ফরিদপুর বোয়ালমারী থেকে: সত্তরোর্ধ্ব আশরাফ আলী। সমর্থন কোন দলের প্রতি জানতে চাইলেই তার সোজসাফটা উত্তর ‘আওয়ামী লীগের কড়া সমর্থক’।
ফরিদপুরের বোয়ালমারী পৌর এলাকায় আওয়ামী লীগ সমর্থিত সাধারণ ভোটাররাও আশরাফ আলীর মতো বিপাকে পড়েছেন।
এ বিপাকে পড়ার কারণ আওয়ামী লীগের দুই নেতা মেয়র পদে প্রার্থী হওয়ায়। যদিও দল থেকে নৌকা প্রতীকে একজনকে সমর্থন দেওয়া হয়েছে, কিন্তু আওয়ামী লীগের উল্লেখযোগ্য একটি অংশের সমর্থন রয়েছে মনোনয়ন না পাওয়া অপর আওয়ামী লীগ নেতার প্রতি।
অপরদিকে আওয়ামী লীগের নিজেদের দুর্গের এমন দ্বন্দ্বে সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে বিএনপির একক মেয়র প্রার্থী। দিনব্যাপী বোয়ালমারী নির্বাচনের মাঠ ঘুরে এ চিত্রই দেখা গেছে।
ফরিদপুর-১ আসন এলাকার বোয়ালমারী পৌরসভায় মেয়র পদে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহাজান মৃধা পিকুল। তার বিপরীতে স্বতন্ত্র হয়ে নির্বাচন করছেন উপজেলা চেয়ারম্যান এবং বোয়ালমারী আওয়ামী লীগের সভাপতি এম এম মোশাররফ হোসেন মুসার আপন ছোট ভাই মোজাফফর হোসেন বাবলু। তিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য।
বিগত দু’টি পৌরসভা নির্বাচনে এখানে মেয়র পদে জয়ী হওয়া বিএনপি নেতা আবদুস শুকুর শেখকে এবারও দলটি মনোনয়ন দিয়েছে। এছাড়া স্বতন্ত্র থেকে জামায়াতের পৌর আমির সৈয়দ নিয়ামুল হাসানও নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন।
নির্বাচন উপলক্ষে রোববার (২০ ডিসেম্বর) পৌরসভার বিভিন্ন ওয়ার্ড ঘুরে দেখা গেছে নির্বাচনী আমেজ। এলাকার চায়ের দোকানগুলোতেও আলোচনায় কেবল পৌর নির্বাচন।
১ নং ওয়ার্ডে রাস্তার পাশে এক চায়ের দোকানে কাপে চুমুক দিতে দিতে মধ্য বয়স্ক উপল চন্দ্র দাশ বলছেন, ‘চরম খেশারত দিতে হবে আওয়ামী লীগকে। নিজেদের বিরুদ্ধে নিজেরা দাঁড়াইলে বিএনপিতো তালি মারবই’। উপলদের নিজেদের মধ্যে এমন আলোচনায় প্রবেশ করে পেশাগত পরিচয় দিয়ে প্রশ্ন রাখি, ‘খেসারত কেন?’ উপলের পাশে বসা তার বয়সী নেয়ামত উল্লাহ বলেন, ‘দল নৌকা প্রতীকে মনোনয়ন দিয়েছে পিকুলকে, কিন্তু বাবলুর জনপ্রিয়তাওতো খারাপ না। দলের বড় একটি অংশ বাবলুরে সাপোর্ট করে। কেবল এমপি ও দলের কিছু লোক ছাড়া। ’
এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী পিকুলের পক্ষে রয়েছেন ফরিদপুর-১ এর সংসদ সদস্য আবদুর রহমান। অন্যদিকে বাবলুর সমর্থনে রয়েছে উপজেলা চেয়ারম্যান ও বোয়ালমারী আওয়ামী লীগের সভাপতি মোশাররফ হোসেন মুসা। দল মনোনীত প্রার্থী পিকুল এবং দলের নেতা বাবলু নির্বাচনে প্রার্থী হলেও বোয়ালমারীর জনগণ বলছেন, ‘এটা মূলত এমপি ও উপজেলা চেয়ারম্যানের লড়াই। ’
এদিকে আওয়ামী লীগ থেকে পিকুল মনোনয়ন পেলেও পৌর এলাকায় বাবলু উপজেলা চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন মুসার সমর্থিত দলের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ নিয়ে প্রচারণায় ব্যস্ত। অন্যদিকে সংসদ সদস্য আবদুর রহমানের নির্দেশনায়ও পিকুল ব্যাপক প্রচারণা চালাচ্ছেন। প্রচারণার পাশাপাশি এক পক্ষ অন্য পক্ষের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ করছেন।
এদিকে নিজেদের মধ্যে এমন লড়াই আরও জমে ওঠে একে অপরের বিরুদ্ধে আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগের মাধ্যমে।
১৮ ডিসেম্বর ফরিদপুরের বোয়ালামারী পৌরসভা নির্বাচনে সরকারদলীয় এমপি আব্দুর রহমানের বিরুদ্ধে আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ এনেছেন স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী ও আওয়ামী লীগ নেতা মোজাফফর হোসেন বাবলু মিয়া।
এমপির বিরুদ্ধে আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগের একদিন পরই বোয়ালমারী উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আ’লীগের সভাপতি এমএম মোশাররফ হোসেনের বিরুদ্ধে পিকুল আচরণ বিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ করেন।
পৌর এলাকার আওয়ামী লীগ সমর্থিত কয়েকজন ভোটার বাংলানিউজকে জানান, ‘এমপির বিরুদ্ধে উপজেলা চেয়ারম্যান, চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে এমপির প্রার্থীর অভিযোগ- এসব তামাশাই দেখতেছি। ’ এখানকার একজন আওয়ামী লীগ সমর্থকের মত, ‘আওয়ামী লীগ এ নির্বাচনে নিজের পায়ে নিজেরা কুড়াল মারছে। দল থেকে একাধিক প্রার্থী যেনো না হয় মনোনয়ন দেওয়ার সময় সেটা গুরুত্ব দিয়ে লক্ষ্য রাখা দরকার ছিলো। ’
বোয়ালমারিতে আওয়ামী লীগের এমন অবস্থানে এ দল সমর্থিতদের কেউ কেউ মনে করছেন, ‘এতে বিএনপি প্রার্থী জয়ের সম্ভাবনা বেশি। কারণ আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী ও বিদ্রোহী প্রার্থীর মধ্যে ভোট ভাগাভাগির সুযোগে ভোটের ব্যবধানে বিএনপি এগিয়ে থাকতে পারে। তাছাড়া এ এলাকায় বিএনপিরও ভোট ব্যাংক রয়েছে। ’
এদিকে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী পিকুল জয়ের ব্যাপক আশাবাদী বলে জানিয়েছেন। পিকুলের এমন আশাকে উড়িয়ে দিয়েছেন বাবলু। তিনি বলেছেন, দল তাকে সমর্থন না দিলেও উপজেলায় এ দলের বড় অংশই তার সমর্থনে রয়েছেন। অপরদিকে বর্তমান মেয়র ও বিএনপি মনোনীত প্রার্থী আবদুস শুকুর শেখও বলছেন, সুষ্ঠু নির্বাচন হলে তিনি আবারও পৌর মেয়রের আসনে বসবেন।
এদিকে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী বাবলুর সমর্থক আবুল কালাম মোল্লা বাংলানিউজকে বলেন, ‘আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। অথচ পিকুল আমাকে ২ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর সেলিমুজ্জামান সেলিমের বাসায় ধমক দিয়ে প্রশ্ন করে, আমি কেন নৌকার প্রতীকের প্রচারণা করছি না? আমি তাকে বলেছি এখানে নৌকা ঠিক থাকলেই হবে না। মাঝিও ভালো থাকতে হবে। ’
এদিকে এমপি সমর্থিত অংশ বলছে, পিকুল একজন ত্যাগী নেতা। দল সবকিছু চিন্তা করে তাকেই মনোনয়ন দিয়েছে। উপজেলা চেয়ারম্যান ইন্ধন দিয়ে বিদ্রোহী প্রার্থী দাঁড় করিয়েছেন বলে তাদের অভিযোগ।
বিএনপি সমর্থিত ভোটারদের সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, এ উপজেলায় বিএনপির অবস্থান দুর্বল নয়। শক্ত অবস্থানেই আছে দলটি। কর্মীরাও তাই কাজ করছেন।
এদিকে নির্বাচনে সুষ্ঠু হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন, বিএনপি মনোনীত প্রার্থী ও আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী গ্রুপ। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে প্রত্যেকেই মনে করছেন জয় তার পক্ষে যাবে।
এদিকে এলাকাবাসীর সঙ্গে পৌরসভার বিভিন্ন সমস্যার বিষয়ে নিয়ে জানতে চাইলে তারা বলেছেন, প্রথম শ্রেণির পৌরসভা হওয়া সত্ত্বেও নাগরিক সব সুবিধা থেকে বঞ্চিত। তাই এবার পৌরবাসী ভোট দিতে চান দেখেশুনে।
২০০০ সালে শুরু হয় বোয়ালমারী পৌরসভার কার্যক্রম। দু’বছর আগে পৌরসভাটি প্রথম শ্রেণির মর্যাদা অর্জন করে। কিন্তু নাগরিক সেবায় এর নেই কোনো প্রতিফলন।
পৌর এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, ড্রেনেজ ব্যবস্থা নেই, রাস্তা-ঘাটও বেহাল।
কয়েকজন পৌরবাসী জানান, বছর জুড়ে উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য কোনো কাজ না হলেও নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর এলাকায় ১৭৭টি বৈদ্যুতিক খুঁটি বসানো হয়েছে। তবে ওই খুঁটিতে বাতি কবে জ্বলবে তার দিনক্ষণ জানে না কেউ। এরই মধ্যে পোস্টারে-পোস্টারে ছেয়ে গেছে পৌরসভা রাস্তাঘাট, হাটবাজার, অলি-গলি। এলাকার উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোটারের দুয়ারে এখন প্রার্থীরা দিন রাত কাজ করে চলেছেন। ভোটাররা প্রত্যাশা করেন, নির্বাচনের আগে যেভাবে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হচ্ছে, মেয়র ও কাউন্সিলর নির্বাচিত হওয়ার পরে তা ভুলে না যান।
বাংলাদেশ সময়: ০৮১৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২১, ২০১৫
এডিএ/এসএইচ
** ‘মামাই ভরসা’
** নাম তার ‘মেঝভাই’
** ‘এবার জোয়ান বুড়ার লড়াই’