(১৯৭১ সাল থেকে নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে হাঁটি হাঁটি পা পা করে ৪১ বছর পার করছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠার ৪১ বছরেও আন্তর্জাতিক মানের একটি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারেনি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি খ্যাত এ বিদ্যাপীঠটি।
এরই অংশ হিসেবে বর্তমান উপাচার্যের বিরুদ্ধে কুরুচিপূর্ণ লিফলেট বিতরণ, ব্যাঙ্গাত্মক পোস্টারিং, মোবাইল ফোনে প্রাণনাশের হুমকি ও সর্বশেষ জুবায়েরের মৃত্যু নিয়ে বিএনপি ও জামায়াতপন্থী শিক্ষকদের লাগাতার আন্দোলন চলছে। সকল ষড়যন্ত্র প্রতিহত করে শিক্ষা ও গবেষণায় আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন একটি বিশ্ববিদ্যালয় উপহার দেওয়ার কথা জানালেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. শরীফ এনামুল কবির।
তার দায়িত্ব গ্রহণের ৩ বছর পূর্তি হলো শুক্রবার। বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে খোলামেলা কথা বলেছেন তিনি। বাংলানিউজের পক্ষে উপাচার্যের সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী ইমন রহমান।
অধ্যাপক ড. শরীফ এনামুল কবিরের জন্ম ১৯৫৫ সালের ২৮ ফেব্রæয়ারি গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলার সাতাশিয়া গ্রামে। ১৯৬৯ সালে উদয়ন বিদ্যাপীঠ হাই স্কুলে এসএসসি, ১৯৭১ সালে সরকারি রাজেন্দ্র কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় তিনি প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। এরপর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯৭৩-৭৪ শিক্ষাবর্ষে রসায়ন বিভাগে ভর্তি হন। অনার্সে প্রথম শ্রেণীতে দ্বিতীয়, মাস্টার্সে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হন।
পরবর্তীতে উচ্চতর পড়াশোনা করেন ইংল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি ও সুইডেনে। ১৯৯১ সালে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন অ্যাওয়ার্ড, ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্স স্বর্ণপদক, ২০০৭ সালে বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্স-ড. এম ও গণি স্বর্ণপদক লাভ করেন।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে তিনি শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন ১৯৭৯ সালে। আর ২০০৯ সালের ২৪ ফেব্রæয়ারি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রাক্তন শিক্ষার্থী হিসেবে প্রথম উপাচার্যের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
প্রশ্ন: আপনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে গত তিন বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে বলে জনশ্রæতি রয়েছে। এতো অল্প সময়ে অধিক উন্নয়ন সম্পর্কে আপনার অভিমত কি?
ড. শরীফ এনামুল কবির: বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার সরকার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর বিশেষ নজর দেওয়ায় স্বল্প সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কিছু অবকাঠামোগত উন্নয়ন সম্ভব হয়েছে। এর মধ্যে অতি অল্প সময়ে ৬৪০ সিটের শহীদ রফিক-জব্বার হল নির্মাণ করে ছাত্রদের সিটের সংকট অনেকটাই সমাধান করা হয়েছে। ১৪ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘শেখ হাসিনা হল’ নামে আরো একটি ছাত্রী হল নির্মাণের কাজ চলছে। আরো দুটি হল নির্মাণের পরিকল্পনা চলছে।
ওয়াজেদ মিয়া বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র নামে একটি আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন গবেষণা কেন্দ্রের ভবন নির্মাণের কাজ চলছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ৪০ বছর পর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান প্রবেশদ্বার নির্মাণ করা হয়েছে।
প্রশ্ন: গত তিন বছরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা ও গবেষণা খাতে উল্লেখযোগ্য কি কি উন্নয়ন করেছেন?
ড. শরীফ এনামুল কবির: ১৯৭১ সালে এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর আমি উপাচার্যের দায়িত্ব গ্রহণের পূর্ব পর্যন্ত মাত্র ছাব্বিশটি বিভাগ ছিলো। আমি বাণিজ্য অনুষদ ও আইন অনুষদ খুলেছি। এছাড়া নতুন মোট ১০টি বিভাগ ও দুটি ইনিস্টিটিউট খুলেছি। চলতি শিক্ষাবর্ষে ২৬শ’ শিক্ষার্থীর পড়ালেখার সুযোগ করেছি, যেখানে গত বছর ১৬শ’ শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ পেয়েছিলো।
এছাড়া প্রথম বর্ষে ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতিতে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়েছে। লিখিত ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতির পরিবর্তন করে এমসিকিউ পদ্ধতিতে পরীক্ষা গ্রহণ এবং পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টার মধ্যে ফল প্রকাশের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ বিভাগ এখন সেশনজট মুক্ত। গবেষণা বিষয়ে বহুমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। গত দুই বছরে বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক শিক্ষা ও সহযোগিতা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে বিপুলসংখ্যক বিজ্ঞানী-গবেষকদের জন্য ‘ওয়াজেদ মিয়া বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র’ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের জন্য অটিস্টিক স্কুল ‘আনন্দশালা’ প্রতিষ্ঠিত করেছি। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে একমাত্র এ বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ধরনের স্কুল রয়েছে।
প্রশ্ন: বিশ্ববিদ্যালয়ে এতো উন্নয়নের পরও এখানে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে বার বার বিব্রত হয়েছে মহাজোট সরকার। এ সম্পর্কে আপনার বক্তব্য কি?
ড. শরীফ এনামুল কবির: কয়েক হাজার ছাত্র এক সঙ্গে থাকলে নিজেদের মধ্যে কিছুটা সমস্যা হতেই পারে। তাছাড়া আমি যখন উপাচার্যের দায়িত্ব গ্রহণ করি, তখন ক্যাম্পাস অস্থিতিশীল ছিলো। একাধিকবার সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। পত্রিকার প্রধান শিরোনাম হয়েছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। তবে আমার নিরলস চেষ্টায় এখন ক্যাম্পাস শান্ত।
গত তিন বছরে এক দিনের জন্যও ক্যাম্পাস বন্ধ করতে হয়নি। অপরাধ যেই করেছে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছে।
প্রশ্ন: আপনার সময়ে ক্যাম্পাসে ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী জুবায়ের আহমেদকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে ছাত্রলীগ নামধারী সন্ত্রাসীরা। এর প্রতিবাদে ক্যাম্পাসে লাগাতার আন্দোলন করে শিক্ষার্থীরা। এ বিষয়ে আপনি কি পদক্ষেপ নিয়েছেন?
ড. শরীফ এনামুল কবির: তদন্ত সাপেক্ষে ঘটনার সঙ্গে জড়িত ৭ শিক্ষার্থীকে আজীবনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিস্কার এবং ছাত্রত্ব বাতিলসহ ক্যাম্পাসে অবাঞ্চিত ও অপর ৬ শিক্ষার্থীকে বহিস্কারসহ ২ বছরের জন্য ছাত্রত্ব বাতিল ও এই দুই বছর ক্যাম্পাসে অবাঞ্চিত ঘোষণা করেছে বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট।
এছাড়া জুবায়ের হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেপুটি রেজিস্ট্রার (নিরাপত্তা) মো: হামিদুর রহমানকে বাদী করে একটি হত্যা মামলা করা হয়েছে।
প্রশ্ন: আপনার সময়কালে এতো উন্নয়নের পরও শিক্ষক কর্মকর্তা নিয়োগের বিষয়টি সমালোচিত হয়েছে। শিক্ষক সমাজ ব্যানারে বিএনপিপন্থী শিক্ষকরা এ সকল নিয়োগ বাতিলের জন্য আন্দোলন করেছেন। এ বিষয়ে আপনার মতামোত জানতে চাই।
ড. শরীফ এনামুল কবির: অধিক সংখ্যক শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, এটি ঠিক। কিন্তু এরও প্রয়োজন ছিলো। আমি দায়িত্ব গ্রহণের কয়েক বছর আগে থেকেই বিএনপির সময় ব্যাপক অনিয়ম হওয়ায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সকল প্রকার নিয়োগ বন্ধ ছিলো। অধিকাংশ বিভাগে শিক্ষক সংকট চরম আকার ধারণ করে। তাছাড়া বাণিজ্য অনুষদসহ নতুন দুটি অনুষদ ও ১০টি বিভাগ খোলায় শিক্ষক নিয়োগের সংখ্যাটা বেশি মনে হলেও প্রয়োজনের তুলনায় বেশি না।
এছাড়া সকল নিয়োগই স্ব স্ব বিভাগের নিয়োগ কমিটির সুপারেশের প্রেক্ষিতে দেওয়া হয়েছে। এখানে মেধার কোনো অবমূল্যায়ন করা হয়েছে বলে আমি মনে করি না।
প্রশ্ন: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি হিসেবে খ্যাত। কিন্তু এবার অতিথি পাখি আসেনি ক্যাম্পাসে। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, লেক লিজ দেওয়ার কারণে পাখি আসেনি। এ বিষয়ে আপনার বক্তব্য কি?
ড. শরীফ এনামুল কবির: যে লেকগুলোতে পাখি বসে সে লেকগুলো লিজ দেওয়া হয়নি। তারপরও আগামী বছর থেকে অন্যান্য লেকগুলোও লিজ না দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। ক্যাম্পাসের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য রক্ষার জন্য পরিকল্পিতভাবে সাড়ে তিন হাজারেরও বেশি ফলজ, বনজ, ঔষধি ও ফুলের চারা রোপন করেছি। তৈরি করা হয়েছে লিছু বাগান।
সব মিলিয়ে ক্যাম্পাসে বিভিন্ন প্রজাতির সাত লক্ষের অধিক গাছপালা রয়েছে। পাখির অভয়ারণ্য নিশ্চিত করা হয়েছে। লেকগুলো সংস্কার করা হয়েছে।
[email protected]
বাংলাদেশ সময়: ১৬৪২ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৪, ২০১২