যুক্তরাজ্যের অপরাধ তদন্ত সংস্থা এনসিএ (ন্যাশনাল ক্রাইম এজেন্সি) ছয় বছর ধরে জোর তদন্ত চালিয়ে বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয়পত্র- ন্যাশনাল আইডেন্টিটি (এনআইডি) প্রকল্পে দুর্নীতির কোনো প্রমাণ পায়নি। তাই সংস্থাটি এ দুর্নীতির মামলা বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
আমাদের যুক্তরাজ্য প্রতিনিধি জানান, প্রকল্পটির অর্থায়নকারী বিশ্বব্যাংক এ তদন্তের আগ্রহী উদ্যোক্তা। কেন এ তদন্ত করতে হয়েছে, তা খতিয়ে দেখা হয়েছে।
ঘটনার উন্মেষ ২০০৭ সালে। সে বছর বাংলাদেশি সফটওয়্যার কোম্পানি ‘টাইগার আইটি বাংলাদেশ লিমিটেড’ আসন্ন নির্বাচনে ব্যবহারের জন্য সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে দেশে ৮ কোটি নাগরিকের জাতীয় বায়োমেট্রিক ডেটাবেজ তৈরি করে। এ ডেটাবেজ ব্যবহার করেই ২০০৮ সালে প্রথমবারের মতো নাগরিকদের জন্য আইডি কার্ড ইস্যু করা হয়েছিল। প্রকল্পটি ছিল, জাতি যখন শাসনতন্ত্রের এক নবযুগের সূচনার জন্য অপেক্ষমাণ- সেই সময়টায় বাস্তবায়িত ঐতিহাসিক প্রকল্প।
২০০৮ সালে এনআইডি প্রকল্পের চমৎকার সাফল্যের পর ২০১১ সালে বিশ্বব্যাংক জানায়, কাগজে তৈরি আইডি কার্ডের বদলে স্মার্টকার্ড প্রকল্প বাস্তবায়নে তারা ঋণ দেবে। নির্বাচন কমিশন তখন (২০১৪) এ কাজের জন্য আন্তর্জাতিক টেন্ডার ডাকে। টেন্ডার প্রক্রিয়ার সবকিছুই বিশ্বব্যাংক পর্যালোচনার পর অনুমোদন দেয়। টেন্ডারে কাজ পায় ‘ওবারথার টেকনোলজিস’ নামের ফরাসি একটি কোম্পানি। প্রকল্প পর্যালোচনাকালে বিশ্বব্যাংক এর অগ্রগতি ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতায় খুবই সন্তোষ প্রকাশ করে। সর্বনিম্ন দর উদ্ধৃত করায় বিদেশি কোম্পানিটি অন্যান্য
প্রতিযোগীকে পরাস্ত করে ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে কাজ পেয়ে যায়। তারা ডেডিকেটেড সফটওয়্যার সরবরাহ নেওয়ার জন্য টাইগার আইটি নামক প্রতিষ্ঠানকে সাব-কন্ট্রাক্টর নিয়োগ করে। ‘সিএসএল’ নামের দেশীয় আরেকটি আইটি কোম্পানিকে করে তাদের লোকাল এজেন্ট।
টেন্ডারে দ্বিতীয় সর্বনিম্ন দরদাতা হয়েছিল ‘স্যাফরান মরফো’ নামের কোম্পানি। পরবর্তীকালে এই মরফো একীভূত হয়েছিল ওবারথার টেকনোলজিসের সঙ্গে। একীভূত হয়ে তারা নামধারণ করে ‘আইডিইএমআইএ’।
টাইগার আইটির সঙ্গে ওবারথারের মিত্রতা প্রকল্প কাজ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে তাৎপর্যময় ভূমিকা রেখেছিল। টাইগারের অংশগ্রহণের কারণে বিদ্যমান অবকাঠামো ব্যবহার করে নতুন আইডি সিস্টেমের ডিজাইন করা, ব্যয়বাহুল্য এড়িয়ে চলা ইত্যাদির মাধ্যমে দেশের উল্লেখযোগ্য খরচ বেঁচে যায়। এর ফলে জাতীয় স্মার্ট আইডি কার্ড আজ অবধি বিশ্বের সবচেয়ে সস্তায় বানানো পলিকার্বোনেট স্মার্ট আইডি কার্ড। বাংলাদেশে একটি স্মার্ট আইডি কার্ড তৈরিতে গড়পড়তা ব্যয় (ব্যক্তির নামাঙ্কিতসহ এবং শুল্ক, ভ্যাট, কর আরোপের আগে) ১ দশমিক ০৩ ডলার। পাকিস্তানে প্রতিটি পলিকার্বোনেট স্মার্ট আইডি কার্ড তৈরিতে খরচ হয় ১ দশমিক ৬৯ ডলার; পেরুতে ১ দশমিক ৫২ ডলার, গুয়েতেমালায় ১ দশমিক ৬০ ডলার এবং শাদে ১ দশমিক ৯১ ডলার। এসব দেশের যে হিসাব দেওয়া হলো, সবই ব্যক্তির নামাঙ্কিত ছাড়া। নামাঙ্কনে খরচ হতে পারে প্রতি ইউনিটের জন্য অর্ধ ডলার। এ হিসাবের ভিত্তিতে বাংলাদেশ প্রতি কার্ডে কমপক্ষে ৭০% বাঁচিয়েছে। এর ফলে ৮ কোটি কার্ডের জন্য ধার্য প্রাথমিক বাজেটের টাকা দিয়েই নির্বাচন কমিশন ১০ কোটি (ওই সময়কার প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকের সংখ্যা) কার্ডের ফরমায়েশ করতে সক্ষম হয়।
প্রকল্পের কাজ প্রাপ্তির পরপর বাংলাদেশের এনআইডি সিস্টেম বিষয়ে টাইগার আইটির অভিজ্ঞতা ব্যবহার করে ওবারথার (স্যাফরান মরফোর সঙ্গে একীভূত হওয়ায় বর্তমানে ‘আইডিইএমআইএ’) সাব-কন্ট্রাক্টরের (টাইগার আইটি) ভূমিকা সংকোচনের কৌশল অবলম্বন করে। বিশ্ববাজার থেকে এক প্রতিদ্বন্দ্বীকে ধ্বংস করে দেওয়ার মতলবে এবং নিজের মুনাফা বৃদ্ধির লক্ষ্যে তারা শেষতক টাইগারকে প্রকল্প থেকেই সরিয়ে দিল। ন্যায়বিচারের আশায় টাইগার আইটি বাংলাদেশ হাই কোর্টের শরণ নেয়। বেগতিক দেখে ওবারথার যুক্তরাজ্যের আদালতে যায়। আবেদন জানায়, বাংলাদেশে মামলা ক্ষান্ত দেওয়ার জন্য টাইগারকে বাধ্য করতে অবিলম্বে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হোক। যুক্তরাজ্যের মামলায় ২০১৯ সালে জয়ী হয় টাইগার আইটি। মামলায় জয়ী হওয়া সত্ত্বেও টাইগার আইটিকে প্রকল্প থেকে অপসারণ করে আইডিইএমআইএ।
আইডিইএমআইএর কারসাজিতে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া বাংলাদেশি কোম্পানি শুধু টাইগার আইটিই নয়, টাইগার আইটিকে হটিয়ে দেওয়ার পর আইডিইএমআইএ তার লোকাল এজেন্ট সিএমএলকে প্রকল্প থেকে সরিয়ে দেয়। এ কাজটা করেন আইডিইএমআইএর কান্ট্রি ডিরেক্টর অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাইফুর রহমান; ইনি বিএনপির তদানীন্তন নির্বাহী কমিটির সদস্য মোহাম্মদ শোকরানার ভাই। তারেক জিয়ার সঙ্গে এই শোকরানার খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক।
সূত্র জানায়, বিরোধীদলীয় রাজনীতিসংশ্লিষ্টদের জাতীয় নিরাপত্তাসংশ্লিষ্ট প্রকল্পে যুক্তকরণের ফল কী বয়ে আনতে পারে তা পরবর্তী ঘটনাবলিতে হয়তো স্পষ্ট হয়। লোকাল পার্টনার ও সাব-কন্ট্রাক্টরের সঙ্গে আইডিইএমআইএর বিরোধের পাশাপাশি প্রকল্পটিই বিশ্বব্যাংকের তদন্তের বিষয় হয়ে গেল আইডিইএমআইএর প্ররোচনায়। টেন্ডারের কাজ পাওয়ার পরপরই ওবারথার ও মরফো একীভূত হওয়ার আগে, ওবারথার বিরুদ্ধে মরফো বিইসির কাছে পরস্পরবিরোধী দুটি অভিযোগ করে। একটি অভিযোগে বলা হয়, ওবারথার যে দর প্রস্তাব করেছে তা ‘অযৌক্তিক কম’। প্রকল্পটিতে দুর্নীতি হওয়ার বেশ সম্ভাবনা। তাই তদন্ত করার অনুরোধ জানায় মরফো।
ফলত, প্রকল্পটিতে নিরীক্ষণ (অডিট) চালায় বিশ্বব্যাংক। নিরীক্ষণকালে ওবারথার জানায়, তারা প্রতিযোগিতা সংকোচনের সুবিধার্থে বিডিংয়ের শর্তাবলি সংশোধন করে টেন্ডারের কাজ পাওয়াটা নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে এক সাব-কন্ট্রাক্টরকে অযথা অর্থ দিয়েছে। একই সঙ্গে আইডিইএমআইএ মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে বিশ্বব্যাংককে এ কথাও বলে যে, প্রতিযোগিতা সংকুচিতকরণে তাদের সহায়তা করছে টাইগার আইটি। আরেকটি অভিযোগ ছিল কার্ডের সংখ্যা ৮ কোটি থেকে বাড়িয়ে ১০ কোটি করা। যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল ক্রাইম এজেন্সি (এনসিএ) দেখতে পায়, বাড়তি ২ কোটি কার্ড তৈরি করায় যে মুনাফা হয় তার অনেক অনেক গুণ বেশি অর্থের দুর্নীতি হয়েছে মর্মে অভিযোগ করে বিশ্বব্যাংক। এতে প্রমাণিত হলো, অভিযোগ ভিত্তিহীন।
প্রকল্পটিতে কোনো দুর্নীতি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়ে বিশ্বব্যাংক বিষয়টির ওপর আরও তদন্ত চালাতে মামলাটি যুক্তরাজ্যে স্থানান্তর করে। আবার একই সঙ্গে তদন্তের ফলের জন্য অপেক্ষা না করেই, কেবল ওবারথারের বক্তব্যের ভিত্তিতে বিশ্বব্যাংক টাইগার আইটির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। এতে বলা হয়, বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে জাতীয় বা আন্তর্জাতিক কোনো প্রকল্পে টাইগার আইটির অংশগ্রহণ সাড়ে ১০ বছরের জন্য নিষিদ্ধ হলো।
অবশেষে ছয় বছর ধরে অনুপুঙ্খ তদন্তে লাখ লাখ কাগুজে ও ইলেকট্রনিক দলিল, ইমেল, বার্তালিপি ও অন্যান্য অনুসন্ধান মূল্যায়ন শেষে যুক্তরাজ্য ‘আর কোনো পদক্ষেপ নয়’ (নো ফারদার অ্যাকশন) ঘোষণা করার সিদ্ধান্ত নেয়। বাংলাদেশের এনআইডি প্রকল্পে দুর্নীতির কোনো প্রমাণ না পাওয়ায় মামলাটি বন্ধ করে দেওয়া হলো।
মামলার কারণে উদীয়মান আইডি সল্যুশন প্রভাইডার টাইগার আইটির অগ্রযাত্রা তীব্র ঝাঁকুনি খেয়েছে। ওই সময়টায় তারা বিভিন্ন দেশে বেশ কিছু আন্তর্জাতিক প্রকল্পের কাজ পায়। তারা বিশ্ববাজারে নিজেদের শক্তিমান প্রতিদ্বন্দ্বীরূপে গড়ে তোলে। নিম্ন দর উদ্ধৃত করে সফল হয় তারা। এতে মরফো, ওবারথার ও অন্য বড় বড় প্রভাইডারের অবস্থা নাজুক হয়ে পড়ে। ফলত, আইডি সল্যুশন প্রভাইডারের অনেকেই ওই সময়ে নিজেদের গুটিয়ে নেয় অথবা একীভূত হয়ে যেতে বাধ্য হয়।
নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, প্রকল্প থেকে অপসারণের পর আইডিইএমআইএ ২০০০ সালে বা তার পরে টাইগার আইটি ও সিএসএলের সঙ্গে গোপনে রফা করে এবং ক্ষতিপূরণ বাবদ ওদের কয়েক লাখ ডলার দেয়। এ বিষয়ে টাইগার আইটি কোনো মন্তব্য করতে নারাজ। তথ্যের সত্যাসত্য জানার জন্য যুক্তরাজ্য প্রতিনিধি যোগাযোগ করলে আইডিইএমআইএ জানায়, তাদের নতুন করে কিছু বলবার নেই।
সৌজন্যে বাংলাদেশ প্রতিদিন।
বাংলাদেশ সময়: ১০৩৮ ঘণ্টা, মে ১৫, ২০২২
এসআই