ময়মনসিংহ: দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ময়মনসিংহ জেলার ১১টি আসনে ১৬টি রাজনৈতিক দলের ৭২ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এতে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ সমমনা বেশ কিছু দল নির্বাচনে না আসায় এবারের ভোটের হাওয়ায় প্রবল উত্তাপ না থাকলেও বিভিন্ন প্রতীকের পোস্টারে ছেয়ে গেছে জেলার ১১টি আসনের সড়ক থেকে অলিগলি।
তবে নির্বাচনী প্রচারণা শেষ হয়ে যাওয়ায় জেলা সদরের নগর থেকে শুরু করে গ্রামের পাড়া-মহল্লার চায়ের আড্ডায় চলছে প্রার্থীদের জয় পরাজয়ের হিসাব- নিকাশ। তবে এবারের নির্বাচনে প্রার্থীদের জয়-পরাজয়ে মূল ফ্যাক্টর হবে জেলার ১১টি আসনের ৭ লাখ ১১ হাজার ৮৯৫ জন নতুন ভোটার। এই নতুন ভোটারদের গোপন ব্যালটই প্রার্থীদের জয়-পরাজয়ের ভাগ্য নির্ধারণে মূল চাবিকাঠি হিসেবে কাজ করবে বলেও মনে করছেন অভিজ্ঞ রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
জেলা নির্বাচন কমিশন সূত্র জানায়, জেলার ১১টি সংসদীয় আসনে এবার ভোটার বেড়েছে ৭ লাখ ১১ হাজার ৮৯৫ জন। এই ভোটারদের প্রায় সবাই বয়সে তরুণ ও নবীন। ফলে রোববার (৭ জানুয়ারি) নির্বাচনেই তারা জীবনে প্রথমবার গোপন ব্যালটে ভোট দেবেন। এনিয়ে নবীনদের মধ্যে রয়েছে বেশ উৎসাহ-উদ্দীপনা।
বিগত কয়েকটি নির্বাচনের তিক্ত অভিজ্ঞতা ও ভোট বিরোধী অপপ্রচার ঠেকিয়ে নতুন ভোটারদের কেন্দ্রে উপস্থিতি নিশ্চিত করাকেই বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছে অভিজ্ঞ মহল।
তাদের ভাষ্য- বিএনপিসহ সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো ভোটকেন্দ্রে না যেতে উৎসাহিত করছে ভোটারদের। লিফলেট বিতরণে করছেন প্রচার-প্রচারণা। সেই সঙ্গে রয়েছে স্বতন্ত্র ও নৌকার প্রার্থীদের সহিংস কর্মকাণ্ডের ভীতি। এই অবস্থায় নবীন ভোটারদের কেন্দ্রে নিয়ে আসতে পারাই হবে এই নির্বাচনের বড় সফলতা।
এসব নিয়ে কথা হয় ময়মনসিংহ জেলার বেশকিছু নতুন ভোটারের সঙ্গে। তাদের মধ্যে নগরীর ঐতিহ্যবাহী আনন্দ মোহন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মো. তানভীর হাসান বলেন, ছোট বেলায় বাপ-দাদাদের মধ্যে যে রকম ভোট উৎসব দেখেছি, এখন তা নেই। তবে আমি এবার নতুন ভোটার হয়েছি, নির্বাচনের দিন কেন্দ্রের পরিবেশ ভালো থাকলে আমি ভোট দিতে যাব, তা না হলে কোনো ধরনের ঝামেলায় জড়িয়ে ভোট দিতে চাই না।
জেলার গৌরীপুর সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী মো. মিজানুর রহমান আকাশ বলেন, এবারের নির্বাচনে অনেক রাজনৈতিক দলের অংশ নেই। যতদূর বুঝতে পারছি তা হলো এই নির্বাচনটা মূলত আওয়ামী লীগের নেতারাই স্বতন্ত্র ও নৌকার ব্যানারে বিভক্ত হয়ে প্রার্থী হয়েছেন। ফলে আমি এবারের নির্বাচনে জীবনের প্রথম ভোটার হলেও ভোট আমার আগ্রহ নেই।
ভিন্নমত পোষণ করে ময়মনসিংহ নগরীর সানকিপাড়া এলাকার বাসিন্দা মো. আরিফুল হক বলেন, এবার আমি প্রথম ভোটার হয়েছি। তাই আমি আমার পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছি। আমি মনে করি, এলাকার জনপ্রতিনিধি নির্বাচনে ভোট প্রয়োগ আমার মতো প্রতিটি নাগরিকের নৈতিক দায়িত্ব। এক্ষেত্রে কেন্দ্রের নিরাপত্তা ও শান্তিপূর্ণ উৎসবমুখর ভোটের পরিবেশ গুরুত্বপূর্ণ।
এ বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাজরিক (সুজন) ময়মনসিংহ মহানগর শাখার সম্পাদক ও কবি আলী ইউসুফ বলেন, নতুন ভোটারদের আকৃষ্ট করার জন্য সবার অংশগ্রহণে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন ছিল অপরিহার্য। তবে এবার তা হয়নি। তাছাড়া বিগত দুই বা তিনটি নির্বাচন নিয়ে ভোটারদের মধ্যে একটি বেদনার রেশ রয়েছে। এক্ষেত্রে নতুন ভোটারদের কেন্দ্রে নেওয়ায় এখন বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ এবারের নির্বাচনে নতুন ভোটাররা উপেক্ষিত। তাদের জন্য প্রার্থীদের কোনো আশার বাণী নেই এবং তাদের কেন্দ্রে নেওয়ার জন্যও প্রার্থীদের দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ দেখছি না।
ভিন্নমত পোষণ করে বাম রাজনীতিক ও মানবাধিকার সংগঠক অ্যাডভোকেট নজরুল ইসলাম চুন্নু বলেন, ভোট নিয়ে নবীন বা প্রবীণ সব বয়সী মানুষের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। কারণ আমরা প্রবীণরাই দেশের নির্বাচন ব্যবস্থাকে বিতর্কিত করেছি। তবে আমি আশা করব প্রবীণদের এই ভুলগুলো সংশোধন করতেই নবীনরা এবার ভোটকেন্দ্রে গিয়ে নিজের ভোট নিজে প্রয়োগ করবে। এতে কোথায় বাধাগ্রস্ত হলে সেখান থেকেই তরুণদের প্রতিবাদ গড়ে তোলা উচিত। তবেই বদলে যাবে বাংলাদেশ। আশা করছি তরুণ ভোটাররা এবার তা করবে।
বিএনপি বা সমমনা দলগুলো নির্বাচনে না আসায় নতুন ভোটারদের ভোট দানে কোনো প্রভাব পড়বে না বলেও মনে করছেন কেউ কেউ।
তাদের ভাষ্য- নতুন প্রজন্ম আগুন সন্ত্রাস বা নৈরাজ্য দেখতে চায় না। তারা বাংলাদেশকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে জীবনের প্রথম ভোট যোগ্য প্রার্থীর পক্ষে প্রয়োগ করবে বলে বিশ্বাস করি। তাছাড়া ১৪ দল তথা আওয়ামী লীগের ইশতেহারেও নতুন ভোটারদের কথা চিন্তা করে কর্মোপযোগী শিক্ষা ও যুবকদের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে এবং সেই সঙ্গে এবারের নির্বাচনে ভোট কেন্দ্রের উপস্থিতিতে প্রধান টার্গেট জীবনে প্রথম ভোটার হওয়া তরুণরা।
ময়মনসিংহ জেলা নির্বাচন কার্যালয় সূত্রমতে, ২০২৩ সালের ২০ জুলাই পর্যন্ত এই জেলার ১১টি সংসদীয় আসনে ভোটার সংখ্যা ৪৪ লাখ ৬৩ হাজার ৭২৭ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ২২ লাখ ৫৬ হাজার ৫৯ জন এবং নারী ভোটার সংখ্যা ২২ লাখ ৭ হাজার ৬৫১ জন। সেই সঙ্গে এবার হিজড়া সম্প্রদায়ের নতুন ভোটার হয়েছে ১৭ জন।
এর আগে ২০১৮ সালে অর্থাৎ বিগত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ময়মনসিংহ জেলায় মোট ভোটার সংখ্যা ছিল ৩৭ লাখ ৫১ হাজার ৮৩২ জন। এ হিসেবে এবার নতুন ভোটার বেড়েছে ৭ লাখ ১১ হাজার ৮৯৫ জন।
তবে ২০২৩ সালের ২০ জুলাইয়ের পর থেকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত এ হিসেবে কম বা বেশি হতে পারে বলে জানিয়েছেন জেলার সিনিয়র নির্বাচন কর্মকর্তা সফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, ওই সময়ের পরে কেউ মারা গেলে কিংবা নতু ভোটার অন্তর্ভুক্ত হলে ভোটারের সংখ্যা পরিবর্তিত হতে পারে।
সূত্রটি আরও জানায়, জেলার ৪৪ লাখ ৬৩ হাজার ৭২৭ জন ভোটারের মধ্যে ময়মনসিংহ-১ (হালুয়াঘাট ও ধোবাউড়া উপজেলা) আসনের দুটি উপজেলায় বর্তমানে মোট ভোটার ৪ লাখ ৫২ হাজার ২২৬ জন। এর মধ্যে হালুয়াঘাট উপজেলায় ভোটার ২ লাখ ৭৮ হাজার ৭৩৮ জন এবং ধোবাউড়া উপজেলায় ১ লাখ ৭৩ হাজার ৪৮৮ জন। এতে গতবারের চেয়ে নতুন ভোটার বেড়েছে ৭৪ হাজার ৯৩০ জন।
ময়মনসিংহ-২ (ফুলপুর ও তারাকান্দা উপজেলা) আসনে ভোটার সংখ্যা ৫ লাখ ৩৮ হাজার ৯১০ জন। এর মধ্যে ফুলপুর উপজেলায় ভোটার ২ লাখ ৭৯ হাজার ৯০৬ জন এবং তারাকান্দায় ২ লাখ ৫৯ হাজার ৪ জন। এই আসনে নতুন ভোটার হয়েছে ৮৮ হাজার ২০৭ জন।
ময়মনসিংহ-৩ (গৌরীপুর) উপজেলায় মোট ভোটার ৩ লাখ ৬ হাজার ২৬৪ জন। এর আগে ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মোট ভোটার ছিল ২ লাখ ৩৪ হাজার ৫৯৫ জন। এ হিসেবে এবার নতুন ভোটার বেড়েছে ৭১ হাজার ৬৬৯ জন।
তবে জেলায় সবচেয়ে বেশি ভোটার ময়মনসিংহ-৪ আসনে। ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশন (মসিক) ও সদর উপজেলা নিয়ে গঠিত এই আসনে মোট ভোটার ৬ লাখ ৫২ হাজার ৯০৭ জন। এর মধ্যে মসিকে ৩ লাখ ৩৬ হাজার ৭৩৮ জন এবং সদর উপজেলায় মোট ভোটার ৩ লাখ ১৬ হাজার ১৬৯ জন। সেই সঙ্গে এই আসনে এবার ১৩ জন তৃতীয় লিঙ্গের ভোটারসহ মোট ভোটার বেড়েছে ৯৫ হাজার ৮৭৬ জন।
ময়মনসিংহ-৫ (মুক্তাগাছা) আসনে মোট ভোটার ৩ লাখ ৬৩ হাজার ৪৬৬ জন। এবার ভোটার বেড়েছে ৫৬ হাজার ৯৪১ জন।
ময়মনসিংহ-৬ (ফুলবাড়িয়া) আসনে মোট ভোটার ৩ লাখ ৮৫ হাজার ২৬ জন। এবার বেড়েছে ৫৯ হাজার ২৮৬ জন। ময়মনসিংহ-৭ (ত্রিশাল) আসনে ভোটার সংখ্যা ৩ লাখ ৭৩ হাজার ৩৩৬ জন। এর মধ্যে নতুন ভোটার ৫৭ হাজার ৮২৮ জন।
ময়মনসিংহ-৮ (ঈশ্বরগঞ্জ) আসনে ভোটার ৩ লাখ ২০ হাজার ৯৬৬ জন। এর মধ্যে নতুন ভোটার ৪৯ হাজার ৭৭০ জন।
ময়মনসিংহ-৯ (নান্দাইল) আসনে ভোটার সংখ্যা ৩ লাখ ৫৩ হাজার ৮০২ জন। নতুন ভোটার ৫৯ হাজার ৬৯৭ জন।
ময়মনসিংহ-১০ (গফরগাঁও) আসনে ভোটার ৩ লাখ ৮১ হাজার ৪৫০ জন। নতুন ভোটার বেড়েছে ৫৭ হাজার ১০৫ জন।
এছাড়া ময়মনসিংহ-১১ (ভালুকা) আসনে ভোটার রয়েছে ৩ লাখ ৩৫ হাজার ৩৭৪ জন। তবে এ আসনে এবার নতুন ভোটার রয়েছেন ৪০ হাজার ৫৯৬ জন।
বাংলাদেশ সময়: ০৩৩৩ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৭, ২০২৪
এসআরএস