ঢাকা: ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের অন্যতম নেতা ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক মো. নাহিদ ইসলামের জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) উপদেষ্টা পদে থাকাবস্থায় লক করে রেখেছিল নির্বাচন কমিশন (ইসি)।
সূত্রগুলো জানিয়েছে, এনআইডি তথ্য ফাঁসের অভিযোগের ভিত্তিতে ওই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সংস্থাটি।
২০২৪ সালে ৩৬ দিনের অভূতপূর্ব আন্দোলনের মুখে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে ৫ আগস্ট ভারতে পালিয়ে গেলে যে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন হয়, সেখানে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা পদে আসীন হন নাহিদ। আর সেই পদে থাকাকালীনই তার বিরুদ্ধে একটি অনলাইন প্লাটফর্মে এনআইডি তথ্য ফাঁস করার অভিযোগ আসে।
জানা গেছে, ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) তৎকালীন মহাপরিচালক মৌখিকভাবে মো. নাহিদ ইসলামের বিরুদ্ধে ‘ভন্ড বাবা’ নামে এক হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের মাধ্যমে নাগরিকদের তথ্য সংগ্রহ করে বাইরে পাচারের অভিযোগ আনেন। সেই অভিযোগ আমলে নিয়ে তদন্ত করার সিদ্ধান্ত নেয় ইসি। তবে সহকারী প্রোগ্রামার আমিনুল ইসলামের নেতৃত্বে গঠিত দুই সদস্যের তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন দেওয়ার আগেই নাহিদের এনআইডি লক করার সুপারিশ করেন সিস্টেম অ্যানালিস্ট মোহাম্মদ আরিফুল ইসলাম৷ সেই সুপারিশের ভিত্তিতে গত বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর এনআইডি লক করার নির্দেশ দেন তৎকালীন জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন (এনআইডি) অনুবিভাগের মহাপরিচালক মো. মাহবুব আলম তালুকদার।
এদিকে তদন্ত কমিটি দুদিন পর অর্থাৎ ২০২৪ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর প্রতিবেদন দাখিল করে। এতে উল্লেখ করা হয়, এনটিএমসি-এর মহাপরিচালক কর্তৃক মৌখিকভাবে অভিযোগ পাওয়া যায় যে, মো. নাহিদ ইসলাম ‘ভন্ড বাবা’ নামক হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের এডমিন হিসেবে কাজ করে নাগরিকদের তথ্যাদি বাহিরে সরবরাহ করেন।
তদন্ত চলাকালীন সময়ে অনলাইনের বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ার গ্রুপ যাচাই বাছাই করে দেখা যায় যে, ‘ভন্ড বাবা’ গ্রুপটি হোয়াটসঅ্যাপ-এর কোনো গ্রুপ নয়, বরং এটি টেলিগ্রামের একটি গ্রুপ। ওই গ্রুপের অ্যাডমিন তিনি নন। তিনি এই গ্রুপ হতে ডাটা সংগ্রহ করে অন্য কোথাও সরবরাহ করেন এমন অভিযোগটি সত্য নয় এবং ডাটা সরবরাহ করার বিষয়ে তার কোনো সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি।
প্রতিবেদনে বলা হয়, যেহেতু এই ভোটার কর্তৃক ডাটা সরবরাহ করার বিষয়ে কোনো সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি এবং অভিযোগটি মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে, সেহেতু মো. নাহিদ ইসলামের এনআইডি আনলক করার জন্য সুপারিশ করে কমিটি।
তাদের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে নথি উত্থাপন করা হলে ২২ সেপ্টেম্বর এনআইডি মহাপরিচালক তখন এনআইডিটি আনলক করার সিদ্ধান্ত দেন। এভাবেই পাঁচ দিনের জন্য লক থাকে সাবেক উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামের এনআইডি।
ইসি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এনটিএমসি থেকে এনআইডি নম্বর পাঠিয়ে সংশ্লিষ্ট ভোটারের বিরুদ্ধে তথ্য পাচারের অভিযোগ তোলা হয়। আর সেই এনআইডি যে উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামের সংশ্লিষ্টরা সেটা বুঝতেই পারেননি। বরং লক করার পর বোধোদয় হয়েছে যে এটা কার এনআইডি। পরবর্তীতে দ্রুতই আবার সেটা আনলক করা হয়।
এই কাজের সঙ্গে যুক্ত দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা বলেন, বিষয়টি সঠিক যে একজন ছাত্র উপদেষ্টার এনআইডি তখন লক করা হয়েছিল। তবে খুব দ্রুত সময়ের ব্যবধানে আবার আনলক করা হয়।
৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের চার মাস আগে ১ এপ্রিল বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের সদস্য অতিরিক্ত সচিব মাহবুব আলম তালুকদারকে এনআইডি মহাপরিচালক হিসেবে পদায়ন করা হয়। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর ৬ নভেম্বর বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে তাকে সরিয়ে নেওয়া হলেও বর্তমানে তিনি চট্টগ্রাম পোর্ট অথরিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
নাহিদ ইসলামের এনআইডি লক করার বিষয়ে তিনি বাংলানিউজকে বলেন, যখন কোনো অভিযোগ আসে তখন তদন্তকালীন এনআইডি লক করা হয়। এটা একটা প্রসিডিউর। যদি তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত না হয়, তখন আবার আনলক করা হয়। এটা প্রক্রিয়া। তো সেই ছাত্রনেতার ক্ষেত্রেও এমনটি হয়েছিল। হয়তো কোনো এজেন্সি থেকে অভিযোগ এসেছিল। তবে সেটা প্রমাণিত হয়নি। তাই কয়েকদিনের জন্য এনআইডি লক ছিল।
ইসি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সাধারণত কারও এনআইডি লক করা হলে কমিশনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সরকার পরিবর্তনের ঠিক এক মাসের মাথায় গত বছরের ৫ সেপ্টেম্বর কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন কমিশন পদত্যাগ করেন। এক্ষেত্রে কমিশন শূন্য পরিস্থিতিতে এনআইডি মহাপরিচালক ওই সিদ্ধান্ত নেন।
বর্তমান এনআইডি মহাপরিচালক এসএম হুমাযুন কবীর বলেন, সে সময় আমি ছিলাম না। তাই সেটা আমার বিবেচনার বিষয় নয়। আর পুরোনো বিষয় যেটার সঙ্গে আমার কোনো সম্পৃক্ততা নেই, সেটার মতামতও দিতে চাই না।
এনআইডি লক করা হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির আর নাগরিক সেবা মেলে না। সম্প্রতি শেখ হাসিনা ও পরিবারের ১০ সদস্য এবং সাবেক এনআইডি মহাপরিচালক সুলতানুজ্জামান মো. সালেহ উদ্দীনের এনআইডিও লক করেছে ইসি। অতীতেও অনেকের এনআইডি নানা প্রেক্ষাপটে লক করে সংস্থাটি।
ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের অগ্রভাগে থাকা সংগঠকদের নিয়ে নতুন দল গঠনের জন্য গত ২৫ ফেব্রুয়ারি সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ থেকে পদত্যাগ করেন নাহিদ ইসলাম। এরপর ২৮ ফেব্রুয়ারি এনসিপির আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে তাকে আহ্বায়ক ঘোষণা করা হয়।
ইইউডি/এইচএ/