সব বিশ্ববিদ্যালয় ঐক্যমতে পৌঁছালেও উচ্চশিক্ষার দুই শীর্ষ প্রতিষ্ঠান বুয়েট ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আলাদাভাবে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার পক্ষপাতী ছিল। যাকে ইউজিসির চেয়ারম্যান কাজী শহীদুল্লাহ ‘ইগো’ হিসেবে অ্যাখ্যা দিয়েছিলেন।
অবশেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং বুয়েটও সম্মত হয়েছে। আগামী শিক্ষাবর্ষ (২০২০-২০২১) থেকে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে একযোগে কেন্দ্রীয় ভর্তিপরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে।
বুধবার (১২ ফেব্রুয়ারি) ইউজিসি চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. কাজী শহীদুল্লাহর সভাপতিত্বে কমিশনে অনুষ্ঠিত এক সভায় সর্বসম্মতিক্রমে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, ইগো নয় বরং স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাতন্ত্র্য ধরে রাখতে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ অনুচিত।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ও বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে যেমন শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে থাকে, তেমনি শিক্ষার্থী ভর্তির ক্ষেত্রেও একই ভূমিকা থাকবে। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি প্রক্রিয়া আলাদা থাকা উচিত। কারণ সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা কীভাবে ম্যানেজ হবে, কারা ম্যানেজ করবে তারপর সেই পরীক্ষাটি আরেকটা এইএচসি পরীক্ষার মতো হবে কি না সেসব নিয়ে সন্দেহ থেকে যায়। কাজেই সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষায় ঢাবির অংশগ্রহণ না করাকে আমি স্বাভাবিক মনে করি। ’
শিক্ষার্থীরা বলছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কঠোর নিরাপত্তার মধ্যেও ঘ ইউনিটের প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে। পুনরায় পরীক্ষা নিতে হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষদভিত্তিক পরীক্ষা পদ্ধতির ভিন্নতা, প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর মানের চাহিদা এক না হওয়ায় সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা বিশ্ববিদ্যালয় ধারণার সাথে যায় না। বর্তমান ভর্তি পরীক্ষার যে ভোগান্তির কথা বলা হচ্ছে তা ইউজিসি ভূর্তুকি দিয়ে আবেদন ফি কমানো ও ভর্তি পরীক্ষার তারিখ নির্ধারণের ক্ষেত্রে অঞ্চলভিত্তিক পরপর করা গেলে তা দূরীভূত হবে। আর কোচিং বাণিজ্য মেডিকেলে সমন্বিত পরীক্ষার পরেও বন্ধ হয়নি।
ঢাবির সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিলে তা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বকীয়তা নষ্ট করবে বলে মনে করেন ডাকসুর সমাজসেবা সম্পাদক আখতার হোসেন।
তিনি বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার পক্ষে শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি লাঘব এবং অর্থের অপচয় রোধ করাকে যৌক্তিক মনে হলেও বর্তমান বাস্তবতায় এই সিদ্ধান্তের বিপক্ষে থাকছি। সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা সমন্বিত দুর্নীতির সম্ভাবনা, ইউজিসির পর্যাপ্ত লোকবল ও টেকনিক্যাল ব্যবস্থাপনার অভাব, মানহীন প্রশ্নপত্র, প্রশ্নফাঁসের সম্ভাবনা, পরীক্ষার হলে স্বচ্ছতা নিশ্চায়নের অভাব, বিষয় পরিবর্তনের ভোগান্তি, মেডিকেল ও ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিন্নতার কারণে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা চাই না। একটি পরীক্ষা কখনোই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পাওয়া বা না পাওয়ার ব্যাবধান হতে পারে না। এটা শিক্ষার্থীদের মানসিক চাপ তৈরি করবে। ’
সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষায় ঢাবির অংশগ্রহণের পক্ষে-বিপক্ষে মতামত চেয়ে স্বপ্নের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নামে একটি ফেসবুক গ্রুপে একটি পোল ইভেন্ট খোলা হয়। যেখানে দুই ঘণ্টায় ৫৮১ জন শিক্ষার্থী মতামত দেয়। এর মধ্যে ৫৮৬ জনই সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অংশগ্রহণ চায় না।
রানা আহমেদ নামে এক শিক্ষার্থী লিখেছেন, সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার বিপক্ষে আমি নই, তবে সেটা কয়েকটা ক্যাটাগরিতে ভাগ করলে ভালে হয়। ইঞ্জিনিয়ারিং, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, কৃষি ও সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে আলাদা ২/৩ টা ক্যাটাগরি (যেটা র্যাংকিং এবং অবস্থানের ওপর নির্ভর করবে) করে। এতে করে শিক্ষার্থীদের ওপর চাপ কম পড়বে।
শুভ্র আহসান নামে আরেক শিক্ষার্থী বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা কোন পাবলিক পরীক্ষা নয়। একেকটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি প্রক্রিয়া আলাদা আলাদা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লিখিত পরীক্ষা নেওয়া হয়, জাহাঙ্গীরনগরে আইকিউ নেওয়া হয়। আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বা সংগীতে ভর্তি হতে আলাদা ব্যবহারিক পরীক্ষা দিতে হয়। এমতাবস্থায় চারুকলা আর বুয়েটের ভর্তি প্রক্রিয়াকে যদি এক করে ফেলা হয় তবে পুরো শিক্ষা ব্যবস্থা ধসে পড়তে সময় লাগবে না। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা একের পর এক পরীক্ষা চালিয়ে ইতিমধ্যে স্কুল এবং কলেজের শিক্ষা ব্যবস্থাকে শেষ করে দেওয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এরইমধ্যে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপস্থিত। এমতাবস্থায় সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা হবে উচ্চ শিক্ষা ধ্বংসের কফিনে শেষ পেরেক।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান বাংলানিউজকে বলেন, ‘আমরা ইউজিসির সভায় অংশগ্রহণ করেছি। সেখানে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র অধ্যাপকদের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু স্বতন্ত্র দিক আছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা কীভাবে অনুষ্ঠিত হবে তা ঠিক করে একাডেমিক কাউন্সিল। আমরা আগামী ভর্তি পরীক্ষার বিষয়ে একাডেমিক কাউন্সিলের সভায় চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেব। ’
বাংলাদেশ সময়: ২০০৯ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১২, ২০২০
এসকেবি/এজে