ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

নির্বাচন ও ইসি

‘দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অন্তর্ভুক্তিমূলক না হওয়ায় বিতর্কিত হয়েছে’

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫২৪ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৫, ২০২৪
‘দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অন্তর্ভুক্তিমূলক না হওয়ায় বিতর্কিত হয়েছে’ কথা বলছেন সদ্য পদত্যাগ করা প্রধান নির্বাচন কমিশনার।

ঢাকা: সদ্য পদত্যাগ করা প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ২০১৪ সালের নির্বাচনের মতো অন্তর্ভুক্তি না হওয়ায় বিতর্কিত হয়েছে।

বৃহস্পতিবার (৫ সেপ্টেম্বর) নির্বাচন ভবনের সভাকক্ষে গণমাধ্যমের উপস্থিতিতে দুপুর সোয়া ১২টার দিকে পদত্যাগপত্রে সই করে তা কাজী হাবিবুল আউয়াল নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিব শফিউল আজিমের হাতে তুলে দেন।

অন্যান্য নির্বাচন কমিশনাররাও পরবর্তীতে পদত্যাগপত্রে সই করে সচিবের কাছে দেন। সচিব রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্রগুলো তুলে দেবেন।

এর আগে সিইসি লিখিত বক্তব্যে বলেন, দেশের প্রথম সাংবিধানিক সাধারণ নির্বাচন ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেই নির্বাচন নিয়েও বিতর্ক ছিল। ১৯৭৯ ও ১৯৮৭ সালের সাধারণ নির্বাচন সামরিক শাসনামলে হয়েছে। ফলাফল নিয়ে বিতর্ক ছিল। ১৯৯১ এর নির্বাচন সম্মত রাজনৈতিক রূপরেখার ভিত্তিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হয়েছিল। ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের নির্বাচন সাংবিধানিক নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে, সূক্ষ্ম বা স্থূল কারচুপির সীমিত সমালোচনা সত্ত্বেও, সার্বিকভাবে গ্রহণযোগ্য হয়েছিল। ২০০৮ সালের নির্বাচন সেনা সমর্থিত নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেই নির্বাচনে বিএনপি সংসদে ২৭টি এবং আওয়ামী লীগ ২৩০টি আসন পেয়েছিল। নির্বাচন বিতর্কের ঊর্ধ্বে ছিল না। নিরাপদ প্রস্থান বিষয়ে বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের সাথে সেনা সমর্থিত অসামরিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দরকষাকষির বিষয়টি প্রকাশ্য ছিল। সে প্রশ্নে বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের অবস্থানও গোপন ছিল না। ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের নির্বাচন সংবিধানমতে দলীয় সরকারের অধীনে হয়েছে।

তিনি বলেন, ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিএনপিসহ অনেক দলই অংশ নেয়নি। ফলে সেই নির্বাচনও ২০২৪ সালের অনুরূপ অন্তর্ভুক্তিমূলক ছিল না। ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়। আসন পেয়েছিল ছয়টি। পক্ষান্তরে আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ২৫৮টি। মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন। ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়েছে বর্তমান কমিশনের অধীনে। ৪৪টি নিবন্ধিত দলের মধ্যে ২৮টি দল নির্বাচনে অংশ নিলেও প্রধানতম বিরোধদল বিএনপি ও সমমনা দলগুলো সেই নির্বাচন প্রত্যাখান করে। নির্বাচন অন্তর্ভুক্তিমূলক হয়নি। কমিশন বিএনপিসহ সমমনা দলগুলোকে নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য একাধিকবার আহ্বান করা সত্ত্বেও তারা নির্বাচনে অংশ নেননি। নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা না করার বিষয়টি দলের নিজস্ব সিদ্ধান্তের বিষয়।  

কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, নির্বাচন স্থগিত বা বাতিল করে দেওয়ার মতো কোনো সাংবিধানিক ভিত্তি ছিল না। সেই কারণে অনেকেই কমিশনকে দোষারোপ করছেন। নির্বাচন কখন কী কারণে কতদিনের জন্য স্থগিত করা যাবে তাও সংবিধানে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা আছে। অতীতে কখনই কোনো কমিশন নির্বাচন বাতিল করে দিয়ে পদত্যাগ করেননি। সম্প্রতি ভেঙে দেওয়া সংসদের ২৯৯টি আসনে নির্বাচন প্রার্থীদের মধ্যে ব্যক্তিকেন্দ্রিক প্রতিযোগিতার মাধ্যমে হয়েছে। দলের মধ্যে নয়। ২৯৯ আসনে ১৯৬৯ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দিতা করেছিলেন।

নির্বাচন নিষ্পন্ন করা অতিশয় কঠিন একটি কর্মযজ্ঞ। নির্বাচন গ্রহণযোগ্য না হওয়ার সব দোষ বা দায়-দায়িত্ব সব সময় কেবল নির্বাচন কমিশনের ওপর এককভাবে আরোপ করা হয়ে থাকে। একটি কমিশন না হয় অসৎ বা পক্ষপাতদুষ্ট হতে পারে। কিন্তু সব সময় সব কমিশনই অসৎ বা পক্ষপাতদুষ্ট হতে পারে না। কমিশন বিভিন্ন কারণে নির্ভেজাল গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে অক্ষম বা অসমর্থ হতে পারে। বিদ্যমান ব্যবস্থায়, আমাদের বিশ্বাস, কেবল কমিশনের পুনর্বিন্যাসের মাধ্যমে অবাধ, নিরপেক্ষ, কালো টাকা ও পেশিশক্তি-বিবর্জিত এবং প্রশাসন-পুলিশের প্রভাবমুক্ত নির্বাচন নিশ্চিত করা যাবে না। নির্বাচন পদ্ধতিতে দুর্ভেদ্য মৌলিক সংস্কার প্রয়োজন হবে। রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও আচরণে এবং বিশেষত প্রার্থীদের আচরণে পরিবর্তন প্রয়োজন হবে।

সরকারের সাবেক এই আইন সচিব বলেন, ১৯৭৩ থেকে হওয়া অতীতের অন্যান্য সব নির্বাচন ছাড়াও ২০০৮, ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনের বিতর্কিত বা সন্দিগ্ধ বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে কমিশন পরবর্তী সকল নির্বাচনগুলো সতর্কতার সাথে আয়োজনের চেষ্টা করেছে। জাতীয় এবং স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন স্তরের নির্বাচনে দিনের বেলায় ব্যালটপেপার প্রেরণ, কতিপয় উপনির্বাচনে ভিডিও পর্যবেক্ষণ, ইভিএম ব্যবহার, দেশের সব জেলায় একইদিনে তবে প্রতিটি জেলার প্রশাসনিক সীমানার মধ্যেমাঝে ৩/৫ দিন বিরতি দিয়ে ৫/৬ টি ধাপে নির্বাচন অনুষ্ঠান, সরকারি কর্মকর্তাদের ব্যাপকভাবে রদবদল, ইত্যাদি গৃহীত ব্যবস্থা নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুশৃঙ্খল করতে অনেকটাই সহায়ক হয়েছিল। নির্বাচন মূলত একদলীয় হওয়ার কারণে কারচুপি বা সরকারিভাবে প্রভাবিত করার প্রয়োজনও ছিল না। নির্বাচন দলের ভেতরেই হয়েছে। মধ্যে হয়নি।

সিইসি আউয়াল বলেন, আপনাদের অবহিত করতে চাই আমিসহ কমিশনাররা দেশের পরিবর্তিত বিরাজিত অবস্থায় পদত্যাগ করতে মনস্থ করেছি। আমরা অদ্যই পদত্যাগপত্র মহামান্য রাষ্ট্রপতি সমীপে উপস্থাপনের নিমিত্ত কমিশনের সচিবের হাতে দেবো।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন পর্যায়ক্রমে সরকার পতনের আন্দোলনের রূপ নিলে পদত্যাগ করে ৫ আগস্ট দেশ ছাড়েন সে সময়কার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর রাষ্ট্রপতি সংসদও ভেঙে দেন। গঠন হয় অন্তর্বর্তী সরকার।

সরকারের পতনের পর জাতীয় সংসদের স্পিকারসহ বিভিন্ন সাংবিধানিক পদগুলো পদত্যাগ, পরিবর্তনের ঘটনা ঘটে। এই অবস্থায় রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাতের চেষ্টা করেও সুযোগ পাননি কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন কমিশন। পরবর্তীতে ‘আলোচনার জন্য কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না’ উল্লেখ করে পত্রিকায় কলাম লিখে আলোচনার জন্য কর্তৃপক্ষ খুঁজে পাননি।

সংবিধান অনুযায়ী, সংসদ ভেঙে যাওয়ার পরবর্তী নব্বই দিনের মধ্যে নির্বাচনের বাধ্যবাধকতা না মানলে কমিশনের মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে। যেহেতু অন্তর্বর্তী সরকার পরবর্তী নির্বাচনের কোনো রূপরেখা দেয়নি, তাই সাংবিধানিক সংকটের মধ্যে পড়ে আউয়াল কমিশন। মূলত আইনি সংকট থেকে দূরে থাকতেই কমিশনকে এভাবে পদত্যাগ করতে হলো বলে মনে করছেন ইসি কর্মকর্তারা।

এই কমিশনই দেশে প্রথমবারের মতো স্বতন্ত্র আইনের মাধ্যমে নিয়োগ পেয়ে ২০২২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি দায়িত্ব গ্রহণ করেন। প্রথমবারের এমন সংকটের মধ্যে তাদের পদত্যাগও করতে হলো। তবে এর আগেও কমিশন পদত্যাগ করেছে, তবে তা রাজনৈতিক চাপের মধ্যে।

কাজী হাবিবুল আউয়ালের কর্মজীবন:

মুনসেফ হিসেবে সরকারি চাকরিতে যোগ দিয়ে একপর্যায়ে তিনি আইনসচিব হয়েছিলেন। তবে নীতিমালা না থাকায় ২০১০ সালে তার নিয়োগ অবৈধ ঘোষণা করেন হাইকোর্ট। এরপর তিনি ধর্ম সচিব ও পরবর্তীতে জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের সচিব হন। ২০১৪ সালে সচিব হিসেবে পদায়ন হয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে। এরপর জ্যেষ্ঠ সচিব হিসেবে ২০১৭ সালে অবসরে যান।

হাটহাজারীতে জন্ম নেওয়া হাবিবুল আউয়ালের বাবা কাজী আবদুল আউয়াল ছিলেন কারা বিভাগের কর্মকর্তা। ১৯৭৫ সালে জাতীয় চার নেতা হত্যা মামলার বাদী হয়ে ছিলেন তিনি।

সিইসিদের দায়িত্বকাল:

কাজী হাবিবুল আউয়াল: ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২ থেকে ৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪
কে এম নূরুল হুদা: ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ থেকে ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২
কাজী রকিবউদ্দীন আহমেদ: ৯ ফেব্রুয়ারি ২০১২ থেকে ৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৭
এ টি এম শামসুল হুদা: ৫ ফেব্রুয়ারি ২০০৭ থেকে ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১২
বিচারপতি এম এ আজিজ: ২৩ মে ২০০৫ থেকে ২১ জানুয়ারি ২০০৭
এম এ সাইদ: ২৩ মে ২০০০ থেকে ২২ মে ২০০৫
মোহাম্মদ আবু হেনা: ৯ এপ্রিল ১৯৯৬ থেকে ৮ মে ২০০০
বিচারপতি এ কে এম সাদেক: ২৭ এপ্রিল ১৯৯৫ থেকে ৬ এপ্রিল ১৯৯৬
বিচারপতি আব্দুর রউফ: ২৫ ডিসেম্বর ১৯৯০ থেকে ১৮ এপ্রিল ১৯৯৫
বিচারপতি সুলতান হোসেন খান: ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৯০ থেকে ২৪ ডিসেম্বর ১৯৯০
বিচারপতি চৌধুরী এ টি এম মাসউদ: ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৫ থেকে ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৯০
বিচারপতি এ কে এম নুরুল ইসলাম: ৮ জুলাই ১৯৭৭ থেকে ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৫
বিচারপতি মো. ইদ্রিস: ৭ জুলাই ১৯৭২ থেকে ৭ জুলাই ১৯৭৭
সিইসি পদে দায়িত্বে থাকা ১৩ জনের মধ্যে ছয়জন তাদের পাঁচ বছর মেয়াদ পূর্ণ করতে পেরেছিলেন। এদের মধ্যে রয়েছেন বিচারপতি মো. ইদ্রিস, বিচারপতি এটিএম মাসউদ, এমএ সাঈদ, শামসুল হুদা, কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ ও কেএম নূরুল হুদা।

বাংলাদেশ সময়: ১৫২৩ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৫, ২০২৪
ইইউডি/এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।