েছে।

কিন্তু শিক্ষার মূল উপকরণ কাগজের ওপর সরবরাহ পর্যায়ে ১৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর (মূসক) প্রত্যাহারের বদলে উল্টো আরোপ করা হয়েছে চার গুণ ভ্যাট। কম্পিউটারের ওপর ভ্যাট না থাকলেও ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে কম্পিউটারের প্রিন্ট পেপারে।

দেশি কাগজশিল্পকে সুরক্ষা দিতে এতো দিন বাজারমূল্যের চেয়ে প্রায় অর্ধেক দরে সরবরাহ পর্যায়ে ‘ট্যারিফ মূল্য’ নির্ধারণ করে ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা ছিল। বাংলাদেশ পেপার মিলস অ্যাসোসিয়েশন বাজেট প্রস্তাবের পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে করা এক আবেদনে ওই ভ্যাট প্রত্যাহারের প্রস্তাব করেছিল। কিন্তু ভ্যাট প্রত্যাহার করার বদলে ট্যারিফ মূল্য প্রত্যাহার করা হয়েছে। এতে সরবরাহ পর্যায়েও বিভিন্ন ধরনের কাগজের ওপর দ্বিগুণ ভ্যাট আরোপ হচ্ছে।

মিল মালিকরা বলছেন, শুধু ভ্যাটই নয়, কাগজ তৈরির প্রধান উপকরণ পাল্পের দাম এখন আন্তর্জাতিক বাজারে সর্বোচ্চ পর্যায়ে। গত নভেম্বর-ডিসেম্বরে প্রতি টন পাল্পের আমদানি মূল্য ছিল ৪৬৫ থেকে ৪৭০ ডলার। এখন তা বেড়ে হয়েছে ৬৯০ থেকে ৭০০ ডলার। ফলে পাল্পের দামসহ প্রতি টন কাগজের উত্পাদন ব্যয় পড়ছে প্রায় ৬০ হাজার টাকা। বন্ড সুবিধার অপব্যবহার ও চোরাই কাগজে বেহাত বাজারে টিকে থাকতে দেশি মিলগুলো তা ৬২ হাজার থেকে ৬৩ হাজার টাকায় বিক্রি করছে।

বাংলাদেশ পেপার মিল অ্যাসোসিয়েশন কর্মকর্তারা জানান, খাতা হিসেবে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা যে কাগজ ব্যবহার করে, তার ট্যারিফ ভ্যালু টনপ্রতি ২৫ হাজার টাকা নির্ধারণ করা আছে। উত্পাদন পর্যায়ে এই ২৫ হাজার টাকার ওপরে এত দিন ৪ শতাংশ হারে এক হাজার টাকা ভ্যাট দিতে হতো। এখন ট্যারিফ ভ্যালু তুলে নিলে প্রতি টন কাগজের উত্পাদন পর্যায়ে মূল্য ধরা হবে ৬৩ হাজার টাকার মতো।   এই ৬৩ হাজারের ওপর ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট আরোপ হলে গুণতে হবে ৯ হাজার ৪৫০ টাকা। অর্থাৎ উত্পাদন পর্যায়ে প্রতি টন কাগজে বাড়তি প্রায় সাড়ে আট হাজার টাকা ভ্যাট দিতে হবে। এ ছাড়া সরবরাহ পর্যায়েও ১৫ শতাংশ ভ্যাট বহাল রাখা হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একদিকে বন্ডেড ওয়্যারহাউস সুবিধার অপব্যবহারে শুল্কমুক্ত সুবিধায় আমদানি হওয়া বিপুল পরিমাণ কাগজ প্রতিদিন দেশের বাজারে বিক্রি হচ্ছে। আবার মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে অবৈধভাবে ও পাচার হয়ে বাংলাদেশে বিপুল হারে কাগজ ঢুকছে প্রতিনিয়ত। এসব কাগজের ভিড়ে প্রায় কয়েক লাখ শ্রমিক-কর্মচারীসহ ১০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করা দেশি কাগজকলগুলো রুগ্ন হয়ে পড়ছে।
 

বাংলাদেশ পেপার মিলস অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য ও পার্ল পেপার অ্যান্ড বোর্ড মিলস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) রেজাউল ইসলাম বলেন,  ভারী শিল্প বিবেচনায় কাগজশিল্পের ওপর আরোপিত সব ধরনের ভ্যাট প্রত্যাহার করা না হলে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি করা কাগজশিল্প ধ্বংস হয়ে যাবে।

বর্তমানে দেশে ছোট-বড় মিলিয়ে ৮৭টি পেপার মিল চালু রয়েছে উল্লেখ করে রেজাউল ইসলাম বলেন, এসব শিল্পে সরাসরি শ্রমিক নিয়োজিত রয়েছে প্রায় ৩৬ হাজার। ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজসহ হিসাব করলে কাগজশিল্পের সঙ্গে জড়িত শ্রমিক-কর্মচারীর সংখ্যা কয়েক লাখ ছাড়িয়ে যাবে।


গত ১১ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে করা এক আবেদনে বাংলাদেশ পেপার মিলস অ্যাসোসিয়েশন জানায়, দেশের মিলগুলোর উত্পাদিত কাগজ থেকে তৈরি হচ্ছে এক্সারসাইজ বুক, স্পাইরাল নোটবুক ও খাতা, যা শিক্ষা-সংস্কৃতি বিকাশে অপরিসীম ভূমিকা রাখছে। সরকার দেশের মিলগুলোর সরবরাহ করা কাগজে ছাপানো বই প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও ইবতেদায়ি স্তরে বিনা মূল্যে সরবরাহ করছে। নিরক্ষতার হার কমিয়ে জাতিকে শিক্ষিত করে গড়ে তোলা বর্তমান সরকারের লক্ষ্য। এ জন্যই বাজেটের একটি বড় অংশ শিক্ষা খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে। ছাত্র-ছাত্রীরা বিনা মূল্যে বই পেলেও শিক্ষার অন্যতম উপকরণ খাতার ওপর এনবিআর ভ্যাট আরোপ করায় শিক্ষার্থীদের অধিক মূল্যে তা কিনতে হচ্ছে। ফলে সরকারের সর্বস্তরে ও স্বল্প ব্যয়ে শিক্ষা পৌঁছে দেওয়ার অঙ্গীকার অনেকটাই ম্লান হয়ে যাচ্ছে।

বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক ড. জামাল উদ্দিন আহমেদ কাগজে ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপের কড়া সমালোচনা করে বলেন, বইপত্র ছাপা ও শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার কাগজে ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা ঠিক হয়নি।

বাংলাদেশ সময়: ০৮৫৭ ঘণ্টা, জুন ০৬, ২০১৭
জেডএম/

 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।